×

অর্থনীতি

ভ্যাকসিনে সচল অর্থনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৩৯ এএম

করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সাল ছিল বিধ্বংসী এক বছর। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস। গত বছর বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। তবে ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে নানা গবেষণা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের মহামারি চলাকালীন ভ্যাকসিন ছাড়া অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে কর্মকাণ্ড গতি পাবে। এটা অনেক দেশই শুরু করেছে, বাংলাদেশেরও শুরু করা প্রয়োজন। তবে সারাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত করোনার আতঙ্ক কাটবে না। ফলে চলতি বছরে অর্থনীতিও স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরতে পারবে না বলে মনে করেন অনেকে। গত ২৬ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১০ সালের পর এটাই সবচেয়ে দ্রুত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। তবে ভাইরাসের মিউটেশন ও টিকা প্রাপ্তির বিষয়টির ওপর এটি নির্ভর করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, করোনা সংকট-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকবে ‘ভ্যাকসিন’ আর বিভিন্ন ধরনের ‘বিনিয়োগ’। প্রাণঘাতী এ ভয়াবহ ভাইরাস মোকাবিলা করতে বিশ্বব্যাপী ২০০টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের মধ্যে ৫০টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২০। চীনে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার পর তাদের বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। বাংলাদেশের রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশির গন্তব্য ইউরোপে দ্রæত হারে বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। যদিও তখনো ভাইরাসটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি, কিন্তু এর সংক্রমণের ফলে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক সংকটের আঁচ তখন বাংলাদেশও অনুভব করতে শুরু করে। দুঃসংবাদটি আসে কয়েক মাস পর। আমদানিকারক দেশগুলো তাদের অর্থনীতি সচল রাখতে হিমশিম খাওয়ায় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। এপ্রিলে জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার ঘোষণা করেছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘোষিত সবচেয়ে বৃহৎ অঙ্কের প্রণোদনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরপর গত জুনে দেশের অর্থনীতি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ ছিল এবং যেহেতু এরপর ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি, তাই এটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হিসেবেও প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও বিতরণব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এর ওপরেই আগামীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনেক কিছু নির্ভর করবে। সুতরাং এদিকে খুব ভালোভাবে নজর দিতে হবে। এতে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হবে। তা না করতে পারলে ২০২০ সালে আমরা যে অনিশ্চয়তা দেখেছি, তা আরো ঘনীভ‚ত হবে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বিভিন্ন দিক দিয়েই ধাক্কা খেয়েছে। কর্মসংস্থান, মানুষের আয়, অর্থনৈতিক অবস্থা- সবদিক থেকেই। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয়, স্বাস্থ্য বিপর্যয়- এর মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। তবু ভালো যে, বিশ্বে চতুর্থ বিপর্যয়ে যোগ হয়েছিল খাদ্য বিপর্যয়, যা আমাদের দেশে হতে পারেনি। এটি আমাদের দেশের একটি শক্তিমত্তার জায়গা ছিল। তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, চলতি বছরেও করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে থাকবে। কারণ হিসেবে মাশরুর আরেফিন বলেন, দেশের একজন মানুষও যদি টিকা না দিয়ে থাকে তাহলে করোনা থেকে দেশ মুক্ত হবে না। তাই সারাদেশের মানুষকে টিকা দিতে সময় লাগবে। এ জন্য এ বছরেও করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে থাকবে বলে মনে করেন তিনি। ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকা দেয়া শুরু : একজন নার্সকে প্রয়োগের মাধ্যমে ২৭ জানুয়ারি দেশে বহু কাক্সিক্ষত কোভিড-১৯ টিকা দেয়ার কার্যক্রম ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে কয়েক শ জনকে টিকা দিয়ে দেখার পর ৭ ফেব্রæয়ারি সারাদেশে টিকাদান শুরু করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। টিকা উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গেøাব বায়োটেক : সরকারের পাশাপাশি টিকাদান প্রক্রিয়ায় এগিয়ে এসেছে দেশের বেসরকারি খাত। সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা উৎপাদন করার অনুমোদন পেয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, তারা এ টিকার নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গভ্যাক্স’। যে কোনো ওষুধ উৎপাদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন হয়। অধিদপ্তর গেøাব বায়োটেককে এ টিকা উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছে। টিকা উৎপাদনের পর গেøাব বায়োটেক টিকার ট্রায়ালের অনুমোদনের জন্য চেষ্টা চালাবে বলে আসিফ মাহমুদ জানান। নতুন বছরে চালকের আসনে ভ্যাকসিন : জানুয়ারির শুরুতেই বিশ্বব্যাংক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনা সংকট পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকবে ভ্যাকসিন আর বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ। ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসবে উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের হিসেবে এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় এক ধরনের ঝুঁকি রয়ে গেছে, এমনকি দীর্ঘ সময় মানুষের আয়-রোজগারে চলমান সংকট বহাল থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। সংস্থাটি জানায়, বিপুল পরিমাণে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ না করা গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। সারাবছর ধরে ভ্যাকসিনেশন চালু রাখার ওপরও জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশগুলো এ কার্যক্রম সফলভাবে করবে ধরে নিয়েই সংস্থাটি মনে করছে ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসবে। ধনী দেশগুলো টিকা মজুত করছে : বিশ্বের ধনী দেশগুলো কোভিড-১৯ টিকার বেশির ভাগ ডোজ মজুত করছে, যার কারণে দরিদ্র দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষ প্রাণঘাতী নতুন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার ও দাতা সংস্থার একটি জোট। এখনকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭০টি নিম্ন আয়ের দেশ তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজনকে কোভিড-১৯-এর টিকা দিতে পারবে বলে জানিয়েছে পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স। বিশ্বজুড়ে ন্যায্য ও সুষ্ঠুভাবে টিকা সরবরাহে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভ্যাকসিন সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জোট কোভ্যাক্স ৯২টি নিম্ন আয়ের দেশে ৭০ কোটি ডোজ টিকা পাঠানোর চুক্তিও করেছে। কিন্তু এতসব পরিকল্পনার পরও বিশ্বব্যাপী ন্যায্য টিকা বিতরণ সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম, গেøাবাল জাস্টিস নাও-সহ বিভিন্ন সংস্থার নেটওয়ার্ক পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স। যেসব সম্ভাব্য টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে, তার সবই যদি ব্যবহারের অনুমতি পায় তাহলে ধনী দেশগুলো যত টিকার ক্রয়াদেশ দিয়েছে তাতে তাদের মোট জনসংখ্যাকে তিনবার টিকা দেয়া যাবে বলে বলছে ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের হিসাব। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিসেফ ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এয়ারফিনিটির তথ্যমতে, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টিকার অর্ডার পেয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৩২৯ কোটি ডোজের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এ ছাড়া নোভাভ্যাক্স ১৩৮, ফাইজার-বায়োএনটেক ১২৮, জনসন এন্ড জনসন ১২৭, সানোফি/জিএসকে ১২৩, মডার্না ৭৮, কিউরভ্যাক ৪১, স্পুটনিক-ভি ৩৪ কোটি, সিনোভ্যাক ২৬ ও কোভ্যাক্স ১৪ কোটি ডোজের অর্ডার পেয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App