×

জাতীয়

ভুল তদন্তে প্রশ্নবিদ্ধ দুদক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:২৭ এএম

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশন বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান চালানোর সময় ওসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুদক কর্মকর্তারা নানা সুবিধা ভোগ করছেন অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে রেহাই দেয়ার বিনিময়ে সুবিধা নিয়েছেন। যদিও এসব অভিযোগ পুরনো। বর্তমানে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ‘ভুল তদন্তে’র মাধ্যমে নিরপরাধ লোককে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিককালের এ রকম দুটি ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দুটি ঘটনাই দুদক বলছে, ‘সরল বিশ্বাসের’ ভুল। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, দুদকের তদন্ত প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ? কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তা চাইলেই কি তার ইচ্ছেমতো ঘুষের বিনিময়ে কাউকে রেহাই দেয়া কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেবার সুযোগ আছে? আর এসব ঘটনায় মানসিক অশান্তির পাশাপাশি আর্থিকভাবে ভোগান্তির শিকার ভুক্তভোগীদের খেসারত দেবে কে? মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, সংশ্লিষ্ট আইনে থাকা ‘সরল বিশ্বাসে ভুলের’ কথা তুলে ধরে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটিয়ে তদন্তকারীদের অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। সরল বিশ্বাস কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব, এই প্রশ্নও রয়েছে মানবাধিকারকর্মীদের। তবে এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল কিনা, তা খতিয়ে দেখছে দুদক। জাহালম কাণ্ড : ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রথম ঘটনা জনসম্মুখে আসে একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ প্রতিবেদনের মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে জনৈক আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে ভুক্তভোগী জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। অথচ এর ৫ বছর আগে দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে জাহালম বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের কথা সেদিন দুদকের কেউ বিশ্বাস করেনি। এরপর জাহালম গ্রেপ্তার হয়ে বিনাদোষে ৩ বছর জেলও খাটেন। যদিও পরবর্তীতে দুদক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে নিরপরাধ প্রমাণিত হলে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। সে সময় হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছিল, ভুল তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে মর্মে কোনো খবর জানা যায়নি। কামরুল কাণ্ড : এবার নতুন করে প্রতিষ্ঠানটির ভুল তদন্তের শিকার হয়েছেন নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের সহকারী মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। তবে নরসিংদীর পাটকল শ্রমিক জাহালমের মতো কারাগারে যেতে না হলেও ১৫ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘ সময় বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে। অবশেষে গত ২৭ জানুয়ারি প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদনের মাধ্যমে ১৮ বছর আগের মামলায় হওয়া সাজা থেকে রেহাই পেয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়ে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এছাড়া কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে। এদিকে জাহালমের মতো কামরুলের ঘটনায়ও দোষ স্বীকার করে দুদক হাইকোর্টে বলেছে, এটা তাদের ‘সরল বিশ্বাসের’ ভুল। দুটি ঘটনা-ই শুনানির সময় আদালতের মন্তব্য ছিল, সরল বিশ্বাসে আসামি করা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের মনে হচ্ছে, এখানে দুদকের কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল। আদালতের আদেশের পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, গ্রামের নামে ভুলের যে বিষয়টা এসেছে, এটা আমাদের বোনাফাইড মিসটেক। আমরা চাই না, কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি জেল খাটুক। দুদক ‘সরল বিশ্বাসের ভুল’র কথা বললেও নিরপরাধ কামরুলের আইনজীবী মিনহাজুল মামলাটির তদন্ত ও তদন্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার। এসব তদন্তকারী কর্মকর্তারা মামলাটির আদৌ তদন্ত করেছেন কিনা বা তদন্ত করে থাকলেও কতটুকু সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুদকের ভুল তদন্তের কারণে নিরপরাধ কামরুল যতটা ভোগান্তির শিকার হয়েছে, তার চেয়ে বড় ব্যাপার দুদকের মতো একটা বড় সংস্থা এভাবে ভুল তদন্ত করে একজন নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিয়েছে, যা নজিরবিহীন ঘটনা। আদালতের আদেশের পর ভুক্তভোগী কামরুল ইসলাম বলেন, দুদকের ভুলে এমন হয়রানির শিকার আর কেউ যেন না হয়। আমি মানসিকভাবে অনেক কষ্টে ছিলাম। অনেক টাকা পয়সাও খরচ হয়েছে। অপরাধ না করেও সাজার দণ্ড মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যে কত কষ্টের, তা বলে বোঝানো যাবে না। দুদকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে কামরুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতের রায় দেখে আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরে সিদ্ধান্ত নেব। ভুল তদন্তের মাধ্যমে জালিয়াতি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল ও সাজার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবি। বারবার এমন ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুলের কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের পেশাদারিত্ব কতটা দুর্বল ও অদক্ষতায় ভরা, সেটা প্রমাণ হয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ ধরনের ঘটনায় দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানটির ওপর থেকে সাধারণ মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস হারাবে। তিনি বলেন, জাহালমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে আমরা জানতে পারিনি। জাহালমের ঘটনায় যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হলে একদিকে যেমন এ জাতীয় অগ্রহণযোগ্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হতো, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতাও পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। কমিশন প্রতিষ্ঠার আগে যখন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল তখন থেকেই সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সংস্থাটির নাম এবং আইন পরিবর্তন মাধ্যমে কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হলেও সে ছায়া এখনো রয়ে গেছে। কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়া, কিংবা কেউ ঘুষ না দিলে তাকে দুর্নীতির অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার হাতে রয়েছে জানিয়ে ড. জামান বলেন, অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় যে তথ্যটা সংগ্রহ করা হচ্ছে, সে তথ্যগুলোকে কীভাবে তদন্তকারী কর্মকর্তা সাজিয়ে দিচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে দুদক সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত কর্মকর্তারা যেভাবে তদন্ত করে চার্জশিট আদালতে জমা দেন, সেটির ওপর ভিত্তি করে মামলার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কর্মকর্তাদের তদন্তের ওপর ভিত্তি করে কমিশনের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় দেখা যায়, দুর্নীতির শাস্তি হিসেবে হয়তো সাময়িক বরখাস্ত নতুবা বদলি করা হয়। একেবারে চরম পরিস্থিতিতে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ কখনোই দুর্নীতির জন্য যথাযথ শাস্তি হতে পারে না। কমিশনের যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া জরুরি। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল হতে পারে, এ বিষয়টি দুর্নীতি দমন আইনে যুক্ত করা হয়েছে। আর এর সুযোগ নিয়ে একের পর এক নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটলেও তদন্তকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন। অনেকজনকে নামের ভুল, বাবার নামের ভুল বা ঠিকানা মিলে যাওয়ায় আরেকজনকে গ্রেপ্তার করে ওরফে ওরফে দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এই যে আইন পরিবর্তন করে ‘সরল বিশ্বাস’ শব্দটা দিয়ে তদন্তকারীদের রক্ষা করা হয়েছে, এই সরল বিশ্বাসের যথাযথ ব্যাখ্যা করা বা প্রমাণ করা যায় না। এর ফলে আরেকজনও তদন্ত করে বলতে পারে, সরল বিশ্বাসে ভুল হয়েছে। তাহলে তো তদন্তের প্রয়োজন ছিল না। এ বিষয়ে দুদকের একজন কমিশনার বলেছেন, কেউ কখনো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কাজ করতে গেলে ভুল হতে পারে। তবে ভুল ইচ্ছাকৃত কিনা, সেটাই হচ্ছে মূল কথা। প্রতিটি মিসটেক কমিশন খতিয়ে দেখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনাটিও খতিয়ে দেখা হবে। যে এই কাজের জন্য দায়ী হয়েছে, তারা এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। তবে আমরা এটা খতিয়ে দেখব, এই অনিচ্ছাকৃত ভুল আসলে কতটা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আমাদের তদন্তকারীদের পরামর্শ দেব যে, ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল আর না হয়। তারা যেন তদন্তের ক্ষেত্রে আরো যতœবান হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App