×

মুক্তচিন্তা

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বৈপরীত্যের সাতকাহন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪৪ পিএম

আমাদের পূর্বপুরুষরা নানা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন অতীত সময়কে বর্তমানের সঙ্গে বিবেচনা করে। ব্রিটিশ আমলের প্রশংসা করতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। আনা-পয়সায় বেচা-কেনার অবিশ্বাস্য হরেক কাহিনী বলে বলে অতীতের সুখ-স্মৃতিকথা বলতেন। অল্প রোজগারে অধিক চাহিদা পূরণ হলেও এখন অতীতের তুলনায় বেশি রোজগার করেও অভাব যেন পিছু ছাড়ে না। ব্রিটিশ আমলে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর স্বল্প মূল্যে ক্রয়ের হরেক কথা। অথচ পাকিস্তানি আমলে তাদের নাকাল হতে হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের আইন-কানুন, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজের নানা চিত্র তুলে ধরতেন পাকিস্তানি আমলের তুলনা বিচারে। শাসনামলের পরিবর্তনে তাদের অপ্রাপ্তির খতিয়ান শুনে ভাবতাম পাকিস্তানি আমলের পরিসমাপ্তিতে নিশ্চয় সুদিন আমরা ফিরে পাব। কেননা যে আকাক্সক্ষায় বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে এবং পাকিস্তানের একাংশ থেকে দ্বিজাতিতত্ত¡ আস্থায় নিয়েছিল। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্র ও সরকারে তাদের অবস্থান শূন্যে নেমে এসেছিল। বিপরীতে সব ক্ষমতা পাঞ্জাবিদের অধীনে চলে যায়। বাঙালি মুসলমানরা আরো পশ্চাৎ অভিমুখে নিজেদের আবিষ্কার করতে বড় বেশি কালক্ষেপণ করেনি।

পাকিস্তান অর্থাৎ দ্বিজাতিত্ত্বের মোহ মুক্তি ঘটেছিল দ্রুতই। পাকিস্তানি রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্ন। ২৩ বছরের পাকিস্তানি আমলের অবসান হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাভ‚ত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দেশবাসীর স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা অপূরণীয় রয়ে যায়। তাই এখনো অনেকে পাকিস্তানি আমলের সঙ্গে বাংলাদেশ আমলের তুলনামূলক বিচার করে হতাশা ব্যক্ত করেন। অতীত আমলের জীবনাচারের সুখ স্মৃতির কথাও বলেন। স্বাধীন দেশে জনগণের স্বাধীনতা-ক্ষমতা প্রাপ্তি ঘটেনি, এটা অতীব সত্য কথা। ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা কতিপয়ের অধীনে এবং নিয়ন্ত্রণে। অবস্থাদৃষ্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দেশের শাসক শ্রেণির প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনের পাকিস্তান কিংবা বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনের বাংলাদেশ কোনোটি এ দেশের মানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি। এটা হতাশাজনক নিশ্চয়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? প্রধানত কারণ বৈষম্য। অনিবার্যরূপে শ্রেণি বৈষম্য। সব নাগরিকের অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে চরম বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা টিকে থাকা এবং ক্রমেই শক্তিশালী হওয়া। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশ কোনো আমলেই মানুষে মানুষে শ্রেণি বৈষম্য কমেনি বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জাতির যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই ঐক্য আর থাকেনি। বিশেষ শ্রেণি, সংখ্যায় যারা ক্ষুদ্র অংশ তারা ধনী হওয়ার সুযোগে ধনী হয়েছে। গরিব আরো গরিব হওয়ার পথে নেমেছে। সামাজিক এই শ্রেণি বৈষম্য তীব্র হয়ে পড়েছে বলেই অতি সহজে পরিবারে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। ভাই-বোন হতে নিকট আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যকার সম্পর্ক থাকা-না থাকাও নির্ধারিত হয়ে পড়েছে শ্রেণিগত অবস্থানের ভিত্তিতে। আমাদের শ্রেণি বিভক্ত সমাজে মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওই শ্রেণি বৈষম্যের কারণেই। শ্রেণি বৈষম্যের অবসানেই সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা পূরণ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সেটা সম্ভব হবে বলে অনুমান করতে পারি না।

পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসনামলের প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ, ইতিহাস-গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছেও। কিন্তু পাকিস্তানি আমলের প্রায় দ্বিগুণ সময়ের বাংলাদেশ আমলের বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে কি? না, হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের দুরবস্থার বিচার, বিশ্লেষণ-গবেষণা আমরা সঠিক অর্থে করতে পারিনি। কেবল স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বস্তির ঢেঁকুর তুলেছি। অনুসন্ধান করে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পারিনি। যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতির পাশে দাঁড়িয়ে জাতিকে মুক্তির দিশা দিয়ে নতুন দিনের পথ নির্দেশনা দেবেন; তাদের সংখ্যা কমে কমে এখন আঙুল দিয়ে গোনা যাবে। অন্যরা অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠরা দলীয় বৃত্তে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন পার্থিব লোভ-লালসায়। আর রাজনীতিকরা? তারা তো নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে রাজনীতি নামক পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন। রাজনীতি এখন পেশা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যারা প্রকৃত অর্থে জনগণের ভাগ্য ফেরাতে চান, বদলাতে চান সমাজ ও রাষ্ট্র, তারা পরস্পর অনৈক্য-বিভাজনে এতটাই বিভক্ত যে, তারা হয়ে পড়েছেন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের ঐক্যই একমাত্র আলোর দিশা। কেননা তাদের পক্ষেই কেবল সম্ভব নিজেদের ঐক্যের পাশাপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলে শাসকশ্রেণিকে পরাভূত করে জনগণের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা ও মুক্তি নিশ্চিত করা। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে দিয়ে বোকায় পরিণত করে গত ৫০ বছর যারা শাসকরূপে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন এবং আছেন, তারা কেউ জনগণের প্রকৃত বন্ধু নন। নির্ভেজালরূপে শোষক। তারা তাদের শ্রেণির সীমার বাইরে একচুলও অগ্রসর হবেন তেমন প্রত্যাশা হাস্যকর এবং অবান্তরও বটে।

আমরা অতীত আমলের সুখ্যাতি বর্ণনা করি কেন? নিশ্চয় অপ্রাপ্তির হতাশায়। বর্তমান আমলের তুলনা বিচার করে অতীত আমলের সুখ-শান্তির স্মৃতি রোমন্থন করি এই কারণে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাভ‚ত করে বিজয় অর্জন করেও সামষ্টিক আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। সেই ব্যর্থতার আড়ালে অতীত রোমন্থনে বর্তমানকে ভুলতে চাই। কিন্তু বর্তমানই দৃশ্যমান বাস্তবতা। একে এড়ানোর উপায় নেই এবং অসম্ভবও। আমাদের সামষ্টিক স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা এবং সর্বোপরি বৈষম্য নিরসনের একমাত্র উপায় বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং শাসকশ্রেণিকে পরাভ‚ত করা। এদের পরাভূত না করা অবধি বছর ঘুরে বছর আসবে-যাবে, আমাদের জীবনের আয়ুষ্কাল খসে পড়বে কিন্তু আমাদের কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেজন্য জনগণের অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি জনগণের ঐক্য ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই। জনগণের ঐক্যেই অতীতের সব জাতীয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছে। আগামীতেও অনুরূপ ঐক্যে সমষ্টিগত মানুষের বিজয় অর্জন সম্ভব বলেই মান্য করি।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App