×

সাময়িকী

‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২০ পিএম

‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’

বঙ্গবন্ধু

আরো দেরি করলে অনেক ইতিহাস হয়তো চলে যাবে ইতিহাসের আড়ালে। তাই কক্সবাজারের একজন সচেতন বাসিন্দা হিসেবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের তাগিদ ও দায়িত্ববোধ থেকেই কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে অনুসন্ধানে নামি। এ অনুসন্ধানে প্রধানত কক্সবাজারের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ও সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতির পিতা। এই জাতির পিতা হওয়ার পেছনে রয়েছে বাঙালির জন্য অসীম দরদ ও ভালোবাসা এবং ত্যাগ তিতিক্ষা। বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান পেতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এক বিরল ঘটনা। তারই এ কৌশলী ভূমিকার পেছনে রয়েছে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের কিছু বিরলপ্রজ সংগ্রামীর বিশেষ অবদান। পঞ্চাশের দশক থেকে পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানাভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে এসেছেন। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সফরে এলেও ওই সময়ে কক্সবাজারে আসেননি তিনি। তবে তিনি অবগত ছিলেন কক্সবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে। মূলত কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকেই কক্সবাজারের আফসার কামাল চৌধুরীসহ অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। বন্ধুদের নিয়েই তিনি আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলেন। ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর থেকে পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজারে অনেকবার এসেছেন তিনি। সে সময় যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং যাদের নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন তাদের কথাই ফুটে উঠেছে ‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর কক্সবাজারে রাজনৈতিক সফরের কর্মকাণ্ড সে সময় যেসব পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে সেসবের এক দুর্লভ প্রতিবেদন এতে রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু কক্সবাজারে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন তারও বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থ। আরো আছে বঙ্গবন্ধুর চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শতাধিক আলোকচিত্র। এসবের বিবরণ ‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে সন্নিবেশিত করেছেন কবি ও ইতিহাস গবেষক কালাম আজাদ। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম স্বতন্ত্র গ্রন্থ ‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’। ১৭৬ পৃষ্ঠা সংবলিত এ গ্রন্থে গবেষক কালাম আজাদ ৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত কক্সবাজারের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকা ও ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছেন। প্রথম অধ্যায়ের বিষয় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও পঞ্চাশ দশকে কক্সবাজারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এ অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম সফর, ১৯৫৫ সালের সফর, ’৫৬ সালে মন্ত্রিসভা গঠন ও কক্সবাজারে প্রথম পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, ১৯৫৮ সালের শ্রমিক সমাবেশ ও বঙ্গবন্ধুর কক্সবাজার সফর পরিচ্ছেদে ভাগ করে পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এ অধ্যায়ে এশিয়ান হাইওয়ে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, কক্সবাজারের লবণের উৎপাদকদের ওপর লবণের কর অবিলম্বে বিলুপ্তকরণ, কক্সবাজারে একটি কলেজ, একটি প্রযুক্তি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তামাক উৎপাদনকারীদের ওপর আরোপিত কর হ্রাস, তাঁত ও লবণ বোর্ড গঠনসহ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কক্সবাজারের বিভিন্ন জনসভায় দাবি করার প্রসঙ্গটি বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়- উত্তাল ষাটের দশক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন উপলক্ষে কক্সবাজারে কমিটি গঠন, ১৯৬৫ সালের ১৪ এবং ১৫ ডিসেম্বর সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস কবলিত কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রচারণার অংশ হিসেবে, ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে কক্সবাজারে নাগরিক সংবর্ধনার অংশগ্রহণ করেন নামক পরিচ্ছদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কক্সবাজার সফর করেছেন। এ অধ্যায়ে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত কক্সবাজারের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক-রাজনৈতিক চরিত্র ও পটপরিবর্তনের নানান দিক উঠে এসেছে। উঠে এসেছে এ সময়ের ব্যক্তি চরিত্রগুলোও। ‘সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে তৃতীয় অধ্যায় সাজানো হয়েছে। এ অধ্যায়ে সত্তরের নির্বাচনে কক্সবাজার-মহেশখালী আসনের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) পদে স্বতন্ত্রী প্রার্থী মোশতাক আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে কক্সবাজার-মহেশখালী, কক্সবাজার-রামু আসনে এমপি নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান) ছাড়া সবকটি আসনে আওয়ামী লীগের জয়, কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণার ভাষণ, ছাত্রলীগ নেতা ও পুরনো আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানানোসহ জয়ের পর ইয়াহিয়া-ভুট্টোসহ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি ও টালবাহানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপে সেনাঘাঁটি করার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাব এবং সেই প্রস্তাব বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাখ্যানসহ মুক্তিযুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সত্তরের নির্বাচন থেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পর্যন্ত কক্সবাজারের সামাজিক, অর্থনেতিক এবং ভৌগোলিক-রাজনৈতিক চরিত্র ও পটপরিবর্তনের নানান দিক তুলে ধরেছেন কালাম আজাদ। তার কলমের ডগায় উঠে এসেছে এ সময়ের ব্যক্তি চরিত্রগুলোও। ‘তিয়াত্তরের নির্বাচন ও পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর কক্সবাজার শেষ সফর’ অধ্যায়ে তথা চতুর্থ অধ্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে রাজনীতি ও কক্সবাজারের রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি কক্সবাজার সমুদ্রতীরে সুইমিং পুল, বিপণিকেন্দ্র, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠন, হিমছড়ি জলপ্রপাতের উন্নয়ন এবং সৈকতে কুঁড়েঘর নির্মাণ, রামুর নারকেল বাগান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার উন্নয়ন, যুদ্ধে বিধ্বস্ত কক্সবাজার বিমানবন্দর সংস্কার কার্যক্রম, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পুনর্নির্মাণ, পরমাণু শক্তি কমিশন, পরিকল্পিত দ্বীপ উন্নয়ন, মাতামুহুরী সেচ প্রকল্প, কুতুবদিয়া-চট্টগ্রাম-চাঁদপুর নৌপথ এবং কক্সবাজার-মহেশখালী জলপথে যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ চালুকরণ, কুতুবদিয়া বাতিঘর উন্নয়ন এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা, জলোচ্ছ্বাস রোধ, সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধন ও প্রকৃতি রক্ষায় ঝাউবাগান লাগানোসহ কক্সবাজারের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন লেখক কালাম আজাদ। পঞ্চম অধ্যায় সাজানো হয়েছে জীবন বৃত্তান্তমূলক টীকা দিয়ে। এতে স্থান পেয়েছে আতাউর রহমান খান, আজিজুর রহমান, আফসার কামাল চৌধুরী, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, আবদুল গফুর চৌধুরী, এম এ আজিজ, এ কে এম মোজাম্মেল হক, এস এ এম রফিক উল্লাহ, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফজলুল করিম, মৌলভী ফরিদ আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, এডভোকেট বদিউল আলম চৌধুরী, এডভোকেট বদিউল আলম, মওদুদ আহমদ, নুর আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, সুধাংশু বিমল দত্ত, যতীন্দ্র কুমার রক্ষিত। এ গ্রন্থটি শুধু বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে নয়Ñ মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজারের ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের কক্সবাজারের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে। গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে ৩৬৭ টাকা মাত্র। আশা করি এ গ্রন্থটি শুধু বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নয়- মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজারের ভ‚মিকা এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের কক্সবাজারের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল এবং কক্সবাজারের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। গ্রন্থটি পাওয়া যাবে অভিজাত বুকস্টলসহ অনলাইন বুকশপে। বইটির লেখক কালাম আজাদ বলেন, ‘স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার সফর করেছেন ১২ বার। কক্সবাজারের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভ‚মিকা অনবদ্য। বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি, এ বিষয়ে রচিত হয়নি একটিও স্বতন্ত্র গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বুকে নিয়ে কক্সবাজারে এখনো অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জীবিত আছেন। আরো বিলম্ব করলে হয়তো তারা সবাই গত হয়ে যাবেন। তাই কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর আগমন ও অবদানের ইতিহাস সংরক্ষণের এটাই সর্বোচ্চ সময়। আরো দেরি করলে অনেক ইতিহাস হয়তো চলে যাবে ইতিহাসের আড়ালে। তাই কক্সবাজারের একজন সচেতন বাসিন্দা হিসেবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের তাগিদ ও দায়িত্ববোধ থেকেই কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে অনুসন্ধানে নামি। এ অনুসন্ধানে প্রধানত কক্সবাজারের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ও সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বেশি। অনুজ হলেও ইতিহাসের বিদগ্ধ আলোচনায় প্রয়াসী কবি ও গবেষক কালাম আজাদের ‘কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু’ বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App