×

মুক্তচিন্তা

মধুপুর শালবন রক্ষা আন্দোলন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৮ পিএম

সংরক্ষিত বনভ‚মির ভেতর ৫ হাজার ৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩ হাজার ৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। প্রাকৃতিক বনভ‚মি ‘উদ্ধার ও সুরক্ষার’ ক্ষেত্রে বন বিভাগকে অবশ্যই মধুপুরের মান্দি-কোচ ও নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের ইতিহাস, জীবন-জীবিকা, বনের সঙ্গে প্রথাগত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে।
২০০০ সাল থেকেই শালবনের ৩ হাজার একর কোর এলাকাকে ৬১ হাজার রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হন পীরেন স্নাল। ২০১৬ সালে আবারো অরণখোলা মৌজার ৯,১৪৫.০৭ একর ভ‚মিকে আবারো সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশ বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম। গণমাধ্যম সূত্রে আবারো জানা যাচ্ছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভ‚মি দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছেন এবং ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সবাইকে উচ্ছেদ নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অরণ্য, নদী আর প্রকৃতি ছাড়া আদিবাসী জীবনের কোনো মানে নেই। বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা বনভ‚মির ঐতিহ্যগত সংরক্ষক। অবশ্যই দেশের সব প্রাকৃতিক বনভ‚মি বেদখলমুক্ত হোক। কিন্তু ‘সংরক্ষিত বনভ‚মি’ বা কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বা বনভ‚মি দখলমুক্ত করার নামে বনাঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বসবাসরত আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়। এমনকি এভাবে জোর করে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষাও সম্ভব নয়। কারণ মধুপুর শালবন হলো এখানকার আদি বাসিন্দা মান্দিদের কাছে হা.বিমা ও বলসালব্রিং। এই বনভ‚মি মান্দি-কোচদের আত্মপরিচয়ের অংশ। এখানে ঘুমিয়ে আছে পরিবারের কত আপনজন। এখানে চালা কী বাইদ জমিনে ছড়িয়ে আছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। জাগছে মধুপুর। মান্দি-কোচদের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বাঙালিরাও। কারণ এখন মধুপুর শালবনে বাইরে থেকে আসা নয়া বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরাই সংখ্যায় বেশি। এদের বড় অংশই কোনো বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বা নদীভাঙনে নিজেদের বসত হারিয়ে এই মধুপুরে নানা গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ সমন্বয়ে আবারো ‘সংরক্ষিত বনভ‚মি উদ্ধারের’ বন বিভাগের সাম্প্রতিক এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে আন্দোলন। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি বন বিভাগের সিদ্ধান্তকে প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে ‘মধুপুরগড়ের সংক্ষুব্ধ জনগণ’ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন। স্মারকলিপিতে তারা বন বিভাগ, রাজস্ব এবং স্থানীয় আদিবাসীদের মাধ্যমে মধুপুরের জমির ত্রিদলীয় জরিপের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া মধুপুরে ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যান বাতিল করে আদিবাসীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনা, ১৯৮২ সালের আটিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল, মিথ্যা বন মামলা বাতিল এবং সামাজিক বনায়ন বাতিল করে আদিবাসীদের তত্ত¡াবধানে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় গ্রামবন পদ্ধতি চালুর দাবি জানানো হয়েছে। ২০০৭ সালে দখলকৃত বনভ‚মি ‘উদ্ধারের’ নামে একের পর এক কলাবাগান কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। বন বিভাগ মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড টানায় ‘কলাচাষ পরিবেশ ধ্বংস করে’। যদিও এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক নথি-প্রমাণ বন বিভাগের কাছে আছে কিনা কে জানে? ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পেগামারি গ্রামের বাসন্তী রেমা ও গেটিস যেত্রা পরিবারের ৫০ শতক জমির পাঁচ শতাধিক সবরি কলাগাছ কেটে ফেলে বন বিভাগ। টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদারের নেতৃত্বে ‘বনভ‚মি’ উদ্ধারের নামে এই বিনাশ চলে। কলাবাগান কেটে বন বিভাগের লোকজন সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া চারা লাগাতে চেয়েছিল। জানা যায় এই জমির পাশে বন বিভাগের ২০০৭-০৮ সালের আগর চাষ প্রকল্প ছিল। আগর চাষ ব্যর্থ হয়, এখন বন বিভাগ কাজুবাদাম বাগান করতে যাচ্ছে। বন বিভাগকে মধুপুর শালবনের ঐতিহাসিকতা বোঝা দরকার। এখানকার বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশের সঙ্গে স্থানীয় মান্দি ও কোচ জনগণের ঐতিহাসিক শ্রেণিসম্পর্ক বোঝা দরকার। দুম করে মনে চাইল প্রাকৃতিক শালবন কেটে কখনো রাবার বাগান, কখনো আগ্রাসী গাছের বাগান, কখনো চিড়িয়াখানা কী ইকোপার্ক এসব করা যায় না। অবশ্যই বনভ‚মি জবরদখলমুক্ত করতে হবে। কিন্তু বনের সঙ্গে জড়িত মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস, আখ্যান ও সম্পর্ককে সবার আগে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এই মানুষেরাই এত বছর ধরে বনভ‚মি সুরক্ষা করে আসছেন। হা.বিমা কোনো বাণিজ্যিক জমি নয়, তাই হা.বিমার কোনো দলিল হয় না। দস্তাবেজ হয় না। মানুষের বয়ান, স্মৃতি আর প্রাকৃতিক বিকাশের ভেতরেই এই বনভ‚মির সঙ্গে মানুষের প্রথাগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মালিকানার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বন বিভাগ কি চাইলেই এই সম্পর্ক চুরমার করে দিতে পারে? না পারে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের বহুঘোষণা এই সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে আদিবাসীদের বন সম্পর্ককে বিবেচনা করতে গিয়ে বনভ‚মির সত্যিকার দখলদার প্রভাবশালী করপোরেট কোম্পানিরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সেদিকেই সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে বন বিভাগকে। আর প্রাকৃতিক শালবন খুন করে এলোপাতাড়ি তৈরি হওয়া বৃহৎ স্থাপনা, কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও দখলদারদের দখলবাজির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রাকৃতিক বনভ‚মি ও আদিবাসীদের ভেতর এক গভীর মিল রয়েছে। উভয়ের সংখ্যাই দিনে দিনে কমছে। উভয়েই উন্নয়নের বিপজ্জনক নিশানা। কারণ অরণ্য ও আদিবাসী জীবন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেড ২০১৭ থেকে ২০১৮ মধুপুরের ৪৪টি গ্রামের ১১ হাজার ৪৮ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দেখা যায়, ৪৪টি গ্রামে মান্দি ও বাঙালি মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর ভেতর ৬৪.৬১ শতাংশ বাঙালি এবং মান্দি ৩৫.৩৯ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০ জন এবং এদের প্রায় সবাই ছিলেন মান্দি ও কিছু কোচ জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সালে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের এক সুবিশাল জরিপে দেখা যায়, অরণখোলা, আউশনারা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নে ১২৬টি গ্রামের ভেতর আদিবাসী গ্রাম ৪৯ এবং বাঙালি গ্রাম ৭৭। বন বিভাগ ঘোষিত সংরক্ষিত বনভ‚মির ভেতর আদিবাসীদের ১,৬২৮.২৬ একর চালা এবং ৪৪৭.২৭ একর নামা জমি মিলিয়ে মোট ২,০৭৫.৫৩ একর জমি পড়েছে। সংরক্ষিত বনভ‚মির ভেতর ৫ হাজার ৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩ হাজার ৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে। প্রাকৃতিক বনভ‚মি ‘উদ্ধার ও সুরক্ষার’ ক্ষেত্রে বন বিভাগকে অবশ্যই মধুপুরের মান্দি-কোচ ও নতুন বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের ইতিহাস, জীবন-জীবিকা, বনের সঙ্গে প্রথাগত সম্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে। আমরা কোনোভাবেই চাই না করোনা মহামারিকালে আবার মধুপুরের মাটি লাল হয়ে ওঠুক। পাভেল পার্থ : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App