×

অর্থনীতি

নকশিকাঁথার সফল উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৫১ এএম

নকশিকাঁথার সফল উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম

ছবি: ভোরের কাগজ।

২ হাজারের বেশি নারীর কর্মসংস্থান। রপ্তানিতে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম নির্দেশক পণ্য নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাহারিমা বেগম। তিনি ‘নূর নকশী মহিলা জাগরণ’-এর স্বত্বাধিকারী। পেয়েছেন সফল নারী উদ্যোক্তার সম্মাননা। গত ৩৮ বছর ধরে কাপড়ের ওপর রঙিন সুতার ফোঁড়ে সারাদেশের নকশিকাঁথা শিল্পে সৃষ্টি করেছেন অন্যন্য উদাহরণ। ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৈরি তাহারিমা বেগমের নকশিকাঁথার পরিচিতি ও সুনাম বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নকশিকাঁথার পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবহারের চিন্তা থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বেডশিট, পর্দা ও গৃহসজ্জার উপকরণ তৈরি করছেন তিনি।

এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে সফল করার পাশাপাশি তৈরি করছেন আরো অনেক নতুন উদ্যোক্তা। তাহারিমা বেগমের নকশিকাঁথা শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে গৃহবধূ, বিধবা নারী, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ও শিক্ষার্থীসহ সমাজের অসহায় পিছিয়ে পড়া কয়েক হাজার নারীর।

ইতোমধ্যে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশে নানা সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ইসলামপুর মহল্লার এস এম আব্দুল বাকীর সহধর্মিণী তাহারিমা বেগম। সপ্তম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০১৯ এ নারী ক্যাটাগরিতে বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তাহারিমা বেগম। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল হালিম ও এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন কে এম হাবিব উল্লাহর উপস্থিতিতে দেশসেরা সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তার হাতে ১ লাখ টাকা, ট্রফি ও সার্টিফিকেট তুলে দেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

বর্তমানে তাহারিমা বেগমের অধীনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা, শিবগঞ্জ উপজেলা, নাচোল উপজেলা এবং রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীতে মোট ১৫টি এজেন্টের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজারের অধিক বিভিন্ন বয়সি নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ঘরে বসেই সংসারের পাশাপাশি নূর নকশীর বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন এসব নারীরা। তাদের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে জেলা শহরের ইসলামপুরে নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র নূর নকশীতে বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন এই ১৫ এজেন্ট।

এরপর নূর নকশী হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাহারিমা বেগমের নকশিকাঁথা। নূর নকশীর নকশিকাঁথা, হোম ডেকর, হ্যান্ডিক্রাফট ও নকশি ব্যাগ, নকশিচাদর, কুশন কভারসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য নিয়ে নূর নকশী পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ করে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করে আসছেন তারা। ২০১৮ সালে উড়িষ্যার প্রাদেশিক সরকারের আমন্ত্রণে এসএমই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন তাহারিমা বেগম। তখন থেকেই ভারতের উড়িষ্যায় বাণিজ্যিকভাবে তাহারিমার নকশিকাঁথা রপ্তানি শুরু হয়। মান বিবেচনায় উন্নত ও অন্যন্য হওয়ায় সেখানে চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাহারিমা বেগম বলেন, ১৯৮২ সালে নিজের তৈরি একটি নকশিকাঁথা ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পুরোদমে বাণিজ্যিক চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করি। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছি নকশিকাঁথার বিক্রয় কেন্দ্র ‘নূর নকশী’। স্বামী ও পরিবারের সবার সহযোগিতায় প্রায় ৪ দশকের যাত্রা চলমান রয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়নে সরকারের ভ‚মিকা প্রশংসনীয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, গ্রামের অসহায়, কর্মহীন নারীদের জন্য কিছু করতে পারাটা সব সময় গর্বের। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে ঘরে বসে কাপড় আর রঙিন সুতায় ফোঁড় বুনা সব নারীদের।

জানা গেছে, একেকটি নকশিকাঁথা তৈরিতে রকম ভেদে সময় লাগে ১-৩ মাস পর্যন্ত। দাম ৯০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম মহিলা সংস্থা ও ইফাদসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নকশিকাঁথাবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নকশিকাঁথা তৈরি সময় সাপেক্ষ, তাই স্বল্প সময়ে তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন তিনি। প্রায় শত রকমের নকশিকাঁথা রয়েছে তাহারিমা বেগমের নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রে। বর্তমানে প্রায় সব অভিজাত শ্রেণির বাসার এসি রুমে নকশিকাঁথার দেখা মিলে। তাই অনেকেই নাম দিয়েছেন এসি কাঁথা।

নূর নকশীর এজেন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার চরমোহনপুর এলাকার মো. মোস্তফা বলেন, আমার অধীনে ৩৫০ নারী নকশিকাঁথা তৈরির কাজ করে। তাদের কাপড় ও সুতা সরবরাহ করা হয়। এরপর তৈরি শেষ হলে নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়। এতে এজেন্ট হিসেবে প্রত্যেক কাঁথায় আমার ২০০-৩০০ টাকা লাভ থাকে। এতে বাড়ির মেয়েদের যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে, ঠিক আমিও লাভবান হয়েছি।

জেলা পরিষদের সদস্য ও সাবেক উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শান্তনা হক জানান, তিনি নিজেই নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রের একজন নিয়মিত ক্রেতা। এখানকার নকশিকাঁথা উন্নতমানের ও ডিজাইন খুব সহজেই ক্রেতা আকৃষ্ট করে। তাই ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য উপহার হিসেবে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশিকাঁথা দিতে প্রায়ই এখানে আসতে হয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আজাদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বিসিকের প্রধান কাজ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে বিসিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঋণের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গর্ব নূর নকশীর তাহারিমা বেগম। অনেক সংগ্রাম করে আজ তিনি এ অবস্থানে আসতে পেরেছেন। তার এই সফলতার অংশীদার হতে পেরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিসিক আনন্দিত ও গর্বিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App