×

মুক্তচিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের লড়াই ডেবস থেকে স্যান্ডার্স

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১০ পিএম

যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের লড়াই ডেবস থেকে স্যান্ডার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প চলে গেলেন, এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রকে মহান করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে! যাওয়ার আগে তার সমর্থকদের দিয়ে ক্যাপিটল ভবনে আক্রমণ চালিয়ে ক্যুয়ের চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের সরকার ক্ষমতায় বসেছে। কিন্তু বাইডেন-কমলা জুটি নিরুদ্বিগ্ন নেই। থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেননা ট্রাম্পিয়ান রাজনীতি কেবলমাত্র ব্যক্তিক বিচ্যুতি নয়, সামাজিক বিচ্যুতি। ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্প উগ্র, আর বাইডেন নম্র। গোষ্ঠীগতভাবে তারা কিন্তু একই। বাইডেনের আমল তাই ট্রাম্পের থেকে ব্যাপক রকম পৃথক হবে না। ট্রাম্পের অনেক কিছুই তিনি অনুসরণ করবেন, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি, তবে সুর পাল্টে। কিন্তু মার্কিন সমাজের যে সংকট বিস্ফোরিত হয়েছে জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবৈষম্য, ব্যক্তির অধিকার হরণ, আয়বৈষম্য ইত্যাদি তা অটুট থাকবে। আর তাই অব্যাহত থাকবে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন, যা শুরু হয়েছে বার্নি স্যান্ডার্সের নির্বাচনী অভিযান থেকে। ২০১৬ ও ২০২০-এ দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়নপ্রার্থী ভারমন্ট সিনেটর স্যান্ডার্সের রাজনীতি সরাসরি সমাজতন্ত্রের আহ্বান দিয়ে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচন তার একমাত্র লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ স্বরূপ। তার অভিযান ছিল আমেরিকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য। সম্পদশালী ১ শতাংশ, লুটেরা করপোরেট ও ওয়ালস্ট্রিটের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছিলেন তিনি। আর তার কার্যালয়ে ঝুলছিল যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট নেতা ইউজিন ডেবসের ছবি। ডেবস তার রাজনৈতিক আদর্শের গুরু। শত বছর পরও ইউজিন ডেবসকে নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক ও আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ১৯০০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচবার সোশ্যালিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন ডেবস। ১৯১২ সালের নির্বাচনটি ছিল আশাব্যঞ্জক, যখন তিনি প্রায় ১০ লাখ ভোট পান, যা মোট ভোটের ৬ শতাংশ। ডেবস আমেরিকার ইন্ডিয়ানায় টেরেহটে ১৮৫৫ সালের ৫ নভেম্বর এক ফরাসি অভিবাসী দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল ছেড়ে ১৫ বছর বয়সেই তিনি রোজগারের জন্য রেলশ্রমিকের কাজে যোগ দেন। সেখানে শ্রমিক ইউনিয়নে যুক্ত হন। অল্প দিনেই ২৫ বছর বয়সে তিনি দক্ষ রেলশ্রমিক ইউনিয়ন ব্রাদারহুড অব লোকোমোটিভ ইউনিয়নের মুখপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৮৯৩ সালে দক্ষ ও অদক্ষ সব ধরনের শ্রমিক নিয়ে তার উদ্যোগে গড়ে ওঠে আমেরিকান রেল ইউনিয়ন (অজট) এবং তিনি এর সভাপতি হন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৮৯৪ সালে শিকগোতে হয় বিখ্যাত পুলম্যান ধর্মঘট। ধর্মঘটি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনী নামে ও ডেবসকে আটক করা হয়। ৬ মাস জেল খাটেন তিনি। এই জেলে বসেই তিনি প্রথম কার্ল মাকর্সের ‘পুঁজি’ গ্রন্থটি পড়েন। ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে জেল থেকে বের হন এক বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়ে। ১৮৯৭ সালের ১ জানুয়ারি আদর্শগতভাবে রূপান্তরিত ডেবস অজট-এর সভায় ঘোষণা করেন, ‘বিষয়টা সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদের। আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষে, কারণ আমি মানবতার পক্ষে। স্বর্ণের শাসনের অধীনে আমরা বহুকাল ধরে অভিশপ্ত।’ ((Shawn Gude, Eugene Debs Believed in Socialism Because He Believed in Democracy, জ্যাকোবিন সাময়িকী, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০) কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই আমেরিকায় দেশজুড়ে ‘লাল ভীতি’ ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং শুরু হয় সমাজতন্ত্রীদের দমন-পীড়ন। সমাজতন্ত্রীদের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সমর্থক গোষ্ঠীর লোকজনকে ধরপাকড় শুরু হয়। বিশ^যুদ্ধের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রীদের ওপর রাষ্ট্রীয় মদদে এই নির্যাতন চর্চা আর বন্ধ হয়নি, বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধে সুশৃঙ্খল দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে এখানে। রাষ্ট্রের সর্বত্র এমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করে কারো পক্ষে পেশাগত জীবনে আগানো সম্ভব নয়। সুতরাং দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি মার্কিন সমাজে অনাদরণীয় হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দেশটিতে সমাজতন্ত্রের কথা বলা ছিল বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয় সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রæতে, বিশ^সাম্রাজ্যবাদের মোড়লে। তবু যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামেরও আছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের এ কেন্দ্রভ‚মিতে উল্টোচিত্র চিত্র দেখা যাচ্ছে, সমাজতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ নয়া উদারনীতিবাদী রাজনীতি, মুক্তবাজার, পরদেশ আক্রমণ ও দখল, প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংসসাধন, আয়বৈষম্যের ঊর্ধ্বগতি, অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গ মানুষের অধিকার হরণ ও অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা ইত্যাদির ঘাতপ্রতিঘাতে তরুণ ও যুবসম্প্রদায়ের চেতনায় মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ও ইউরোপের পতনের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই চরম ব্যর্থতা শিক্ষিত তরুণদের পুঁজিবাদের প্রতি মোহ কমাতে থাকে। তারা সমাজতন্ত্রের মানবিক আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক বিশে^র পূর্বের ভুলগুলো থেকে মুক্ত থেকে তারা এগিয়ে যেতে চায়। ২০১৬-এ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পতাকা হাতে বার্নি স্যান্ডার্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়ে এই প্রগতিশীল তরুণশক্তির ও শ্রমজীবী মানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন। নয়া উদারনৈতিক রাজনীতির নগ্ন পরিচয় বহন করে ক্ষমতায় আসেন রিপাবলিক্যান পার্টির ট্রাম্প। ফলে মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠে। স্যান্ডার্সকে ঘিরে তরুণদের আন্দোলন কেবল সারা আমেরিকায়ই ছড়িয়ে পড়ে না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘদিন পর এই প্রথম আবার যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট ও সামরিক শক্তি প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে। বার্নি স্যান্ডার্স যাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন সেজন্য উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক আপাত এই দুই পারস্পরিক শক্তি একজোট হয়ে যায়। স্যান্ডার্সকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল শক্তির বিজয়রথকে আপাতত প্রতিহত করা সম্ভব হয়। একশ বছর আগে দেশটির মহান সমাজতান্ত্রিক নেতা ইউজিন ডেবসের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল এবার যেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হলো। আজ যে পতাকার নিচে যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল শক্তি একত্রিত হয়েছে তা ডেবসের হাত থেকে ইতিহাসের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্যান্ডার্স, আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-কোর্তেজ ও ইলহান ওমরের হাতে এসে পৌঁছেছে। স্যান্ডার্সসহ এই সমগ্র প্রগতিশীল শক্তির অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন শতবর্ষ আগের মহান সমাজতান্ত্রিক নেতা ইউজিন ডেবস। যুক্তরাষ্ট্রের যে সংকটের বিরুদ্ধে ডেবস যুদ্ধ করেছিলেন তা দূর হয়নি, আরো ঘনীভূত ও জটিল হয়েছে। ডেবসের মানবিকতা, প্রতিশ্রুতি, দৃঢ়তা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা, স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর আকর্ষণীয় বিপুল ক্ষমতা ইত্যাদি বর্তমান প্রজন্মের সমাজতান্ত্রিক কর্মীদের অনিবার্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে। নরম্যান থমাস ও মাইকেল হ্যারিংটনের হাত ধরে আমেরিকান সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। মার্টিন লুথার কিংয়ের মাঝে অনেকে ইউজিন ডেবসের কণ্ঠস্বর শুনেছেন। (Paul Buhle I Mari Jo Buhle, The face of American socialism before Bernie Sanders? Eugene Debs, গার্ডিয়ান, ২৩ মার্চ ২০১৯) বার্নি স্যান্ডার্সের হাত ধরে সেই ধারাটি এক ঢেউ হয়ে এবার আছড়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বুকের ওপর। এই ঢেউয়ে পুঁজিবাদ কাবু হয়নি ঠিক, তবে তার ভিত্তিটা যে নড়বড়ে ভালোভাবে বোঝা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঢেউ কবে জোয়ার হয়ে দেখা দেবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের ও তরুণদের চোখে ভেসে উঠেছে পুঁজিবাদের পরের এক নতুন দিগন্ত। বাইডেন-কমলা জুটি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন এই ঢেউ ঠেকিয়ে রাখতে। যদি তারা ব্যর্থ হন, ট্রাম্পরা তো আছেনই শেষ ভরসা হিসেবে। লড়াইটা শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট শক্তি বনাম শ্রমজীবী জনগণের, পুঁজিতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্রের। বাইডেন আমলে এ দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আরো তীব্র হয়ে উঠবে। ডেবস-কিং-স্যান্ডার্সের সংগ্রামী ধারা এগিয়ে যাবে নতুন সূর্যোদয়ের দিকে। সে অগ্রযাত্রার প্রভাব পড়বে দুনিয়াজুড়ে। আলমগীর খান : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App