×

মুক্তচিন্তা

বিশ্বসমাজে কার ঘর কে ভাঙছে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৮ পিএম

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থনার স্থান মন্দির। সেই মন্দির ভাঙার ইতিহাস অনেক পুরনো। পাকিস্তান শাসনামলেও এর সরব অস্তিত্ব ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এ দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশ্বাস হয়েছিল- আর বুঝি মন্দির ভাঙার কাজটি হবে না। কিন্তু তাদের বিশ্বাস বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মন্দির ভাঙার মাতম লেগেই আছে। এ কাজে অনেকেরই উৎসাহের শেষ নেই। ধর্মের নামেই অনেক সময় ধর্মের এই আরাধনার স্থান ভাঙা হয়। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় বৈকি! সামাজিক এই পরিবেশটি পুরো দেশের জন্য বদনাম বয়ে নিয়ে আসে। মন্দির কিছু মানুষের উপাসনালয়, তাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গা। সেখানে আক্রমণ করলে মন্দিরের ভক্তদের মনে আঘাত দেয়া হয়, তাদের ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত করা হয়। এটি আইনের চোখে রীতিমতো অপরাধ। মনে হয়, এটুকু বুঝার জ্ঞান ও চেতনা তাদের আছে। কিন্তু যেহেতু এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, তাই সংখ্যালঘুরা এর প্রতিবিধানে সাহস করে এগিয়ে আসবে না- এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়েই একদল উন্মাদ মানুষ মন্দির ভাঙার কাজটি সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানে মোট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বর্তমান সংখ্যা ৭৫ লাখ। ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশে এই ৭৫ লাখ হিন্দু সম্প্রদায় সেখানে খুব একটা নিরাপদ অবয়বে বসবাস করতে পারে না। তাদের নিত্যদিনের আশঙ্কা লেগেই আছে। সেই পাকিস্তানেরই ঘটনা এটি। খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশে গত ৩০ ডিসেম্বর কিছু দুষ্কৃতকারী একটি মন্দির ভেঙে ফেলে, আগুন দিয়ে মন্দির ভবন পুড়িয়ে ফেলে। মন্দিরটি ছিল করক জেলার তেররি গ্রামে। ১৯২০ সালেরও আগে তৈরি হওয়া এ মন্দিরটি ভাঙা হলো। কিছু ধর্মোন্মাদ ওই মন্দিরে হামলা চালায়। চলে ভাঙচুর। প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসতে পারেনি হিন্দু ভক্তরা। বরং যার যার জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। লুট হয়ে যায় মন্দিরের জিনিসপত্র। মন্দিরটির সংস্কার চলছিল। একটি অংশ নতুন করে তৈরি হচ্ছিল। এই অংশটিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। ৯২ জন পুলিশ সদস্য পাশে দাঁড়িয়ে নীরব ভ‚মিকা পালন করে। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় পাকিস্তানের ছোট্ট হিন্দু সম্প্রদায়টি। নিন্দার তীব্র বাণী নিয়ে এগিয়ে আসে ভারত সরকারও। একটি মন্দির ধ্বংসের কারণে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী একটি দেশেও কতখানি তোলপাড় হতে পারে, খাইবার পাখতুন খোয়ার মন্দির ভাঙা তারই একটি বড় উদাহরণ। এই একটি ঘটনা গোটা পাকিস্তানকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে এবং পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে। এটি ধর্মীয় অনুভ‚তির ব্যাপার। গুরু হোক আর লঘু হোক, সংখ্যায় যতই সামান্য হোক- নাগরিকের ধর্মচর্চা করার স্বাধীনতায় অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মন্দির ভাঙচুর করা মানে সরাসরি ধর্মানুভ‚তিতে আঘাত করা। পাকিস্তানের মতো একটি মৌলবাদী দেশেও মন্দির ভেঙে পার পাওয়া যাচ্ছে না। সারা বিশ্ব লজ্জা দিচ্ছে তাদের। বাংলাদেশ মৌলবাদী কোনো দেশ নয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। এ দেশে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ স্বাধীনভাবে যার যার ধর্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ধর্ম পালন করার সুযোগ পাচ্ছে। তারপরও এখানে মাঝে মাঝেই কিছু হিংস্র ধর্মান্ধ লোক সুযোগ পেলেই হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। বিষয়টি হালকাভাবে নয়, বেশ গভীরভাবে ভাবতে হবে এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়কে। মনে রাখতে হবে, দেশ বিভাগের সময় এ দেশে ১৯৪৭ সালে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৩১ ভাগ। ১৯৭০-এ এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ ভাগে। ১৯৮১-তে তা দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। ১৯৯১-এ ১২ এবং ২০০১-এ শতকরা ১০-এ নেমে আসে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। ২০১৪-এর হিসাব অনুযায়ী তা নেমে আসে ৮ ভাগে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ৮ ভাগ মানুষ হিন্দু। একটি গ্রামের কথাই যদি ধরি, তাহলে ১০০ ঘর মুসলমানের মধ্যে ৮ ঘর মাত্র হিন্দু জনগোষ্ঠী। সংখ্যালঘুদের দেখভালের দায়িত্ব সংখ্যাগুরু মানুষদের ওপরই বর্তায়। এতে কেউ ধ্বংস করার মেজাজে থাকলে, কেউ দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে চাইলে তা দেশের জন্য শুধু লজ্জাই বয়ে আনবে। পুলিশ নয়, প্রশাসন নয়, সরকার নয়- সর্বাগ্রে মানুষকে রক্ষা করতে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৭২ সালে আমরা সারাদেশে দুর্গাপূজার সময় দেখেছি হিন্দুদের মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা হতে; ১৯৮১ সালে এবং ১৯৯০ সালে এর পুনরাবৃত্তি হতে দেখেছি, মন্দির এবং হিন্দু ঘর-বাড়ির ক্ষতি হতে দেখেছি; ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেখেছি। এখানেই শেষ হয়নি। মন্দির ভাঙার কাজ হয়েছে ২০১২ সালে, ২০১৩ সালে, ২০১৪ সালে এবং ২০১৫ সালে। এ ধারা কিছুটা হলেও অব্যাহত হতে দেখেছি ২০১৬ সালে। তারপরও এ ধ্বংসযজ্ঞের কোনো শেষ নেই। আজ অবধি তা চলছে। সরকার অনেকটাই তৎপর বলে হয়তো সুযোগটা কমে যাচ্ছে। কিন্তু মন্দির ভাঙার কাজটি থেমে নেই। সুযোগ পেলেই একদল ভ্রান্তপথের মানুষ সে কাজটি করে চলেছেন। সময় এসেছে বিষয়টি ভালোভাবে ভেবে দেখার। ১০০ জনের মধ্যে ৮ জনের ঘরবাড়ি ভাগাভাগি করে নিলেও তো সবার লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে কেন এ হিংসা, কেন এ ধ্বংস? বরং সবাই মিলে যদি হাতে হাত রেখে বসবাস করতে পারি, তবেই তো শান্তির বাতাস বইবে আমাদের মাঝে। এক দেশের সংখ্যাগুরু অন্য দেশের সংখ্যালঘু। কাজেই কে কার উপাসনালয় ভাঙবে? এই বিশ্বসমাজে কার ঘর কে ভাঙছে? একজন সংখ্যালঘুর মন্দির ভেঙে ধর্মের কোনো ক্ষতি কিংবা লাভ কোনোটাই করা যায় না। ধর্ম ব্যক্তির বিশ্বাসÑ ব্যক্তির মনের গহিনে ধর্ম লুকানো থাকে। তাকে ধ্বংস করা যায় না, পুড়ানো যায় না।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App