×

সাময়িকী

দুধের মাছি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২৬ পিএম

দুধের মাছি

মলিনা লেখাপড়ায় মন্দ নয়। শুধু গণিতের মার-প্যাঁচ তাকে গুলিয়ে ফেলে। সুন্দর হস্তাক্ষরে দ্রুত লিখতে তার কোনো জুড়ি নেই। তবু একটি বিষয় তার বিবেককে বিষময় করে তোলে। কিছুতেই সে অঙ্ককে আয়ত্তে আনতে পারে না। আশির দশকের সূচনালগ্নে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে প্রথমবার তার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৫৫২। তার মাঝে গণিতে শুধুমাত্র তিন। কোনোমতে অঙ্কে উতরে গেলে সে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে যেত। অঙ্কের অসারতায় তার জীবন অঙ্গার হয়ে যায়। মলিনা মনে মনে নিজকে মূল্যায়ন করে, কেবল গণিতের জন্যই হয়তো এ জীবনে মাধ্যমিকের মঞ্চ পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে বড় হয়ে একজন আইনজীবী হবে। মাধ্যমিক পার হলে আর কোনো মুশকিল থাকে না। অঙ্কবিহীন শিক্ষাজীবন। খাতা-কলম নিয়ে কোনো হিসেব-নিকেশ নেই। অঙ্কের অবয়ব দেখে অনুমোদিত বিধি প্রয়োগ নেই। গাণিতিক বিবরণ বর্জন করেই শিক্ষার্জন। আহা! সামনে কী যে সোনালি সময়। মলিনা তার মায়ের পরামর্শে গার্লস স্কুল পরিবর্তন করে। অতীত রেকর্ড, নাম-ধাম মুছে ফেলে নতুনভাবে নাম নিবন্ধন করে। নবশিক্ষার্থী হিসেবে মাধ্যমিকে পুনরায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সহশিক্ষা বিদ্যায়তনে ভর্তি হয়। অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুল থেকে এসে পাংশা সদরের সেই বিদ্যায়তনে ভর্তি হয় সাঈদ। বড়ভাই সমাজসেবা অফিসার হিসেবে নিজ এলাকা পাংশায় বদলি আসে। থানা কোয়ার্টারে বাসা নিয়েই ছোট ভাইকে এনে সদর স্কুলে ভর্তি করে দেয়। একই আবাসিক আঙ্গিনায় পূর্ব থেকেই বাস করছিল মলিনাদের পরিবার। সাঈদ বিজ্ঞানের ছাত্র এবং অঙ্কে অনেক ভালো- এই তথ্যটি অচিরেই মলিনার কানে পৌঁছে যায়। অঙ্কের অর্থোদ্ধারের জন্যে মলিনা কৌশলে সাঈদের ভাবির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বছরের গোড়ার দিকেই সরকার থানা অব্দি উপজেলা প্রশাসন চালু করে। থানায় টিএনওসহ বিভিন্ন অফিসারের আগমন ঘটে। একজন ব্যাচেলর ম্যাজিস্ট্রেটও আসে। অভিন্ন আবাসিক এলাকায় বাস করায় মায়ের সঙ্গে মলিনা টিএনওর বাসায় সৌজন্য সাক্ষাতে যায় এবং পরিচিত হয়। টিনএজ বালিকাটি ক্রমশ পরীক্ষা পাশের জাল বিস্তার করতে থাকে। তারই অংশ হিসেবে সাঈদের সঙ্গে সখ্য গড়তে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রেমের জালে জড়াবার জন্য তাকে জেরবার করে তোলে। এতে একসময় একটু নমনীয় হলেও মোটেও আসক্ত হয় না। স্কুল শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে একদিন মলিনা বলে, ‘আমার জগৎময় এখন শুধু তুমি আর তুমি।’ সাঈদ শুনে নিশ্চুপ থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, ‘ওসব বোঝার আমার কোনো আগ্রহ নেই। ভালোভাবে পড়াশোনা কর। অঙ্ক মুখস্থ নয়, বোঝার চেষ্টা কর।’ ‘সেজন্য তুমি যেখানে ইংরেজি পড়, নভেম্বরের প্রথম থেকে আমিও সেখানে পড়ব। আগের মাস্টারের কাছে আর পড়ব না।’ ‘তোমার জন্যই বোধহয় স্যার পড়ার সময়সূচি পাল্টে দিয়েছে। আগামী মাস থেকে ফজর নামাজের পর যেতে বলেছে।’ ‘ঘুম থেকে উঠেই দুজনে একসাথে যাব, কোনো সমস্যা নেই।’ মেঘমুক্ত শিশিরস্নাত সকাল। মধ্যকার্তিকের হৈমন্তি ভোরে ঘন কুয়াশার চাদর সরিয়ে দিনের সূর্যটা যখন উদয়বার্তা জানায়। গ্রামের কিষানেরা সোনালি ধান কাটার স্বপ্নে যখন শস্যক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হয়। সে-সময়েই মলিনা এবং সাঈদ ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের জন্য হেঁটে আধামাইল দূরবর্তী পথে শিক্ষকের ঘরমুখো যাত্রা করে।

ভোরবেলায় শিক্ষকের বাড়ি পৌঁছুলেও প্রতিদিন তিনি আধাঘণ্টা দেরিতে পড়াতে আসেন। অঙ্ক শেখার সুবিধার্থে মলিনার অনুরোধে ইংরেজি শিক্ষক এমন কৌশল অবলম্বন করে। মধ্যবর্তী সময় মলিনা সাঈদের নিকট অঙ্ক শেখার চেষ্টা করে। একদিন যে অঙ্ক শেখানো হয়, পরদিন জানতে চাইলে আর পারে না। শিক্ষকের অনুরোধে তবুও সাঈদ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। মলিনা একদিন তার বাম হাতের কনুইয়ের নিচে ব্যান্ডেজ করে পড়তে আসে। শিক্ষকের সামনে হাতটি আড়াল করে রাখলেও সাঈদের দিকে সদর করে রাখে। কিন্তু সহপাঠীর সেদিকে খেয়াল নেই। পড়া শেষ করে ফেরার পথে মলিনা ব্যান্ডেজকৃত স্থানে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, ‘আমার কী হয়েছে, একবারও জিজ্ঞেস করলে না। তুমি আমায় কতটা ভালোবাস সেটাই আজ পরীক্ষা করলাম।’ বলে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে। ‘হাতে সত্যিকার কিছু হলে হয়তো চোখে পড়ত। তাছাড়া আমরা এক জায়গায় পড়াশোনা করতে যাই।’ ‘তোমার কোনো অনুভ‚তি নাই।’ বলে মলিনা একেবারে চুপসে যায়। তৎকালে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের বিষ্যুদবার মাধ্যমিক পরীক্ষা আরম্ভ হতো। এজন্য অন্যান্য বিষয় প্রস্তুতির লক্ষ্যে জানুয়ারিতেই দুজন ইংরেজি প্রাইভেট পড়া বন্ধ করে দেয়। যৌথ পাঠগ্রহণ থেমে গেলেও সম্মেলনে সমস্যা হয় না। মলিনা এবং তার মা একদিন সাঈদের ভাবির কাছে আসে। তার মেয়েকে অঙ্কে পাস করানোর পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ করতে। কথা প্রসঙ্গে মলিনা তার ভাবিকে বলে, ‘ম্যাডাম অঙ্ক পরীক্ষার দিন হলে আমাকে সাহায্য করতে হবে।’ ‘কীভাবে?’ ভাবি তাকে জিজ্ঞেস করে। ‘আপনার দেবর অঙ্কে অনেক ভালো, ও ইচ্ছে করলেই সম্ভব। না হলে আমার জিন্দেগি একদম বরবাদ হয়ে যাবে। প্রথম ঘণ্টায় সাঈদ যে অঙ্কগুলো পরীক্ষার খাতায় উঠাবে, তার একটা খসড়া করে একঘণ্টা পর বাইরে এসে আমার হাতে দিলেই হবে।’ ‘যদি কোনো অসুবিধা হয়।’ ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমি সব সামলে নেব।’ সাঈদ বাসায় এলে সব ঘটনা ভাবি তাকে খুলে বলে। সে গররাজি হলে ভাবি তাকে বুঝায়, ‘মেয়েটা গতবার অঙ্কে ফেল করেছে, এবার তেমন হলে তার আর পড়াই হবে না।’ ‘ঠিক আছে, সময় আসুক দেখা যাবে।’ সময় আসে এবং পরিকল্পনামাফিক সাঈদ তাকে সহযোগিতা করে। পরীক্ষা চলাকালে বাইরে গিয়ে ৬০ নম্বরের খসড়া তার হাতে দিলে রেজাল্টে দেখা যায় মলিনা অঙ্কে ৪২ পেয়েছে। সর্বমোট ৫৮২ নম্বর নিয়ে উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগ অর্জন করে। তারপর রাজবাড়ি সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজে ভর্তি হয়। আর সাঈদ প্রথম বিভাগ নিয়ে রাজেন্দ্র কলেজে পড়তে যায়। সময়ের সঙ্গে সংযোগের দূরত্বও বাড়ে। পড়াশোনা শেষ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করে। মলিনা সত্যি সত্যি ল’ ইয়ার হয়ে রাজবাড়ি কোর্টে প্রাকটিস করে এবং সাঈদ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অন্যত্র সরকারি চাকরি করে। চাকরি জীবনের সিংহভাগ সঞ্চয় দিয়ে সাঈদ নিজ জেলা শহরে একটা বাড়ি করে। চাকরির মেয়াদ শেষ না হওয়ায় তাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে হয়। বাসাটি কেয়ারটেকার দেখে। কোনো অজ্ঞাত কারণে তার বাসায় অর্ধলাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। নানা কারণে পরিশোধে বিলম্ব দেখে বিদ্যুৎ বিভাগ অনাদায়ে কোর্টে মামলা দায়ের করে। আদালত মোকাবিলার জন্য সাঈদ রাজবাড়ি কোর্টে যায়। সেখানে এক জায়গায় সে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সামনে দিয়ে আইনজীবীর পোশাকে একজন মহিলা তাকে অতিক্রম করে। তিন যুগ আগের কথা তার মনে পড়ে যায়। মনে হয় এই তো সেই মলিনা। তার হাঁটা দেখে আরো নিশ্চিত হয়। কিন্তু তাকানোর পরেও তাকে চিনলো না কেন? সাঈদ তার পশ্চাদপসারণ করে ডাক দেয়, ‘হ্যালো ম্যাডাম, আমাকে কি চিনতে পেরেছেন?’ ‘আরে আপনি! ম্যাডামের দেবর না! আমি একটু ব্যস্ত আছি। আরেকদিন কথা হবে।’ বলেই প্রস্থান করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App