×

পুরনো খবর

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪৩ পিএম

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। স্থল, জল ও আকাশপথ বন্ধ করে দেশে দেশে ঘোষণা করা হয় লকডাউন, জারি করা হয় কারফিউ। এ রকম পরিস্থিতিতে একটুও বিচলিত না হয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্রুততম সময়ে করোনা মোকাবিলায় সময়োচিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমেই তিনি মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা পুনর্বিন্যাস করে সবার মনোযোগ নিবদ্ধ করেন করোনা মোকাবিলায়। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ ও জীবন সুরক্ষা, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা এবং আকস্মিক কর্মহীন হয়ে পড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন ও ত্রাণকাজে সহায়তাকারী সেনা কর্মকর্তাকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেন। ৬৪ জেলার প্রান্তিক জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করে তিনি বাংলাদেশের মানুষের সহজাত মানবিকতা, ভ্রাতৃৃত্ববোধ, সৌহার্দ ও সহমর্মিতার বন্ধনকে অটুট রেখে সবাইকে একসঙ্গে লড়াই করার আহ্বান জানান। জীবনরক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২৭ মার্চ ২০২০ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এতে সংক্রমণের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলেও দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠী যেমন- নির্মাণ শ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক, রিকশা ও ভ্যানচালক, হোটেল-রেস্তোরাঁ কর্মী, ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, সেলুনকর্মী ও ভাসমান মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার লক্ষ্যে সরকার সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। খাদ্য ও নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিধির সম্প্রসারণসহ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু এবং গার্মেন্টসসহ শিল্প-কারখানা, মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুদি দোকানসহ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার প্রাজ্ঞময় উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সারাদেশের ৫ কোটি মানুষকে মানবিক সহায়তা প্রদানের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ১ কোটি ২৫ লাখ পরিবারকে মানবিক সহায়তা প্রদানের সুপারিশ করে। সরকারের সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ইতোমধ্যে ৫০ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা, ১০ লাখ ৫০ হাজার পরিবারকে ওএমএসের আওতায় খাদ্য সহায়তা, ১০ লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে ভিজিএফ, ৩ লাখ ১ হাজার জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান এবং ৫০ হাজার পরিবারকে জিআরের আওতায় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। মোবাইল পরিষেবা ও ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে পরিবারপ্রতি ২৫০০ টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারে নগদ সহায়তা প্রেরণ করা হয়। কওমি মাদ্রাসার এতিম ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য ১৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং নন-এমপিওভুক্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৭০ কোটি ৮১ লাখ ৭০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। কোভিড-১৯ এর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজে ১ লাখ ১২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করেন। এ অর্থ বাংলাদেশের জিডিপির ৪.০৩ শতাংশ। প্যাকেজগুলো মধ্যে রয়েছে : রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ তহবিল ৫ হাজার কোটি টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা ৩৩ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পসহ মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষি ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ বাবদ ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি বাবদ ২৫২ কোটি টাকা, ভাতা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি বাবদ ৮১৫ কোটি টাকা, নিম্নআয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ৩ হাজার কোটি টাকা, কর্মসৃজন কার্যক্রম বাবদ ২ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন বাবদ ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকা, কৃষি কাজ যান্ত্রিকীকরণ ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা, কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা, চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী ১০০ কোটি টাকা, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ৭৫০ কোটি টাকা, গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ খাতে ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ইত্যাদি। স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। সরকারকে পরামর্শ প্রদানের জন্য খ্যাতনামা ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কোভিড পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। সরকারের তরফে নিয়োগ দেয়া হয় বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। দেশে উৎপাদিত পিপিইসহ অন্যান্য উপকরণ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে এগুলো বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। শুরুতে আইইডিসিআরের একটি মাত্র কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল। বর্তমানে পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে ১১৮টিতে উন্নীত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সার্বিক সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনা ও নজরজারিও অতি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ এপ্রিল দেশের জনগণের জন্য ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান প্রধান হলো : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির করণীয়, গণসচেতনতা সৃষ্টি, রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করা, ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা, নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ত্রাণকাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম সহ্য না করার প্রত্যয়, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা, খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করা, কোনো জমি পতিত ফেলে না রাখা, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন : কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা এবং গুজবে বিচলিত না হওয়া। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী বিগত বছরের ৭ এপ্রিল ১০ দফা, ১৬ এপ্রিল ১০ দফা, ২০ এপ্রিল ১৩ দফা এবং ২৭ এপ্রিল আরো ১০ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। সামগ্রিক বিচারে চারদিকে যখন বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক খববের ছড়াছড়ি ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহব্যঞ্জক। দ্রুততম সময়ে দক্ষতার সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় বিরল সাফল্য অর্জন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে পেছনে ফেলেছে। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে। দেশের রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দিয়ে ১১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে রপ্তানি গতবারের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম৩ মাসে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৫৮ শতাংশ। করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভ‚মিকা রেখে চলেছে কৃষি খাত। জিডিপির ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। আয় কমে যাওয়ায় শহর ত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি। সরকারের তরফ থেকেও কৃষি খাতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অতিমারির প্রতিঘাত মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ফুল ও ফল চাষ, মৎস্য চাষ, ডেইরি ও পোল্ট্রি খাতে চার শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার স্কিম গঠন করেছে। এ ছাড়া ফসল খাতে ঋণ বিতরণের জন্য নয় শতাংশের স্থলে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ প্রদানের তহবিল গঠন করা হয়। ফলে কৃষি খাতে ৪ শতাংশ সুদে সর্বমোট প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের তরফ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ত্বরিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে ঘনজনবসতির এই দেশে (১৭ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) শনাক্তকৃত কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর হার মাত্র ১৫.২৬ শতাংশের মধ্যে ৮৯.৫৪ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন এবং মৃত্যুহার ১.৫০ শতাংশ। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৬৩২ জন, সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৩৭ জন এবং মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০৬ জন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় দেশগুলো, কানাডা, ব্রাজিল, ভারত প্রভৃতি দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক বেশি।

ইয়াকুব আলী : কলাম লেখক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App