×

মুক্তচিন্তা

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন দেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০৬ পিএম

বিংশ শতকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সাফল্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বিশাল একটি সাম্রাজ্য সৃষ্টি করা। বিংশ শতকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতাও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়া। ভাঙনের শুরু লিথুয়ানিয়ার বিচ্ছিন্ন হবার দাবি নিয়ে ১৯৯০ সালে হলেও ১৯৯১-এর ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশাল দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কার খুব সূ² বিভাজন রেখাগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ভাঙনের শেষ খেলাটি শুরু হলো ১৯৯১-এর ১৮ আগস্ট বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে। মিখাইল গর্বাচেভ ক্রিমিয়ান রিসোর্টে তার বাংলোতে অবস্থান করছিলেন। মিখাইল তখন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট; এ সময় জানতে পারলেন চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। তারা হচ্ছেন চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি বলডিন, ইউএসএসআর ডিফেন্স কাউন্সিলের ফার্স্ট ডেপুটি চেয়ারম্যান ওলেগ বাকলানভ, সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির সেক্রেটারি ওলেগ শেনিন এবং সোভিয়েত আর্মি গ্রাউন্ড ফোর্স প্রধান জেনারেল ভ্যালেন্টিন ভেরেনিকভ। তাদের সঙ্গে এসেছেন কেজিবির জেনারেল ইউরি প্লেখানভ, তিনি চিফ অব সিকিউরিটি ফর পার্টি অ্যান্ড স্টেট পার্সোনেল। তাদের অপ্রত্যাশিত আগমনে গর্বাচেভ সন্দিহান হয়ে উঠলেন; তিনি যখন ফোন ব্যবহার করতে চাইলেন, দেখলেন ফোন ডেড হয়ে আছে। তারা স্টেট কমিটি ফর দ্য স্টেট অব ইমার্জেন্সি ইন দ্য ইউএসএসআর-এর নামে গর্বাচেভের সামনে একটি দলিল রেখে তা স্বাক্ষর করে জরুরি অবস্থা জারি করতে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনাভি ইয়ানায়েভের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বললেন। তাদের কণ্ঠে আদেশের ন্বর। গর্বাচেভ সই করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং তারা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক ব্ল্যাকমেইলিং করছেন বলে বকাঝকা করলে তারাও অবাক হলেন। তারা ভেবেছিলেন আতঙ্কিত হয়ে তিনি তাদের কথামতো কাজ করবেন। সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ট্রুপসের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল আইগর মালতসেভ প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ এবং তার পরিবারকে গৃহবন্দি করে ফেললেন। পরে গর্বাচেভ ও তার স্ত্রী রাইসা দুজনে বলেছেন, তারা নিশ্চিত ছিলেন তাদের হত্যা করা হবে। যদিও বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল, গর্বাচেভ মস্কোতে একটি বার্তা পাঠাতে পেরেছিলেন যে, তিনি সুস্থ ও সচল আছেন। গর্বাচেভের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দল আগাগোড়া তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে গেছে, প্রেসিডেন্টের বাংলোর চার দেয়ালের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তাকে অবহিত রাখতে ভেতরে একটি রিসিভার রাখার বন্দোবস্ত করতে পেরেছিল। ফলে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সম্প্রচার শুনে অভ্যুত্থানের অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারছিলেন। ১৯ আগস্ট মস্কো সময় ভোর ৬টায় বার্তা সংস্থা তাস এবং রেডিও মস্কো ঘোষণা করল, স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে গর্বাচেভ আর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বলে সোভিয়েত সংবিধানের ১২৭-৭ ধারা অনুযায়ী ইয়ানায়েভ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। আট সদস্যের একটি ইমার্জেন্সি কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন : বাকলানভ, কেজিবির চেয়ারম্যান ভøাদিমির ক্রিউচকভ, প্রধানমন্ত্রী ভেলেন্টিন পাভলভ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস পুগো, কেন্দ্রীয় কৃষক ইউনিয়নের সভাপতি ভ্যাসিলি স্তারোদুরস্তেভ, স্টেট এন্টারপ্রাইজের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার তিজইয়াকভ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল দিমিত্রি ইয়াজভ। তারা দ্রæত ১ নম্বর সিদ্ধান্ত জারি করলেন, তাতে হরতাল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো, গণমাধ্যমের ওপর সেন্সর আরোপ করা হলো। সোভিয়েত জনগণকে এই বলে সতর্ক করা হলো যে, ‘আমাদের পিতৃভূমির ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত’ আসার সম্ভাবনা আছে, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, রাষ্ট্রীয় আদেশ বরখেলাফের পরিণতি খারাপ হবে। । ২০ আগস্ট সই করা নতুন ইউনিয়নে চুক্তি যাতে রাষ্ট্রের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যাবে- এতে অভ্যুত্থানের সময়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১১ আগস্ট ইউএসএসআর ইউনিয়ন চুক্তি নিয়ে সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান আনাতোলি লুকিয়ানভের কঠোর সমালোচনা বার্তা সংস্থা তাস ছড়িয়ে দেয়। সেদিন সকালে মন্ত্রীদের অধিকাংশই অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন জানান। ৯টি ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মস্কোর রাস্তায় ট্যাঙ্ক নেমে আসে, জনগণও রাস্তায় নেমে সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করে। প্রতিবাদকারীরা রুশ পার্লামেন্ট ভবন মস্কোর হোয়াইট হাউসের সামনে জমায়েত হতে থাকে এবং ব্যারিকেড দিতে থাকে। ১২.৫০ মিনিটে বরিস ইয়েলেৎসিন পার্লামেন্ট ভবনের সামনে একটি ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানান এবং হরতাল আহŸান করেন। তারপর তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমান জারি করে জানিয়ে দেন এই অভ্যুত্থান সম্পূর্ণ অবৈধ, ষড়যন্ত্রকারীরা ‘অপরাধী’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। এই ইমার্জেন্সি কমিটির আদেশ রুশরা শুনবে না। বিকাল ৫টায় ইয়ানায়েভ এবং অভ্যুত্থানের অন্য নেতারা সংবাদ সম্মেলন করলেন এবং বললেন, দেশ শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল তবে তিনি আশা করেন তার ‘বন্ধু প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ শেষ পর্যন্ত আবার ক্ষমতাসীন হবেন।’ ইয়ানায়েভ ব্যাখ্যা করলেন প্রেসিডেন্ট ‘অত্যন্ত ক্লান্ত’ এবং ‘দেশের দক্ষিণে তিনি চিকিৎসাধীন’। ইয়ানায়েভ যখন ব্যাখ্যা করছিলেন তাকে বিচলিত মনে হয়েছে, তার হাত কাঁপছিল। ইয়েলেৎসিন রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধান দ্বিতীয় আলেক্সিকে অভ্যুত্থানের নিন্দা জানাতে অনুরোধ করলেন। চার্চপ্রধান গর্বাচেভের আটকের নিন্দা জানালেন এবং যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তাদের অভিসম্পাত দিলেন। চার্চপ্রধানের আহবান অভ্যুত্থানকারীদের অবস্থান দুর্বল করে ফেলল। এর মধ্যে লেনিনগ্রাদে (এখন সেন্ট পিটার্সবার্গ) লেফেটন্যান্ট জেনারেল ভিক্টর স্যামসনভ নিজেকে লেনিনগ্রাদ স্টেট অব ইমার্জেন্সি কমিটির চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন এবং শহরটিকে তার অধীনস্ত সামরিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেলেন। লেনিনগ্রাদের মেয়র আনাতোলি সবচেক কেজিবির সহায়তায় মস্কো থেকে উড়োজাহাজে এসে পৌঁছলেন। কেজিবি সাধারণভাবে এই অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে। সবচেক এসে অভ্যুত্থান বিরোধীদের নিয়ে মিছিল করেন এবং যেসব সেনা কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত তাদের হস্তান্তর করার জন্য সৈনিকদের কাছে আপিল জানান। তিনি জেনারেল ভিক্টর স্যামসনভকে রাজি করাতে সমর্থ হন যে, তার বাহিনী শহরে নামাবেন না। মস্কোর এলিট ট্যাংক রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক সদস্য অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ ত্যাগ করে হোয়াইট হাউসের প্রতিরক্ষায় অবস্থান গ্রহণ করে। ২০ আগস্ট বরিস ইয়েলেৎসিন প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমান জারি করে জানিয়ে দেন তিনি রুশ ভৌগোলিক সীমায় অবস্থিত সামরিক বাহিনী, কেজিবি ও অন্যান্য সব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিøউ বুশ টেলিফোনে ইয়েলেৎসিনকে ফোন করে বলেন, যদি গর্বাচেভ তার দায়িত্বে এ পদে ফিরিয়ে আনা হয় তাহলেই কেবল রাশিয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের নিশ্চয়তা দেবেন। হোয়াইট হাউসের সামনে সৈন্য ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যায়। তিনজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। হোয়াইট হাউসে প্রত্যাশিত আঘাতের পরিকল্পনা সফল হয়নি। তবে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, অভ্যুত্থানের নেতাদের আদেশ পালিত হচ্ছে না। দেরিতে হলেও ২১ আগস্ট ১৯৯১ সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি সেক্রেটারিয়েট গর্বাচেভ ও ইয়ানায়েভকে বৈঠকে বসার নির্দেশ দিল। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো এবং পালাবার সময় পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করা হলো। ইউএসএসআর সুপ্রিম সোভিয়েত গর্বাচেভকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনল, ইমার্জেন্সি কমিটির জারি করা সব ডিক্রি বাতিল করল। ইয়েলেৎসিন ফরমান জারি করলেন রাশিয়ার সব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

অভ্যুত্থানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন বিভিন্ন কারণে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো। সেনাবাহিনী ও কেজিবি হোয়াইট হাউস গুঁড়িয়ে দিতে অস্বীকার করল। গর্বাচেভ অভ্যুত্থানকারীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তারা কী করবে এ নিয়ে তাদের কোনো আপদকালীন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। হোয়াইট হাউসে পৌঁছার আগে ইয়েলৎসিনকে গ্রেপ্তার করতে না পারা তাদের একটি বড় ব্যর্থতা, কারণ তিনি সেখানে থেকেই সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পক্ষে তখন হাজার হাজার মস্কোবাসী রাস্তায় নেমেছে। পরিকল্পনাকারীদের আদেশ মস্কোর পুলিশও মান্য করেনি। অভ্যুত্থানের উদ্যোগ নেয়া আটজনের দল- দ্য গ্যাঙ্গ অব এইট ধারণা করতে পারেনি যে, গণতন্ত্রায়নের ফলে জনমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তারা বিনীতভাবে তাদের আদেশ মাথা পেতে নেবে না। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রায় সবাই ছিলেন রুশ এবং তারা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সকে প্রতিনিধিত্ব করেন। ২২ আগস্ট মিখাইল গর্বাচেভ সপরিবার মস্কো ফিরলেন। অভ্যুত্থানের নেতা পুগো প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলি করলেন, তারপর নিজেকে। স্ত্রী মারাত্মক আহত না হলেও নিজে নিহত হলেন। সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ ও গর্বাচেভের উপদেষ্টা মার্শাল সির্গেই আখ্রোসিয়েভ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন, পার্টির প্রশাসক নিকোলাই ক্রুচিনা আত্মহত্যা করলেন, তারপর আরো কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। তবে চারদিকে রটে গেল এগুলো আত্মহত্যা নয়, প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড। রুশ রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী ইভান সিলায়েভ মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে গর্বাচেভের সহপাঠী আনাতোলি লুকিয়ানভকে অভ্যুত্থানকারীদের প্রধান মন্ত্রণাদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং ২৬ আগস্ট পার্টির সেক্রেটারির পদ ছেড়ে দেন। শিগগিরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বরিস ইয়েলেৎসিন রুশ সেনাবাহিনীর ভেতরের সব পার্টি সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন; পার্লামেন্ট ভবনের সামনে মস্কোবাসীরা বিশাল সমাবেশ করে অভ্যুত্থান প্রতিহত করার উৎসব পালন করল। ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় মস্কো শহরের কেন্দ্রে লুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারের পাটাতন থেকে সোভিয়েত গোপন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স জেরজেনস্কির বিশাল মূর্তির পতন কেজিবি গুরুত্ব হ্রাসের ইঙ্গিত বহন করে। সেই সন্ধ্যায় গর্বাচেভ সংবাদ সম্মেলনে বললেন কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তিনি নিজে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল পদ ছেড়ে দিলেন। ১৯৮৫ সালে গর্বাচেভ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে পুরনো ও নতুনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব থেকেই এই অভ্যুত্থানের সৃষ্টি। তার ‘পেরেস্ক্রোইকা’ এবং ‘গøাসনস্ত’ সংস্কার শুরু হওয়ার পর এই দ্ব›দ্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত গর্বাচেভের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদুয়ার্দ শেভার্নাদজে ১৯৯০ সালে পদত্যাগের সময় মন্তব্য করেছিলেন পার্টির হার্ডলাইনের সদস্যগণ দেশটিকে একনায়ক শাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গর্বাচভের সংস্কার কর্মসূচির প্রধান স্থপতি আলেকজান্ডার ইয়াকভলেভ ৬ আগস্ট ১৯৯১ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করলেন এবং বিবৃতি দিলেন যে, পার্টি নেতৃত্বের ভেতর স্ট্যালিনিস্ট গ্রুপ একটি পার্টি তৈরি করছে এবং রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে। আসলে গোটা গ্রীষ্মকালই আসন্ন অভ্যুত্থানের গুজব সবার কানে পৌঁছেছে। কমিউনিস্ট পার্টির দাপ্তরিক মুখপাত্র সোভিয়েতস্কায়া রোসিয়াতে প্রকাশিত একটি আপিল এই সন্দেহকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। দু’জন ষড়যন্ত্রকারী ভেরেনিকভ এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর সাবেক কমান্ডার জেনারেল বরিস গ্রোমোভ ও আরো আটজন বিবৃতিতে একটি অভ্যুত্থানের এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। এই খোলা চিঠিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গর্বাচেভ ছুটি কাটাতে চলে গেলেন।

টীকা : গ্লাসনস্ত : এই শব্দটি রুশ অভিধানে বরাারই ছিল, তবে ১৯৮০-র দশকে তা বৈশ্বিক শব্দে পরিণত হয়েছে। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ তার সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং কার্যাবলি জনগণ ও বিশে্বর সামনে আরো খোলমেলা করে দিতে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গ্লাসনস্ত শব্দটির সঙ্গে সঙ্গেই অনেকটা জোড় শব্দের এত উচ্চারিত হতে থাকে পেরেস্ত্রোইকা। গর্বাচেভ মনে করতেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সোভিয়েত সমাজতন্ত্র গতিশীল হতে পারে না। সন্তোষ গুপ্ত লিখেছেন : সোভিয়েত ইউনিয়নে আজ যে ‘গ্লাসনস্ত’ বা ‘পেরেস্ত্রোইকা’র কথা বলা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তির বা তাত্তি¡কের মহানুভবতা কিংবা মহত্তে¡র অবদান নয়। দীর্ঘদিনের দুঃখ, মৃত্যু, নির্যাতন, নির্বাসনের দ্বারা চাপা দেয়া শক্তি সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই শক্তি এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। একজন সোভিয়েত লেখককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল গøাসনস্ক বলতে আপনি কী বোঝেন? তিনি দ্বিরুক্তি না করে জবাব দিয়েছিলেন, সত্যকে জানা। পেরেস্ত্রোইকা : রুশ ভাষায় এই শব্দটির মানে পুনর্গঠন। গ্লাসনস্তের সঙ্গেই মিখাইল গর্বাচেভের মুখে শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছে এবং দুটো শব্দই গত শতকের শেষার্ধের অন্যতম আলোচিত শব্দ বলে বিবেচিত হয়েছে। সন্তোষ গুপ্ত লিখেছেন, ‘মানুষের কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে মানুষকে বাদ দিয়ে তত্ত¡কে তার ওপর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানবিকতাকে অস্বীকার করা হয়েছিল। সেই ক্ষতিটা শুধু সমাজতান্ত্রিক বিশে^র অভ্যন্তরে ট্র্যাজেডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার প্রভাব পড়েছে প্রবলভাবে তৃতীয় বিশ্বে এবং এসব দেশে মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে পথের দিশা খুঁজছে উদভ্রান্ত ও অসহিষ্ণু চিন্তাধারা।’ পেরেস্ত্রোইকা হচ্ছে পুনর্গঠনের মাধ্যমে উত্তরণের পথ। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুই শব্দের শক্তি ও প্ররোচনা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে অন্যতম মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App