×

জাতীয়

চ্যানেলে পানি নেই, হরেক স্থাপনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:১৫ এএম

চ্যানেলে পানি নেই, হরেক স্থাপনা

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ থাকলেও এ নিয়ে তৎপরতা নেই কোনো কর্তৃপক্ষের। গত ৭ বছরে কিছু চিঠি চালাচালি, কমিটি গঠন আর কয়েক দফা সরেজমিন পরিদর্শনের মধ্যেই সীমিত রয়েছে এর উদ্ধার কার্যক্রম। সবশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এ নিয়ে একটি প্রকল্পের খসড়া করলেও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে, সেখানে দখলের ভিতও শক্ত হচ্ছে। এখন চ্যানেলটিতে পানির প্রবাহ নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্পকারখানা, দালান, এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও।

গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে আদি চ্যানেল দখলের ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে। সেখানেই বলা হয় চ্যানেলটিতে পানির প্রবাহ না থাকার কথা। ৬০, ৬৪ ও ৬৫ পৃষ্ঠায় বলায় হয়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর সংলগ্ন চ্যানেলের (আদি বুড়িগঙ্গার-২য় চ্যানেল) অধিকাংশ জমি অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে এবং কয়েক হাজার স্থাপনা ও বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে আদি চ্যানেলটিতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর জায়গায় ম্যাটাডোর পার্ক, পান্না গ্রুপের কারখানা, হাসপাতাল ও সুগন্ধা কৃষি মার্কেট তৈরির কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। সরেজমিন গিয়েও এক পর্যায়ে চ্যানেলে পানির দেখা মেলেনি।

কমিশন জানায়, ১৯৫০ সালের স্টেট একুইজিশন এন্ড টেনেন্সি অ্যাক্ট এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা অনুযায়ী নদীর মালিকানাস্বত্ব সংরক্ষণ ও সীমানা চিহ্নিত করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের ওপর অর্পিত। নদীর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যায় না। বন্দোবস্তও দেয়া যায় না। সেটি সিএস পরবর্তী কোনো জরিপে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে হওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য জরিপ সংশোধন ও সিএস ম্যাপের ভিত্তিতে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে উচ্ছেদ চালানোর সুপারিশ করে কমিশন। এ বিষয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)সহ সংশ্লিষ্টদের সম্প্রতি চিঠি দেয়া হয়েছে।

পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের কিছুটা পশ্চিমে কামরাঙ্গীরচর, নবাবেরচরসহ কিছু এলাকাকে মধ্যে রেখে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। এর উত্তর দিকের শাখাটি আদি চ্যানেল। আর দক্ষিণেরটি মূল বুড়িগঙ্গা হিসেবে এখনো প্রবাহমান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে গঙ্গার একটি প্রবাহ ধলেশ^রী নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। এই ধারাটি গতিপথ পরিবর্তন করে এক সময় গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বুড়িগঙ্গা নামে অভিহিত হয়। ১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ঢাকার উজানের নদনদীগুলো মধুপুর জঙ্গলের উত্তর থেকে কিছুটা দক্ষিণে সরে যায়। সে সময় (মতভেদে তারও আগে ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে) সলমাসি, কলাতিয়া, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গাও দক্ষিণে সরে আসে। তখন তলদেশের গঠনগত পরিবর্তন হওয়ায় নদীতে পলি পড়ার গতিও বেড়ে যায়। মাঝখানে জেগে উঠতে থাকে চর, যার একটি অংশ পরবর্তী সময়ে কামরাঙ্গীরচর ও আরেকটি অংশ নবাবেরচর হিসেবে পরিচিত হয়। এসব চরের ভেতর দিয়ে কয়েকটি খাল ও জলাভূমি থাকার প্রমাণ দেখা যায় উনিশ শতকের শুরুর দিকে প্রণীত সিএস ম্যাপে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুলের নিচে পানির ক্ষীণ অস্তিত্ব থাকলেও মাটি ও ময়লা-আবর্জনা ফেলে দুপাশ ভরাট করা হয়েছে। অসংখ্য বাড়িঘর, বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে সেখানে। সেতুর পশ্চিম দিকে কিছুদূর যাওয়ার পর চ্যানেলটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে আড়াআড়িভাবে একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পান্না গ্রুপের ভলবো ব্যাটারির কারখানায় যাওয়ার জন্য সেটি করা হয়েছে বলে জানা যায়। গ্রুপটি আদি চ্যানেলের জায়গায় বিশাল কারখানা তৈরি করেছে। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ করা নবাবগঞ্জের পাকা সেতুটির নিচে দেখা গেছে, পানি নেই, আছে মাটি। আবাসন ব্যবসায়ীরা বালু ভরাট করে ওই এলাকায় সারি সারি প্লট তৈরি করেছেন। একই অবস্থা কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর ও হাজারীবাগের কোম্পানিঘাট সেতুরও। কামরাঙ্গীরচরে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) সাব স্টেশনটিও তৈরি হয়েছে এ আদি চ্যানেল ভরাট করে। হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাস ও এর আশপাশের এলাকার দখল দেখে বোঝার উপায় নেই, কোনোদিন এখানে পানির প্রবাহ ছিল। বছিলা এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আহমাদ আলী জানান, ২৫-৩০ বছর আগেও আদি চ্যানেলে বড়বড় নৌকা চলত। কয়েকটি শাখার মাধ্যমে এ চ্যানেলটি তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিলিত ছিল। ছোটবেলায় এ নদীতে নৌকা চালানো ও মাছ ধরার সুখকর স্মৃতিরোমন্থন করেন তিনি।

২০১৪ সালের ২৫ মে নদীরক্ষা সংক্রান্ত তৎকালীন টাস্কফোর্সের সভাপতি ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান কয়েকজন মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে আদি চ্যানেল পরিদর্শনে যান। চ্যানেলটির দূরবস্থা দেখে নৌমন্ত্রী পরদিনই সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে আদি চ্যানেল উদ্ধারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আজ পর্যন্ত সেসব বাস্তবায়ন করা হয়নি। তখন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। পরে লালবাগ সার্কেলের সহকারী ভূমি কমিশনারকে আহ্বায়ক করে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই উপকমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নদী রক্ষা কমিশন দখলদারদের তালিকা তৈরি করে। এ প্রসঙ্গে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি নৌ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। সেটি নৌপথের অংশ নয়। আগে বিআইডব্লিউটিএ কামরাঙ্গীরচর লোহারপুল পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছিল। পুরো চ্যানেলটি উদ্ধার ও উন্নয়নের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিকল্পনা করছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, আদি চ্যানেল নিয়ে কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে নাব্য ফিরিয়ে আনা, বর্জ্য অপসারণ ও নান্দনিক সৌন্দর্য্য বাড়ানো হবে। এ নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত হলেই দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে যাবে করপোরেশন। তিনি বলেন, সেখানে জমির সীমানা নিয়ে জটিলতা থাকতে পারে। এছাড়া অনেক বড় শিল্পকারখানা ও স্থাপনা রয়েছে। তবে মেয়র ফজলে নূর তাপস সিএস ম্যাপ অনুযায়ী চ্যানেলটি উদ্ধারে বদ্ধপরিকর।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, কোন সংস্থা উদ্ধার করবে সেটা বড় কথা নয়। আমরা চাই আদি চ্যানেলটি দ্রুত উদ্ধার করে প্রবাহমাণ করা হোক। আমরা অনেক দিন আগে থেকেই এ দাবি জানিয়ে এলেও বাস্তবায়নের কাজ খুব একটা এগোয়নি। তিনি বলেন, নদনদী রক্ষায় পূর্ণাঙ্গ অভিযান ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে এসব করা হলে তা ফলপ্রসূ হবে না। এ জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App