×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৩১ পিএম

পারমিতার জগৎ

আমরা দু’জন কিছুই বুঝিনি, পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরাও বেরিয়ে আসলাম স্টেশন থেকে। বাইরে থেকে রিক্সা নিয়ে আমরা বকুলতলার দিকে রওনা হলাম। আমার মনে সুমনের সেই মুখটা ভেসে উঠলো, যেদিন সুমন আমাকে চিঠিটা দিয়ে বলেছিলো, “আগামীকাল এর জবাব চাই ইন্দ্রাণী।” জামালপুর শহর-স্টেশন রোড-নিরালা-কথাকলি-এন্তেজার সিনেমা হল-বকুলতলা-আশেক মহমুদ কলেজ আমায় দেখে উচ্ছ¡সিত হবে তেমন প্রত্যাশা আমার নেই; কিন্তু আমার বাড়ি? যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি? যাদের স্নেহে-আদরে-ভালোবাসায় আমি বড় হয়েছি তাদের বুকেও কোন উচ্ছ্বাস থাকবে না! তেমনটি মানা কঠিন। বাসায় যখন পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছাড়িয়ে গেছে। এখানেও আমার বিস্ময়। মনে হচ্ছে যেনো, এ বাড়ি আমার নয়; আমি যেনো এ বাড়ির কেউ নই। অন্য যে কোন সময় বাড়ি ফিরলে সবাই যেমন সাদর অভ্যর্থনা করতো, বুকে জড়িয়ে ধরতো, আজ তার কিছুই হলো না। রাতে খেতে বসে সামান্য দু’চারটি কথা হলো আব্বা-মা’র সাথে। কী এক অস্বস্তি আমায় ঘিরে ধরেছিলো। সবার আচরণে আমার নিজেকেই অপরাধি মনে হচ্ছিলো। আমি খুব আবেগপ্রবণ, মুডি মেয়ে, সবাই জানতো; হয়তো তাই কেউ সাহস করে আমায় কিছু বলতে সাহস করছিলো না। আমি নিজে থেকেও কাউকে কিছু বলছিলাম না। অপেক্ষা করছিলাম, দেখি কে কী বলে। না কেউ আমাকে তেমন কিছু বললোই না। ছোট ভাই দীপ্ত ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ বসে কথা বলে গেলো। মা একবার আমার ঘরে এসে উঁকি দিয়ে বললেন, “জার্নি করে এসেছিস মা, নিশ্চয়ই তুই ক্লান্ত। রাত জাগবার প্রয়োজন নেই, শুয়ে পড়।” চলে গেলেন মা নিজের ঘরে। আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুতেই ঘুম আসছে না। রাজ্যের কথা মাথায় ঘুরছে। কখনো বন্ধুদের কথা, জ্যোৎস্নার মুখটা হঠাৎ মনে পড়লো, “কোথায় আছে জ্যোৎস্না? ওর কী বিয়ে হয়ে গেছে? সকালে দীপ্তকে খোঁজ নিতে বলেছি ওর বাসায়। জ্যোৎস্না কি জানে পাথালিয়ার সুমনের কোন খোঁজ?” আজ ট্রেন থেকে নামার পর সুমনের আচরণ আমার কাছে বিসদৃশ আর ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঠেকেছিলো, কেনো সে ভাইয়ার সাথে ওভাবে কথা বলছিলো? সুমন কি আমাকে তার টাকার গরম দেখাচ্ছিলো? না-কি ভাইয়াকে? হঠাৎ করে সে এতো বিত্তের মালিক-ই বা হলো কী করে? ইলেক্ট্রিক শ্রমিক থেকে ইলেক্ট্রনিক শপ-এর মালিক! আমার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ সবুজ ঢুকে যায় সন্তর্পণে। : পারমিতা, কী সব ভাবছো তুমি? তোমায় কি এ সব ভাবনা মানায়? : সবুজ! কোথায় তুমি? কী করছো এখন? : ধ্যানমগ্ন আছি প্রার্থনায়- মেঘদূত নেই কেউ যে আমার নিঃশর্ত বশ্যতা মান্য করে যে আমার বেদনার চিঠি পৌঁছে দেয় প্রত্যুষের করে, তবু মেঘেদের কাছে কিছু দীর্ঘশ্বাস জমা রাখি নিজস্ব খাবার ভেবে খায় সে সব স্বার্থান্ধ কতিপয় পাখি; তবুও সঞ্চিত কথা স্বজন মেঘের কাছে দিই প্রতিদিন মেঘেরা বৃষ্টিতে বিষাদ পাঠিয়ে শোধ চায় ঋণ। মায়াপুরীর বিবরে বন্দী প্রিয় মুহূর্তের হাসি স্বর্ণশৃঙ্খলের সাথে অবহেলা ভাগ্যে যার জোটে রাশি রাশি। সুনীতির প্রতিপক্ষ প্রশাসন, সামাজিক অনাচার টুটি টিপে ধরে সাগর-সঙ্গমে অনুপম ঝড়-জল ভেঙে পৌঁছায় কী করে! যদি বায়ু-কোণে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, ঈষাণ-কোণের বায়ু আমি আমার তৃষ্ণার তাপে পুড়ে যাবে অকল্যাণ জানে অন্তর্যামী! অভিশপ্ত বলে স্বর্গ আমায় দিয়েছে দ্বীপান্তর সিংহল পাহাড়ে কাঁদি স্বর্গালিন্দে শুনি মৃত্তিকার মায়াস্বর; ধনতন্ত্রের অস্থির পৃথিবীতে নেই উৎসবের আদি-অন্ত নির্বিরোধ কবির বরাদ্দ থাকে নগ্ন আদিগন্ত। : কোন্ স্বার্থান্ধ পাখিরা তোমার সঞ্চিত কথামালা খেয়ে যায়? : যে কেউ খেয়ে যেতে পারে। নিবেদিত পঙক্তিমালা যখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে, তখন সবাই সুযোগ পেয়ে যায়। : আমি তো ইচ্ছায় ফেলে আসিনি তোমায়, আমাকে জোর করে আনা হয়েছে এখানে। : আমি তোমার পথচেয়ে আছি। অপেক্ষার রঙ ক্রমশ ধূসর হয়ে যায়। পিপাসার্ত বুক শুকিয়ে চৌচির হলেই তো সুযোগসন্ধানীরা জল হয়ে জল ছুঁতে চায়! : না! তোমার পাশে আমি কারো উপস্থিতি সইতে পারবো না! তুমি শুধুই আমার! : কে বললো, আমি অন্য কারো? পৃথিবীতে আমি তোমাকে ভালোবাসতেই জন্ম নিয়েছি; পূর্বজন্মে যেমন আমি তোমার ছিলাম, আগামী জন্মেও আমি তোমার খোঁজেই আসবো পৃথিবীতে আবার। : তাহলে কেনো এতো দূরে সরে আছো? : দূরে সরে আছি কোথায়, কাছে আসতেই তো তড়পাচ্ছি; কেবল দু-হাত বাড়িয়ে তোমার জড়িয়ে নেবার অপেক্ষা। আমি দু’হাত প্রসারিত করলাম, সবুজ আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুহূর্তে দু’জন দু’জনের সাথে মিশে গেলাম। দু’জনের বুকে দু’জন কতক্ষণ জেগে থাকলাম, কখন ঘুমালাম কিছুই আমার মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে জাগতে আমার কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেল। কী এক একান্ত সুখ, কী এক গোপন বেদনা আমায় আচ্ছন্ন করে আছে। হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেতে গিয়ে লক্ষ করলাম বাসায় সবার আচরণে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন। আজ সবাই স্বাভাবিক, যেনো আমি কোন ভুল করিনি, যেনো গতকাল কেউ আমার সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করেনি; যেনো গতকাল কেউ মৌনতার চাবুকে আমায় প্রহার করেনি। মা আমায় মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, “এতোদিন পর বাড়ি এলি, বাড়ির বিছানায় ঘুম হলো?” আমি কিছুটা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে সহজ হয়ে বললাম, “নিজের বাড়ির সুখ পৃথিবীর কোথাও কি আছে মা? আমাদের দিঘির পশ্চিমে নলখাগড়ার ঝোপটাকেই আমার পৃথিবীর গভীরতম অরণ্য মনে হয়।” আমার কথায় আব্বা প্রাণ খুলে হাসলেন, অতঃপর বললেন, “ঢোলকলমির ঝোপটাকে তাহলে কী মনে হয়? আর বাঁশঝাড়-আড়াটাকে?” ভাইয়া যোগ করলো, “বাঁশঝাড়টা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন আর ঢোলকলমির ঝোপটা মধুপুরের শাল-গজারির বন।” সশব্দে হেসে ওঠে ভাইয়া, বাকি সবাই যোগ দেয় ওর হাসির সাথে। মা হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টান, “শোন পারমিতা, একটা জরুরি কথা বলার আছে; আগামী পরশু আমরা একটা মেয়ে দেখতে যাবো।” আমি কিছুটা অবাক হলাম, “মেয়ে দেখতে যাবো মানে?” মা-ই উত্তর দিলেন, “তোর ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে যাবো।” মৃদু হেসে বললাম, “ভাইয়ার হঠাৎ এ দুর্মতি!” আব্বা বললেন, “দুর্মতি কেন হবে? বয়স হচ্ছে না? তাছাড়া আমাদেরও ইচ্ছা বাড়িতে একজন বৌ আসুক। বয়স বাড়ছে, কবে আছি কবে নেই...!” আব্বাকে কথা শেষ করতে দিলাম না আমি, “এসব কী ধরনের কথা আব্বা! কী হয়েছে তোমার?” “কিছু হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ, আচ্ছা বাদ দে ওসব কথা, তোর পড়ালেখা চলছে কেমন? ক্লাস ঠিকঠাক হয় তো?” বুঝলাম আব্বা কথা ঘোরাতে চাইছেন। আমি সুযোগ পেয়ে অভিমানমাখা কণ্ঠে বললাম, “এখন পুরোদমে ক্লাস চলছে, এসময় আমার ছুটি না নিয়ে এভাবে হঠাৎ চলে আসাটা ঠিক হয়নি কিছুতেই।” মা বললেন, “দু’দিনেরই তো ব্যাপার। তাছাড়া তুই ছাড়া কি খোকার জন্য মেয়ে পছন্দ করা যাবে?” নাস্তার টেবিলের এসব কথায় আমি সহজ হলাম বটে, কিন্তু ভেতরে একটা কাঁটা বিঁধে রইলো। “সবুজের প্রসঙ্গটি একটি বারের জন্যেও কেউ বললো না কেন?” দীপ্ত এতক্ষণ কোন কথাই বলেনি চুপচাপ নাস্তা খাচ্ছিলো, এবার ও কথা বললো, “ছোট’পা, সকালে আমি জ্যোৎস্নাদির বাসায় গিয়েছিলাম, দু’দিন আগেই জ্যোৎস্নাদি বাপের বাড়ি এসেছে; তোমার খবর শুনেই বললো, আসবে কিছুক্ষণ পর।” দীপ্তর কথায় আমার মাথায় নতুন চিন্তা যুক্ত হলো। হৈ-হৈ করে জ্যোৎস্না বাসায় ঢুকলো। খুব সুন্দর লাগছে ওকে শাঁখা-সিঁদুরে। কেমন যেনো শরৎচন্দ্রের গ্রামীণ নারী চরিত্রের মতো। কিন্তু ওর এ হৈ-হৈ স্বভাবটা আমার চোখে একেবারেই নতুন। মনে হয় বিয়ের পর ওর মধ্যে সবার সাথে সহজ হয়ে উঠবার একটা প্রবণতা বিকশিত হয়েছে; ওর মধ্যে যে স্বভাবসুলভ একটা লাজনস্রতা ছিলো, সেটা যেনো কোথাও উধাও হয়ে গেছে। মা’র সাথে সামান্য কয়েক মুহূর্ত কথা বলেই আমার রুমে ঢুকলো জ্যোৎস্না; ঢুকেই আমায় জড়িয়ে ধরে দু’গালে দু’টো চুমু খেলো। ওর চুম্বন আর জড়িয়ে ধরাটাও অপরিচিত আমার কাছে। জ্যোৎস্নার প্রতিটি স্পর্শে আমি কামানুভবস্পৃহা টের পেলাম। ওর স্পর্শশক্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি ওর বুকের কোমলতাও বেড়েছে যেনো। পলক ফেলবার আগে জ্যোৎস্না আমায় টেনে নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখেও একটু সরে গিয়ে বললাম, “কী-রে তোর হলো কী? অস্থির লাগছে? তোর বর আসেনি সাথে?” জ্যোৎস্নার চোখের ভাষায় আমন্ত্রণ; “না গো সই আসে নাই। অপেক্ষা বড়ই যন্ত্রণার।” আমি একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, “দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে না। স্থির হয়ে একটু বোস। কতদিন পর দেখা হলো, আগে বোস তোকে প্রাণভরে দেখি।” জ্যোৎস্না তড়িৎ উঠে বসলো এবং বসেই পাদু’টি দোলাতে লাগলো। বিয়ের পর ওর মধ্যে যেনো অস্থিরতার বাও লেগেছে, “কী-রে জ্যোৎস্না তুই কি একদণ্ড শান্ত হয়ে বসতে পারিস না? এতো ছটফট করছিস কেনো?” আমার কথায় জ্যোৎস্না সশব্দে হাসলো, হাসতে হাসতে একটু দম নিয়ে বললো, “এইডা অইলো তরে কবার চাই মুক্তির ছটফডানি। শিশুকাল থনে খালি থুম ধইরাই আছিলাম। পান থনে চুন খসলেই দুইলাইন কতা হুনন লাগতো। অহন তাই মুক্তির স্বাদ লই।” জ্যোৎস্নার ছটফটানিতে আমিই অস্বস্তিবোধ করছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ওর কাছে সুমনের কথাটা তুলবো। হঠাৎ জ্যোৎস্না যেনো একটু গম্ভীর হয়ে নড়েচড়ে বসলো, “ক সই তর পড়ালেখার খবর শুনি! ডাক্তার হইতি কদ্দিন লাগবো তর?” : নিয়মে তো দুই বচ্ছরই লাগবার কথা, মনে হয় তিন বচ্ছরও লাইগা যাইতে পারে; তারচেয়েও বড় কথা, আমি নিজে এখনো জানি না, আমার এ জীবনে ডাক্তার হওয়া হবে কি-না? : ও-মা! ইসব কী-কথা? সমস্যা কী? বাধা কুনুকা? : সেখানেই তো সমস্যা। বাধাটা যে কোথায় তা নিয়েই তো সংকট। কত ধরনের আছর যে পড়ে মানুষের জীবনে বুঝে ওঠাই কঠিন। : তা তো ঠিক। কিন্তুক তর হইলো কী? : ওঝা ধরতে হবে। আচ্ছা রে সই, তর ঐ পুলাডার কথা মনে আছে? : কুন পুলা? কার কতা কছ? জ্যোৎস্নার কণ্ঠে হঠাৎ কৌতুহল ফুটে ওঠে। আমি বিষয়টিকে হালকা করতে কিছুটা অবহেলার সাথে বললাম- : পাথালিয়ার ছেলেটা, কী যেনো নাম? হ্যাঁ, সুমন; আমাকে একবার একটা চিঠি দিয়েছিলো মনে নেই? : ওরে সর্বনাশ! সে তো ম্যালা টেকার মালিক! এখন বিরাট ব্যবসায়ী। কিছুদিন আগে বিয়া করছে শুনছি। আতাআতি কী যে চেরাগ পাইলো ভগবানই জানে! বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর কেমনে জানি সেনাবাহিনীর লগে খাতির জমাইয়া ফাললো। হের পর জিয়াউর অহমানের পাট্টির নেতা অইলো; অহন তো শহরের বড়লুকগর একজন সে! : বলিস কী! : হ! দুতলা বাড়ি বানাইছে। ফ্রিজ-টিভির বিরাট দুকান দিছে ইস্টিশনের কাছে। দুকানের নাম দিছে, ‘ইন্দ্রাণী ইলেক্ট্রনিক্স’! : দোকানটা চিনিস তুই? : চিনমু না ক্যা! অতবড় দুকান জামালপুর শহরে একটাই। বেবাকেই চিনে! : চল তো যাই, দোকানটা একবার দেখে আসি। আমাদের বাসার জন্য একটা ফ্রিজ কিনতে হবে, যদি দাম-দর ঠিক থাকে তাহলে ময়মনসিংহ থেকে কেনার কী প্রয়োজন? ওখান থেকে আনার ঝামেলাও তো কম না। : তা ঠিক। তাছাড়া তুই কিনলে কওয়া যায় না বিনা লাভেও দিয়া দিতে পারে। চল যাই খুঁজ নিয়া আসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে।

ইন্দ্রাণী ইলেক্ট্রনিক্স। বেশ বড়সড় পরিপাটি দোকান। আমরা দু’জন দোকানটা ঘুরে দেখলাম। একটা ছেলে কাছে এসে প্রশ্ন করলো, “কী লাগবো ম্যাডাম?” আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, “সুমন সাহেব নেই?” ছেলেটা চটপটে কণ্ঠে উত্তর দিলো, “স্যার তো তার অফিসে।” আমি এক পলক ভাবলাম, “অফিসটা কোথায় তার?” ছেলেটা আগ্রহের সাথে বললো, “এই তো এখানেই ম্যাডাম। দোতলায় চলুন?” ছেলেটা এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে, আমরা ওর পিছু নিলাম। দোতলায় সুমনের ওয়েল ডেকোরেটেড অফিস। ছেলেটাই আগে ঢুকলো, আবার বেরিয়ে আমাদের নিয়ে গেল। সুমনের অফিস দেখে আমি যুগপৎ বিস্মিত এবং চিন্তিত হলাম। ‘এতো স্বল্প সময়ে এতো পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?’ সুমন দাঁড়িয়ে আমায় অভ্যর্থনা জানালো। “আমি জানতাম আপনি আসবেন, আজ না হয় দু’দিন পর। কিছু মনে করবেন না। আমি কিছুতেই আপনার সম্মানহানি করতে চাই না। লক্ষ করুন আমি কিন্তু আপনাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে ডাকিনি। আমাকে একদিন আপনি এবং আপনার ভাই সম্মান দিতে চাননি, সেদিন আমি একজন সামান্য মেকানিক ছিলাম, আজ কিন্তু তা নই, আজ আমি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শুধু ব্যবসায়ীই নই, আমি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমার উত্থানের নেপথ্য কী হতে পারে? না আমি কোন আলাদিনের চেরাগ পাইনি; কিন্তু একজন গার্জেন পেয়েছিলাম।” সুমন তার কথা থামালো। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কেনো সুমন তার এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছে? এখন আমার মনে হচ্ছে, ঝোকের মাথায় এখানে চলে আসাও ঠিক হয়নি। মনে মনে নিজেকে ধিক্বার দিলাম, “কেনো যে বারবার আমি ঝোকের মাথায় উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলি!” নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললাম, “দেখুন সুমন সাহেব, আমার মনে হয় না আমাকে আপনার জীবনের উত্থানপর্বের কাহিনি শুনিয়ে বিশেষ কোন লাভ আছে। আমি আসলে একটা ফ্রিজ কেনার বিষয়ে জানতেই এখানে এসেছি, অবশ্য আপনার দোকানটা দেখার ইচ্ছাও আমার ছিলো।” আমার কথা সুমন মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো, “খুব ভালো কথা! আপনি তো তাহলে আমার জন্য লক্ষী! বলুন কী খাবেন? প্রথম আমার দোকানে এলেন, একটা কিছু তো খেতেই হবে। মিষ্টি আনতে বলি?” : আমি তো মিষ্টি খাই না। : তাহলে ঝাল কিছু আনাই। : ধন্যবাদ। আমি কিছুই খাবো না। আর আমি এখন যাবো। জরুরি কাজ আছে। : কাজ তো থাকবেই। আচ্ছা না হয় এক পেয়ালা কফিই খান? : না সুমন সাহেব, দুঃখিত। আমার জন্য কিছুই লাগবে না। আমার সত্যি কাজ আছে। : আমি না চাইলে আপনি যাবেন কী করে? : মানে কী! আপনি কি আমায় জোর করে আটকে রাখবেন? সুমন হাসে। সে হাসি সারল্যের না-কি ক্রুরতার ঠিক বুঝতে পারলাম না। : আটকে রাখবো কেনো? আপনি অতিথি। অতিথি আসেন নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু যায় অন্যের ইচ্ছায়। এটা আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য। : কিন্তু আমি আপনার অতিথি নই সুমন সাহেব। আমি আপনার ক্রেতা। : তাহলে তো একের ভিতর দুই। প্রথমত অতিথি, কারণ আমি আপনাকে গতকালই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম; দ্বিতীয়ত আপনি আমার দোকানের লক্ষী, আপনি আমার ক্রেতা। একের ভিতর দুই। তাছাড়া আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবার কিছু কারণ তো অবশ্যই আছে, ভুলে যাচ্ছেন কেনো? : কী কথা আপনার আমার সাথে? : আমার একটা স্বপ্নের কথা আপনার সাথে শেয়ার করতে চাই, আপনার সহযোগিতাও চাই। : বলুন কী আপনার স্বপ্ন? আর সে স্বপ্নপূরণ করতে আমিই বা কী করতে পারি? : আমি একটা হাসপাতাল করতে চাই। ‘ইন্দ্রাণী হাসপাতাল (প্রাইভেট লি:)’। : বাহ্! তাও ইন্দ্রাণী? আপনার সবই ইন্দ্রাণীময়। : তা বলতেই পারেন। ইন্দ্রাণী আমার প্রথম স্বপ্ন, আমার প্রথম প্রেম। “নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়.......”। আমি আসলে একটা বিশাল আকাশ ছুঁতে চাই। আমার নেতা যেমন সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, আমিও তাতে আমার সামান্য শ্রম-ঘাম যুক্ত করতে চাই। : দেখুন সুমন সাহেব আপনার স্বপ্নের ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। তা ছাড়া আমার করারও তো কিছু নেই। : আপনার কিছুই করতে হবে না, করবো তো আমি। আপনি হবেন আমার হাসপাতালের পরিচালক। : আমি! আমি কি ডাক্তার না-কি? : দুই বছরে ডাক্তার হয়ে যাবেন। আপনার সম্মতি পেলেই শুরু হয়ে যাবে আমার হাসপাতালের কাজ। সব তৈরি হতেও দুই-আড়াই বছর তো লেগেই যাবে। : ভালোই বলেছেন! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল? দুঃখিত সুমন সাহেব, আমি এখন যাবো। আমি বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াই। সুমন এগিয়ে এসে বলেন, “যাবেন তো নিশ্চয়ই। তবে আমার প্রস্তাবটা পজিটেভলি ভাববেন। এবং এটাই আমার প্রত্যাশা।” আমি তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি, আমার পেছনে জ্যোৎস্নাও বেরিয়ে আসে। সিঁড়িতে নামার সময় পূর্বের সেই ছেলেটির সাথে দেখা, সে চা-নাশতা নিয়ে উঠছিলো। আমাদের নামতে দেখে হাসিমাখা মুখে বলে, “ম্যাডাম চলে যাচ্ছেন? চা-নাশতা কে খাবে?” আমরা দ্রুত বেরিয়ে আসি ইন্দ্রাণী ইলেক্ট্রনিক্স থেকে। রিক্সা ডেকে দু’জন উঠে পড়লাম। আমার মাথায় তখন উত্তেজনার আগুন। জ্যোৎস্না কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো; আমার কথা বলতে মন চাইছে না; কিন্তু জ্যোৎস্না পাশে থাকলে কথা না বলে থাকা অসম্ভব, তাও বুঝতে পারছি। কথার সূত্রপাত করলো জ্যোৎস্নাই- : কী বুঝলি পারমিতা? : তুই কী বুঝলি, তাই বল শুনি? : আমার তো মনে হলো সুমন ভাই এখনো মজেই আছে। এখনো সে তোকে আগের মতোই ভালোবাসে। : আগের মতো ভালোবাসে মানে? : দোকানের নাম দিয়েছে ইন্দ্রাণী ইলেক্ট্রনিক্স। আবার হাসপাতাল করতে চায়, তার নামও ‘ইন্দ্রাণী হাসপাতাল (প্রাইভেট লি:)’ তাতে কী বোঝা যায়? : কী বোঝা যায়? : বোঝাই যায় তোকে ভালোবাসে। নইলে ইন্দ্রাণী নাম রাখে কেনো?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App