×

সাময়িকী

কবি শঙ্খ ঘোষ : স্বপ্নের সারথি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:০৭ পিএম

কবি শঙ্খ ঘোষ : স্বপ্নের সারথি

কবি শঙ্খ ঘোষ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্যে গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।/ একটা দুটো সহজ কথা/ বলব ভাবি চোখের আড়ে/ জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে/ বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।/ কে কাকে ঠিক কেমন দেখে/ বুঝতে পারা শক্ত খুবই/ হা রে আমার বাড়িয়ে বলা/ হা রে আমার জন্ম ভূমি।/ বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/ তোমার সাথে ওতপ্রোত/ নিয়ন আলোয় পণ্য হলো/ যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।/ মুখের কথা একলা হয়ে/ রইলো পড়ে গলির কোণে/ ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে। (মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে \ শঙ্খ ঘোষ) কবি শঙ্খ ঘোষের এ কবিতাটি পড়েই আমি তার কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম; সে অনেক আগের কথা। অবাক হয়ে ভাবি, আজকের বাজার অর্থনীতির যুগেও কবির এ কবিতাটি কতো বেশি প্রাসঙ্গিক! সেই থেকে প্রিয় কবির তালিকায় কবি শঙ্খ ঘোষকে অনুসন্ধান করে চলেছি। কবি তার দীর্ঘ জীবনব্যাপী অসাধারণ সব কবিতা লিখে বারবার চমকে দিয়েছেন আমায়; যিনি তার কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে নিজের পাঠককে বারবার চমকে দেবার সামর্থ্য রাখেন; তেমন কবির শরণাপন্ন না হয়ে উপায় কী? পরিপার্শ্বের ঘৃণ্য আবহে কালাতিপাত করতে গিয়ে কবিচিত্তে যে বেদনা জমে, তা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা উচ্চারণেই কবি যেনো বলেন- মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই মানব শরীর একবার! (মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়); তখন সংবেদনশীল পাঠক মাত্রই কবির চিন্তার সাথে একাত্ম হয়ে যান। শঙ্খ ঘোষের কবিতার সাথে যাদের ঘনিষ্ঠ যোগ, তাদের কেউ কেউ মনে করেন, তিনি দুঃখী সমাজের বন্ধু; সন্দেহ নেই, সেটি তার সামাজিক পরিচয়। আজকের প্রেক্ষাপটে কবি শঙ্খ ঘোষের চারিত্র্য অন্তর্মুখী; কিন্তু একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে কবি দায়মুক্ত নন, তাই তার চিন্তা যে কোনো পাঠক এবং কবিকে নাড়া দেয়। মানবজীবন এবং নশ্বর দেহ নিয়ে কবির নিজস্ব চিন্তার স্বাক্ষর পাইÑ আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলেÑ গোপন রক্ত যা-কিছুটুকু আছে আমার শরীরে, তার সবটুকুতে শস্য যেন ফলে। কঠিন মাটির ছোঁয়া বাতাস পেয়েছি এই সমস্ত দিনÑ নিচে কি তার একটুও নয় ভিজে? ছড়িয়ে দেব দুহাতে তার প্রাণাঞ্জলি বসুন্ধরা, যেটুকু পাই প্রাণের দিশা নিজে।

ক্ষীণায়ু এই জীবন আমার ছিল কেবল আগলে রাখা তোমার কোন কাজেই লাগে নি তাÑ কবর \ শঙ্খ ঘোষ কবির স্বপ্নাকাক্সক্ষা যেনো ঋষি দধীচির মতো; মহান আত্মত্যাগে প্রাণিত করে যেন নিজেকে। সুকান্ত যেমন বলেছেন, ‘পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’; কিন্তু তরুণ কবি সুকান্ত সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ব্রতী ছিলেন, কবি শঙ্খ ঘোষও যেনো পোষণ করেছেন একই মানসিক আকাক্সক্ষা। কিন্তু একজন অন্তর্মুখী কবির সে সাধ্য কোথায়? সাংগঠনিক দক্ষতাই বা কোথায়? সংঘবদ্ধ আন্দোলনে তীব্র ঝাঁপিয়ে পড়ার সামর্থ্যই বা কোথায়? তারপরও মানসিক ও তাত্তি¡ক অবস্থানের কারণে তিনি কিন্তু তার কবিতায় কল্যাণাবেগটির উৎসমুখ উন্মোচন করেন। তার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিরঙ্কুশ-খাঁটি বলেই স্বপ্নাকাক্সক্ষার খিড়কি খুলে দেয়। সততায় উদীপ্ত কবির কণ্ঠস্বরকে তখন অন্তরঙ্গ মনে হয়। তার কবিতায় আত্মোৎসর্গের কথা পড়িÑ

এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম আজ বসন্তের শূন্য হাতÑ ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও আমার সন্তুতি স্বপ্নে থাক (বাবরের প্রার্থনা \ শঙ্খ ঘোষ)

সর্বভারতের একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি এবং সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ। বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞও তিনি। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ, কিন্তু পিতৃদত্ত সে নাম যেনো আজ শঙ্খ ঘোষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ খ্রি. লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। সমাজসচেতন কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিগৃহীত নারী জাতির প্রতি সমাজের অসহিষ্ণুতার কথা উচ্চারিত হতে দেখি গভীর ভালোবাসায়। পুরুষ শাসিত ভারতীয় সমাজে নারীর প্রতি যে নৃশংসতা চলমান তার বিরুদ্ধে সোচ্চার কবির প্রতিবাদ পড়তে আমরা এবার পড়তে চাই নিচের কবিতাটি-

মাতঙ্গিনী হাজরাকে আমরা গুলি করে মেরেছি ধর্মাবতার সত্যি যে, মেরেছি আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়–য়াকে ঘরের বউ ভোগেশ্বরী ফুচননি-কে-

সত্যি যে, দৈবাত আমরা নারীঘাতী, অসহায়ভাবে নারীঘাতী আমরা দৈবাত।

এজলাশ \ শঙ্খ ঘোষ

কবিতার এক আবশ্যিক শৃঙ্খলের নাম ‘ছন্দ’। শৃঙ্খল কখনো চিন্তার মুক্তিকে পেছনে টানে; যতক্ষণ পায়ে শৃঙ্খল, ততক্ষণ মুক্তি দূর পরাহত। কবি কেন শৃঙ্খলাবদ্ধ হবেন? কবিতা তো ছন্দনির্ভর নয়, বরং ছন্দ কবিতানির্ভর। ভাষা-সাহিত্যের যেমন অগ্রযাত্রা আছে, স্বপ্নাকাক্সক্ষার যেমন প্রগতি আছে, চিন্তার মুক্তি যেমন প্রাগ্রসর চিন্তার অত্যাবশ্যক শর্ত; কবিতার ছন্দে প্রাগ্রসর চিন্তার যোগ তেমনি জরুরি অনুষঙ্গকে মান্যতা দিতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু আমাদের কাব্যাঙ্গনে যারা কলাকৈবল্যবাদী হিসেবে পরিচিত, তারা প্রকরণের শৃঙ্খল ভাঙতে সাহসী নন; আর যারা ছন্দের সৌধকে অস্বীকার করতে চান, তারা ছন্দের পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করে ঐতিহ্যের নবায়ন চান। একদল নতুনের আবাহনে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চায়, আর অন্যদল শেকড়ের বন্ধনকে অস্বীকার করে বৃক্ষটিকে উন্মূল করতে চান। একদল বলতে চায়, শুদ্ধতা ছাড়া কোনো পঙ্ক্তিই মহাকালের সীমায় পৌঁছাতে পারবে না; অন্যদল বলতে চায়, যখন পৃথিবীর মানুষ ভিন্নগ্রহে নতুন স্বপ্নের সন্ধানে ব্যস্ত, তখন পশ্চাৎপদ ধ্যান-জ্ঞান-প্রজ্ঞায় যারা আশ্রয় চায়, তা-কে কি মান্যতা দেয়া যায়? কাব্যাঙ্গনে তৃতীয় আরেকটি পক্ষ আছে, যারা ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায়; তারা ছন্দপ্রকরণের কিছুই জানে না, কিন্তু মুখে বলেÑ ‘ছন্দ মানি না!’ এসব দ্ব›েদ্ব নতুন পথের দিশা কে দিতে পারেন? কে হতে পারেন নতুনের পথে আলোর দিশা? কে হবেন সেই সারথি-দিশারী? যিনি একই সাথে নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাবেন; পাশাপাশি পরম্পরাকে ধারণ করে ঐতিহ্যের শেকড়ে জল ঢেলে প্রণয়বৃক্ষটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন?

কবিতার অগ্রযাত্রার কথা ভাবলেই মনে হয়, ‘শ্রেষ্ঠ শব্দের উপযুক্ত বিন্যাসই কবিতা!’Ñএমন সরল সংজ্ঞার পাশাপাশি কবিতার প্রকরণ বিষয়ে জটিলতর সংজ্ঞার সন্ধানও আছে আমাদের কাছে। একজন কবি সরলতম সংজ্ঞা-নির্ভর কবিতা লিখতেই পারেন; কিন্তু যখন কোন কবিকে যাচাইয়ের নিক্তিতে তোলা হবে; তখন কিন্তু কবির উচ্চতা পরিমাপের ভিত্তি হবে তার কবিতায় বিভিন্ন মাত্রার গুণপনা। প্রশ্ন হচ্ছে, গুণপনার পরিমাপক কী? কবির গুণপনার পরিমাপ হবেÑ কবির শব্দ-বৈভব, শব্দ-বিন্যাস, কবিতার গতিময়তা, কবির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কবির আবেগ, পরিমিতিবোধ, কবিতায় দর্শনচিন্তা, প্রকাশ ও আড়ালের সমন্বয়, সমকাল-পরিবেশ-পরিপার্শ্ব-ইতিহাস-ঐতিহ্য-আন্তর্জাতিকতা-প্রকৃতিপাঠে সম্পৃক্ততা, মূল্যবোধ, কবির প্রকরণ-জ্ঞান, ইত্যাদি দিয়ে। প্রকরণ-জ্ঞান অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেবল কবির ছন্দজ্ঞান নয়, বরং কবির কবিতায় শিল্পবোধ, উপস্থাপনশৈলীর নান্দনিকতা, কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-অলঙ্কারের ব্যবহার-কবির রুচিবোধ-সৌন্দর্যচেতনা ইত্যাদিও বিবেচনা করা হবে। এসব কবিতার গুণপনার প্রাথমিক কথা, এসব প্রাথমিক কথার পরও আরো কথা আছে, সেসব কথা আপাত নয়, প্রয়োজনে নিশ্চয়ই বলতে চাইব। পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষের দ্ব›দ্ব এবং তৃতীয় পক্ষের দুর্বৃত্তপনা; যাই বলি; কবিতার সৌন্দর্যচিন্তায় সব বিষয়ে সবার ঐক্য থাকলেও ‘ছন্দপ্রকরণ’ বিষয়ে অনড় দ্ব›দ্ব বিদ্যমান। দুই পক্ষের দ্ব›দ্ব অবসানে কবি শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ গ্রন্থটি যেদিন আমায় আলোর দিশা দিলো, সেদিনই তার সৃষ্টির প্রতি আমি প্রেমাসক্ত হলাম। আমি বিশ্বাস করি একজন কবি যদি তার ‘ছন্দের বারান্দা’ গ্রন্থটিকে আত্মস্থ করতে পারেন, নিশ্চয়ই তিনি নতুন আলোর বাতিঘর পেয়ে যাবেন।

কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতি আমার তৃতীয় এবং চ‚ড়ান্ত প্রেমের সূত্র কবির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি। আমার মতো এক অযোগ্য কবিকে প্রথম সাক্ষাতেই যেদিন বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করলেন, সেদিনই আমি তার প্রতি তৃতীয়বার প্রেমাসক্ত হলাম তার বিশালত্বের মাধুর্যে। ১৯৩২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণকারী কবি শঙ্খ ঘোষ তার ৯০ বছরের জীবনে কাব্যসম্ভারের ঋদ্ধি দিয়ে বাংলা কবিতাকে সম্পদের যে বৈভব দিয়েছেন; যিনি আমাদের অন্ধতার অচলায়তন সরিয়ে নতুন পথের দিশা দিয়েছেন; যিনি অক্ষম কবিকে দিতে পারেন ভালোবাসার নিবিড় আলিঙ্গন; তার প্রতি ৯০তম জন্মদিনে অপার শ্রদ্ধা জানিয়ে তৃপ্তি পেতে চাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App