×

মুক্তচিন্তা

কর্নেল (অব.) শওকত আলী জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১২:০৩ এএম

কর্নেল (অব.) শওকত আলী জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি
১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি শরীয়তপুর জেলাধীন নড়িয়া থানার লোনসিংহ বাহের দিঘিরপাড় গ্রামে জন্ম নেয়া জাতীয় বীর কর্নেল (অব.) শওকত আলীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। যে মানুষটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তার অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে গত ১৬ নভেম্বর চিরবিদায় নিয়েছেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি শুধু ব্যক্তি কর্নেল (অব.) শওকত আলীকে হারায়নি, জাতি হারিয়েছে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিগূঢ়স্তম্ভ, মহান মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সংগঠককে। তার অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রস্তুতির মাধ্যমে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে তার নির্ভীক ভ‚মিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৫-এ জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যখন ধরে নেয়া হতো যে, সেনাবাহিনী মানেই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী, ওই চরম দুঃসময়ে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা কর্নেল শওকত আলী রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হন। ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের মনে আশার আলো প্রজ্বলিত করেছিলেন। প্রসঙ্গত, পকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যম যেটিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অভিহিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে দমিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে নেমেছিল সেই মামলার প্রকৃত নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’। এই মামলার অভিযুক্ত সবার আশু উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র পন্থায় পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর কোপানল থেকে জাতিকে মুক্ত করে বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাসভ‚মি সৃষ্টি তথা বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তার রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘সত্য মামলা আগরতলা’ গ্রন্থে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন অথচ ব্যাপক প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করেছেন, যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতি। যেহেতু শওকত আলী ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে এই বাহিনীর পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু খুনি মোশতাক-জিয়া নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী থেকে ’৭৫-এর ২৩ অক্টোবর স্বাভাবিক কারণেই চাকরিচ্যুত হন। ফলে আদর্শিক কারণে ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। পারিবারিক শত প্রতিক‚লতা সত্ত্বেও তিনি ও তার সহধর্মিণী দলীয় অসংখ্য নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং এলাকাবাসীকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করেছেন সমগ্র জীবন। সামরিক স্বৈরাচার জিয়ার শাসনামলে তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জিয়ার তল্পিবাহকে পরিণত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত ও কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় বেইমান বলার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার প্রতিবাদে নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে কর্নেল (অব.) শওকত আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ), ইংরেজিতে Freedom Fighters Solidarity Council এবং এর গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের এই সংগঠনের সদস্য হওয়ার বিধান সন্বিবেশিত হয়। জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর মুসপ মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণমানুষের মাঝে স্বল্প সময়ে সাড়া জাগিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করার রণধ্বনি জয় বাংলা স্লোগানের বিপরীতে খুনি মোশতাক-জিয়া কর্তৃক ’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তানি ভাবাদর্শের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর প্রতিষ্ঠাতা শওকত আলী নেতৃত্বে সংগঠন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চস্বরে উচ্চারণের পাশাপাশি আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম হবে জয় বাংলা, যা করমর্দনের সময়, আলিঙ্গনের সময়, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সমস্বরে এবং উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হতো। প্রসঙ্গক্রমে বলাবাহুল্য যে, ওই প্রতিক‚ল অবস্থায় আওয়ামী লীগের অনেক নামজাদা নেতা যখন জয় বাংলা উচ্চারণে দ্বিধাবোধ করতেন তখন মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ কর্নেল (অব.) শওকত আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চস্বরে উচ্চারণ করত। বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য তথা বাঙালিত্বের আত্মপ্রকাশের স্লোগান জয় বাংলা সমুন্নত রাখার পেছনে শওকত আলীর অবদান অবিস্মরণীয়। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই মুসপ থেকে প্রথম জোরালোভাবে জাতির জনকের হত্যার বিচারের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হয়। কর্নেল শওকত আলীর উদ্যোগের কারণে তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে প্রকাশিত হয় ‘একাত্তরের দালালেরা যা বলেছে যা করেছে’ এবং ‘একাত্তরের দালালেরা কে কোথায়’। এই দুটি প্রকাশনা জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন তথা শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্নের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রেখেছে। কর্নেল (অব.) শওকত আলী তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে চরম প্রতিক‚লতার মধ্যেও ১৯৭৯-এর সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৩৯ জনের মধ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মোট ৬ বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিটি নির্বাচনেই এলাকাবাসী (শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া এবং পরবর্তীকালে নড়িয়া-সখিপুর নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকা) তার অর্থের জোগান দিয়েছে। প্রসঙ্গত, এরশাদের শাসন আমলে মিথ্যা খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার গভীর চক্রান্তের একপর্যায়ে মন্ত্রিত্বের প্রলোভন দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ বিলুপ্ত করে অঙ্গীকারনামা প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও তিনি তাতে প্রলুব্ধ হননি বরং ঘৃণাভরে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জাতির জনকের সঙ্গে তিনি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত (২৬নং) না হলে পাকিস্তান আমলে তাকে ক্যাপ্টেন থাকাকালে চাকরিচ্যুত এবং কারাবন্দি হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হতো না। ফলে পদোন্নতি পেয়ে আরো বড় সামরিক আমলা হতে পারতেন, অনেক আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ এই মানুষটি সেনাবাহিনীতে কমিশন র‌্যাংকে চাকরিতে যোগদান সত্ত্বেও দেশকে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের হাত থেকে রক্ষার্থে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তথা বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাসভ‚মি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে দ্বিধাবোধ করেননি। নবম সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে কর্নেল শওকত আলী ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। তখন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ স্পিকার পদে বহাল ছিলেন। বলা বাহুল্য, ডেপুটি স্পিকারে মর্যাদা পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদার সমতুল্য এবং প্রটোকল অনুসারে রাষ্ট্রের ৪নং পদ। ১৯১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হিসেবে তিনি এডভোকেট আব্দুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন স্বাভাবিক কারণেই ধরে নেয়া হয়েছিল যে, বাকি ৮-৯ মাসের জন্য শওকত আলীই জাতীয় সংসদের স্পিকার হচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে সেটি না ঘটায় খুব যৌক্তিক কারণেই এ বিষয়টি তাকে ভীষণ ব্যথিত করেছিল। কিন্তু কখনো কারো কাছে তার মনোক্ষুণ্ণের কথা প্রকাশ করেননি। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের প্রতি চরম ভালোবাসা ও আনুগত্য তাকে এটি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতা, নিউমোনিয়া, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত ১৬ নভেম্বর কর্নেল (অব.) শওকত আলী তার অসংখ্য ভক্তকে ফেলে বিদায় নিয়েছেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে জাতি একজন পরীক্ষিত, ত্যাগী, আদর্শবান, জাতীয় বীরকে হারিয়েছে। যিনি সহজ-সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সমগ্র জীবন। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি সমগ্র জীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। জাতির জনকের মতাদর্শে অবিচল এই মানুষটি বারবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেকে সোচ্চার রেখেছেন। কর্নেল শওকত আলীর প্রয়াণের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দল-মত নির্বিশেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সমাজিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষের মহামারি করোনা উপেক্ষা করে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য ব্যাপক উপস্থিতি তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তেমনি নিজ এলাকায় তাকে সমাহিত করার সময় সাধারণ মানুষের ক্রন্দন তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শারীরিকভাবে তিনি বিদায় নিলেও তার সৃষ্ট সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের (মুসপ) জন্য তার উদ্ভাবিত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান ‘মুক্তিসংগ্রাম চলছে চলবে’ অনন্তকাল বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমগ্র জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন তথা শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে জাতির জনকের অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করবে। আজ ৮৪তম জন্মবার্ষিকীতে মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় বীর কর্নেল শওকত আলীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। হাসান-উজ-জামান : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App