×

সাময়িকী

যেন শাদা মেঘের মতো আকাশে ভেসে থাকা জীবনের আখ্যান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:২৩ পিএম

যেন শাদা মেঘের মতো আকাশে ভেসে থাকা জীবনের আখ্যান

এ জীবন আকাশের, বৃষ্টির, মেঘেদের। জীবন পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। আকাশে ল্যাপ্টে থাকে তুলো মেঘের মতো শাদা। আবার স্বাধীনতার ঝাণ্ডা হাতে উড়ে বেড়ায় বিস্তৃত আকাশের বুকে। জীবন বিচিত্র; বিচিত্র তার রঙ। আর জীবনের এই দুরন্ত-উড়ন্ত-বিচিত্র এবং ক্ষিপ্ত চরিত্রের কথাগুলো শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন এ সময়ের আলোচিত কবি বঙ্গ রাখাল। এক ফর্মায় মলাটবদ্ধ ‘অন্ধ যাজক’ শিরোনামের গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক অনায়াসে অন্য জগতে বিচরণ করবেন। ‘আলোকাটা ভোর’ শিরোনামে গ্রন্থটির প্রথম কবিতায় কবি লিখেছেনÑ ‘রাতে যারা জেলে রহস্য মেখে রুপালি আলোয় কেড়ে খায় শ্রমিকের নিঃশব্দের উচাটনগন্ধী শরীর, তাদের বলিÑ আঙুল মারাত্মক স্বদেশ’

কবিতাটি গভীর স্যাটায়ার কবিতা। কবি এই কবিতায় তার বিশেষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যা স্পষ্ট। পচে যাওয়া সমাজ, বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিদ্রুপ আর শ্রেণিবৈষম্যের স্পষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন কবি। অবিরত ধর্ষণের শিকার হওয়া কন্যাশিশু কিংবা নারীর জন্য এই জনপদ আমরা নিরাপদ করতে পারিনি দীর্ঘ সময় পরও। সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ ঝুলে থাকে অথচ রাষ্ট্র এবং আমরা নির্বিকার। কবির খেদ এখানেই। এই খেদের শেষ নেই। তবে কবি শতভাগ নিরাশ নন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অন্ধকার কেটে একদিন আলোর মুখ দেখবেই পৃথিবী। তাই কবি এই কবিতাতেই লিখেছেনÑ ‘অনিন্দিতাকে বলেছি কাল আসিসÑ আমরা রাস্তায় আলো ছড়াবো’

‘বোবা মেয়েটি আমার বোন ছিল’ শিরোনামের কবিতাটি গ্রন্থের প্রথম কবিতা আলোকাটা ভোর এর বক্তব্য অনুসরণ করে। কবিতাটি গ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা। এই কবিতাটিতেও কবির চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মাত্র কিছু দিন আগে এই জনপদে অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলো কবিকে চিন্তিত করেছে। কবি লিখেছেনÑ ‘রাতটা আজও আমার দ্বারে আসে ধর্মযাজকের মতো ছায়াপুরুষ হয়ে... মাঠের পরে মাঠÑ বোন ঘুমায় রাজ্যের মহামারি বুকের ঘুঘু করেÑ হাঁটুরে বাবার পকেটে থাকে কষ্টে জমানো লাল ফিতা।’

কৃষক জাতির মেরুদণ্ড। কী রোদ কী বৃষ্টি, পুড়ে পুড়ে কিংবা ভিজে ভিজে মহৎ কৃষকই আমাদের মুখে তুলে দেন অন্ন। অথচ এই মহৎ পেশার মানুষগুলোর খোঁজ আমরা রাখি ক’জন? কবির কৃতজ্ঞতাবোধের পরিমিতি আমরা দেখতে পাই তার এই গ্রন্থের কবিতায়। কবি এখানে বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রাণীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুরের কৃষকরাই শুধু তার এই বিপ্লবী জীবনের সঙ্গী নয়; সারা ভারতজুড়ে কৃষক আন্দোলন যে আশা জাগানিয়া হয়ে উঠছে কবিতায় তারই বার্তা দিয়েছেন কবি। তিনি সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন সমতার। কৃষকের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা কিংবা মনে আশা সেই বাক্য কবি ‘বিদ্রোহী গুরুদাস’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেনÑ ‘ঠোঁটের কোণে স্বজাতির লাগানো গাছের জীবন্ত পাতা আর হাজার শোষিতের সাহস প্রকম্পিত করে গোধূলির নীরব ছায়া’ অথবা ‘সমাজতন্ত্র দেখে যেতে পারবো তো হে’

লালন, মহামতি বুদ্ধ কিংবা ‘জীবনানন্দের মতো মহৎপ্রাণের প্রতি কবির শ্রদ্ধা পাঠককে প্রাণিত করবে। ‘বুদ্ধ-প্রদীপ’, ‘জীবনানন্দ’, ‘লালন’ শিরোনামের কবিতা তিনটি বেশ পাঠমুগ্ধতা এনে দেয়। ‘ক্রাচে হাঁটে বাংলাদেশ’ গ্রন্থটির পঞ্চম কবিতা। কবিতাটি এক কর্নেলকে উদ্দেশ করে। এই কর্নেল অনেকেরই পরিচিত মুখ। যিনি বাংলাদেশকে একটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দেশে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। যার কারণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণক্ষেত্রে ১৯৭১-এ। অথচ তাকেই ঝুলতে হয়েছিল ফাঁসির দেিড়তে। দারুণ বার্তাবহনকারী কবিতা এটি। কবি লিখেছেনÑ ‘কর্নেল দেখো এখনো হাজার হাজার কর্নেল পা হারা তোমার প্রতিরূপÑ বাম পা হারিয়ে ক্র্যাচে ভর করে হাঁটে বাংলাদেশ’

‘দগদগে জীবনের গল্প’, ‘মন বলছে কমু কমু, ‘ল্যাকেজ : নারী’ কবিতা তিনটি দারুণ রোমান্টিক কবিতা। ‘সিনেমাটিক শর্ট’, ‘জারজ’ কবিতা দুটি স্যাটায়ারিক। কবি লিখেছেনÑ ‘আমরা কাকে বলি জারজ-কাকে বলি বেজন্মাÑ এ তো আমাদেরই আনন্দসন্তানÑ যা হৃদয়ঘুণে কুরে কুরে খায়’

‘বিশ্বাসকে যেভাবে মেরেছিল’ শিরোনামে গ্রন্থটির শেষ কবিতাটিও বেশ রোমান্টিক। ‘বিশ্বাসকে গলা কেটে হত্যা করে কতিপয় কাছাকাছি মানুষ’ চরণটি খুব পাঠমুগ্ধতা দান করে পাঠককে।

কী ধর্ম, কী বর্ণ, কী অন্য কিছু, মানুষের পরিচয় শুধু মানুষ। কবি বঙ্গ রাখাল এমন বার্তা পুনর্ব্যক্ত করতে চেয়েছেন তার এক ফর্মার কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধ যাজকে’। আমরা সহজেই কবির মনোজগতের খবর পেতে পারি এই গ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থটির ১৪টি কবিতার বেশিরভাগ কবিতাই শক্তিশালী মনে হয়েছে। কবি এই কাব্যগ্রন্থটিতে তার সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বলে মনে করি। দারুণ দ্বন্দ¦-রোমান্টিকতায় ভরা তার কাব্যগ্রন্থটি। কাব্যগ্রন্থটির সব কবিতাই উত্তরাধুনিক কাঠামোতে রচিত এবং ছন্দের দ্ব›দ্ব লক্ষণীয়। গদ্যছন্দে লেখা তার কবিতাগুলো। কয়েকটি কবিতাকে গ্রন্থের সাথে মানানসই মনে হয়নি; সাধারণ ঢঙে লেখা। কিছু বানান এবং অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার পাঠককে ধন্দে ফেলে দেবে বলে মনে হয়। গ্রন্থটির অভ্যন্তরীণ অঙ্গসজ্জা প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির শিশুবন্ধু ত্বাসীনকে। নান্দনিক একরঙা কভারের প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিশির মল্লিক। প্রকাশনা সংস্থা ‘লেখমালা’। বইটির শুভেচ্ছা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে পঁচিশ টাকা মাত্র। সব মিলিয়ে কাব্যগ্রন্থটিকে একটি স্বার্থক কাব্যগ্রন্থ বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। ব্যতিক্রম চেষ্টার এই কাব্যকর্ম কবির অক্লান্ত চেষ্টাকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App