×

অর্থনীতি

অনিয়মে জড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৪ এএম

অনিয়মে জড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও নানা অনিয়মে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত। তবে এসব অনিয়ম রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়ে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাজে ক্ষোভ জানিয়েছেন উচ্চ আদালত। জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অফিসার থেকে শুরু করে ডিজিএম, জিএম, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ বেশ পুরনো ঘটনা। তবে নতুন তথ্য হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্র্তা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা সুবিধা নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় অযোগ্যদের নিয়োগ হওয়ায় বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের এ পরিণতি, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, ঘুষের বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য চাপা দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে গতকাল বৃহস্পতিবার সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসিয়াল আদেশে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয়

ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনি ভোরের কাগজকে জানান, তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে স্টাফ ‘ল’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এ মুখপাত্র। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইমেজ অনেকটাই ভালো। সেই ইমেজ নষ্ট করতে যদি কতিপয় খারাপ কর্মকর্তা যুক্ত হয়, তবে অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত, কঠোর হস্তে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, সমস্যা রয়েছে পুরো সরকারি কাঠামোতে।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাটে সরাসরি সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি বড় অঙ্কের সুবিধা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের অনেকেই আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন নিয়মিত। এছাড়া এ লোপাটের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরো অনেকেই নীরব ভ‚মিকা পালন করেছেন। জালিয়াতির ঘটনাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকে জানলেও তারা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেননি। সংশ্লিষ্টদের এমন নীরবতার কারণেই পি কে হালদার বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গত মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে আনে।

জবানবন্দিতে রাশেদুল আরো বলেছেন, এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিআইএফএম (ডিপার্টমেন্ট অব ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এন্ড মার্কেটস) বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা দেয়া হতো। এ টাকা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাশ হিসেবে উত্তোলন করে ‘বিবিধ’ খরচ দেখানো হতো। যাতে ঘুষের টাকার কোনো প্রমাণ না থাকে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রæপের চেয়ারম্যান শহিদ রেজা পি কে হালদারের প্রধান সুবিধাভোগী ছিলেন বলেও জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। পি কে হালদার ও রেজা লোপাট করা অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। সূত্র জানায়, রাশেদুল হকের দেয়া জবানবন্দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বর্তমানে নির্বাহী পরিচালকসহ যাদের নাম এসেছে, তাদেরও তদন্তের আওতায় নিয়ে আসবে দুদক। এ বিষয়ে তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। এর আগে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও আর্থিক খাতে অর্থ লোপাটের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নীরবতাকে দায়ী করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ভ‚মিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই এমন জালিয়াতি করা সম্ভব হয়েছে।

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি : এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অরক্ষিত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দায়িত্বহীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হলেও গোপন রাখা হয় আরো ২৪ দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি নিয়ে ফরাসউদ্দিন কমিটির মূল প্রতিবেদনের এসব তথ্য একাধিকবার গণমাধ্যমে এসেছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঢিলেঢালা কাজের ধরন অপরাধীদের কাজের সুবিধা করে দিয়েছে। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত এক ডজন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলেও কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো পদোন্নতি পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

সরানো হলো শাহ আলমকে : ঘুষের বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য চাপা দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে তিনি এই পদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের আদেশে বলা হয়েছে, শাহ আলম এখন থেকে ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি, ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ও স্পেশাল স্টাডিজ বিভাগের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আগে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ, ব্যাংক পরিদর্শন-২ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নতুন নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির।

পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য চাপা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। গত মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়।

মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহর কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেয়া হতো ২ লাখ টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এসব অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেয়া হলো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App