×

পুরনো খবর

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের করণীয়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪৯ পিএম

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যা কিছু মানুষের অবদান, তার বহুলাংশ এসেছে শিক্ষকদের হাত ধরে। শিক্ষকরাই যুগে যুগে মানব সভ্যতার বিকাশে মানুষকে এবং সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। সময়, সমাজ ও সভ্যতার প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজ শিক্ষকদের জন্য সে রকম একটা সময় এসে হাজির হয়েছে। এ রকম ক্রান্তিকালে আমরা শিক্ষকরা কী দায়িত্ব পালন করেছি, সেটাই অনাগত আগামীর ইতিহাসে শিক্ষকদের জায়গা নির্ধারণ করে দেবে।

সমাজে বিদ্যমান ডিসকোর্সগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে শিক্ষা জাতির সেবায় কতটুকু নিয়োজিত তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষা কী জিনিস সেটা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক এবং আলাপ-সংলাপ হতে পারে, কেননা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা-কাঠামোর বাইরেও মানুষ স্বজাত জ্ঞানে এবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কথা আমরা জানি। আবার বংশপরম্পরায় কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই কোনো কোনো মানুষ বেশ জ্ঞানী এবং শিক্ষিত হতে পারে। লালন কিংবা আরজ আলী মাতুব্বরের কথা আমরা জানি। সবকিছুকে বিবেচনায় নিলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব সমাজে অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। সত্যিকার শিক্ষাই সমাজকে আলোর মুখ দেখাতে পারে। একজন মানুষকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সঠিক এবং সত্যিকার শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এবং সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। হয়তো তাই শিক্ষাকে একটি ‘জাতির মেরুদণ্ড’ বলা হয়। তা ছাড়া আজকের প্রজন্মকে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই তৈরি করে আগামীদিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-মোক্তার, শিক্ষক, জর্জ-ব্যারিস্টার, ব্যাংকারসহ সব পেশাজীবী শ্রেণি, যারা ভবিষ্যতে জাতিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। তাই শিক্ষাকে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও তার অন্যথা নয়। সরকার শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে রীতিমতো ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্নভাবে নারী শিক্ষাকে অবৈতনিক করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও শিক্ষার আলোতে আনার নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। পাঁচটি আদিবাসী জাতির আদিবাসী ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের যে অধিকার এবং অঙ্গীকার সেটার বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্নভাবে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের একটি ব্যবস্থা শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে জারি আছে। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে নানা অসন্তুষ্টি থাকলেও শিক্ষা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং রাষ্ট্রীয় প্রায়োরিটির একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাজুড়ে আছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই করোনা ভাইরাসের মহামারিকালে যেসব সেক্টর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম এবং প্রধানতম খাত হচ্ছে শিক্ষা খাত। যদিও করোনা ভাইরাসের এ মহামারিতে শিক্ষা খাতের এ অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায়, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার একটা ব্যবস্থা শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা সনাতন শিক্ষার যে গুণগতমান এবং আউটকাম একেবারেই তার সমান ও সমান্তরাল নয় বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির পর খুলে দেয়া যায় কিনা, তা নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা, সেটাকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এবং সেটাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা সত্যিকার একটা বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। সবকিছু সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে কেবল সরকারের সমালোচনা করার মধ্য দিয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং একে নিয়মিতভাবে সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের একটা বড় ভ‚মিকা এখানে পালন করতে হবে। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক মানুষের একত্রে জড়ো হওয়ার একটা অন্যতম স্থান। ফলে সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরছে কিনা, নিয়মিতভাবে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, জ্বর মাপার যন্ত্র দিয়ে জ্বর ঠিকমতো মাপা হচ্ছে কিনা, একটা নির্দিষ্ট টেম্পেরেচারের উপরে গেলে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে কিনা এবং শ্রেণিক্ষকসহ স্কুলকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে কিনা এসব কিছু দেখার ও ব্যবস্থা করার দায় এবং দায়িত্ব শিক্ষকদেরই নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানছে কিনা সেটা দেখা সরকারের পক্ষে প্রায়োগিকভাবেই অসম্ভব এবং সেটা প্রত্যাশা করাটাও অবাস্তব। তাই জাতির এ ক্লান্তিলগ্নে এ মহামারির প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে শিক্ষকদের একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য ব্রতী হয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অত্যন্ত দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল এবং অভিভাবকসুলভ ভ‚মিকা পালন করতে হবে। কেননা প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মানার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিণত নাও হতে পারে। শিশুসুলভ আচরণ এবং কৈশোরের উদ্দীপনা বড় বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। যেহেতু করোনা ভাইরাস একটা বড় মাত্রার সংক্রামক রোগ, সেহেতু কোনো স্কুলে একজন/দুজন শিক্ষার্থী কোনোভাবে আক্রান্ত হলে সেখানে শত শত শিক্ষার্থীর সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাই প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিতা-মাতার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীদের নিজে সন্তান-সন্ততির মতো করে আগলে রেখে মহামারি থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। অতএব এ চ্যালেঞ্জকে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিতে হবে এবং যুগের চাহিদাকে ধারণ করে শিক্ষকতার যে মহান পেশা তা প্রমাণের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তার যোগ্য এবং যথাযথ প্রমাণ দিয়ে জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করতে হবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সচেতন এবং পরিণত হওয়ায় তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার একটা মনোভাব থাকবে, সেটা আশা করা যায়। তথাপি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের সমান গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় জাতিকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এখানে বলা বাহুল্য যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আর যেসব দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে, সেখানে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই মূলত স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এবং যথাযথ দায়িত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষা কার্যক্রম এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা যায় না। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পঠন-পাঠনের ক্ষতি খানিকটা পুষিয়ে নেয়া যাবে বটে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয় তো শুধু পাঠশালা নয়, সেটা মনোজগতের সুষ্ঠু এবং সুস্থ বিকাশেরও একটা অর্থবহ পরিসর। বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নানা ডায়ালগ এবং বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণ ঘটে, মনোজগৎ তৈরি হয়, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে এবং মানুষ-জীবন-জগৎকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটা যথার্থই। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের চার আনা দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, আট আনা দায়িত্ব শিক্ষকের এবং বাকি চার আনা দায়িত্ব সরকারের যারা মনিটরিংয়ের কাজ করবে। অর্থাৎ ষোলো আনার মধ্যে কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের যেখানে যৌথভাবে আট আনা সেখানে শিক্ষকের ভ‚মিকা একাই আট আনা বলে আমি মনে করি। আনার হেরফের বিদ্যালয়ের স্তর ভেদে কমবেশি হতে পারে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার দায়িত্ব শিক্ষকদেরই নিতে হবে। সেই সক্রেটিস থেকে শুরু করে আজকে দিনের একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের অবদানকেও বিবেচনায় নিলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যা কিছু মানুষের অবদান, তার বহুলাংশ এসেছে শিক্ষকদের হাত ধরে। শিক্ষকরাই যুগে যুগে মানব সভ্যতার বিকাশে মানুষকে এবং সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। সময়, সমাজ ও সভ্যতার প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজ শিক্ষকদের জন্য সে রকম একটা সময় এসে হাজির হয়েছে। এ রকম ক্রান্তিকালে আমরা শিক্ষকরা কী দায়িত্ব পালন করেছি, সেটাই অনাগত আগামীর ইতিহাসে শিক্ষকদের জায়গা নির্ধারণ করে দেবে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল : [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App