×

রাজধানী

সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ অকার্যকর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৩২ এএম

সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ অকার্যকর

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ।

নগরীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাত-দিন এ মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। কিন্তু মশা মারতে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করছে তা সম্পূর্ণ অকার্যকর। ফলে এ ওষুধ ব্যবহার করে মশা মারার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের তোপের মুখে পড়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। বাধ্য হয়ে কার্যকর ওষুধ চেয়ে মেয়র বরাবর চিঠি দিচ্ছে অনেকেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেজাল ওষুধ সরবরাহ, ট্রায়াল শেষ না হতেই ওষুধ ক্রয়, ওষুধে পানি মিশিয়ে ব্যবহারের ফলে কার্যকারিতা হারাচ্ছে মশানিধনের এসব ওষুধ। সংশ্লিষ্টদের দাবি, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের মার্চের পরে মশা নিয়ন্ত্রণের নতুন কার্যকর তেমন কোনো ওষুধ আমদানি করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। এছাড়া গত বছর ডেঙ্গু অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানোসহ মশা নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় কাজে গাফিলতি ছিল দুই করপোরেশনের। ফলে মশার ওষুধের কার্যকারিতার বিষয়েও ছিল না তেমন নজরদারি।

জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মো. ইব্রাহিম মশার ওষুধের কার্যকারিতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে একটি চিঠি দিয়েছেন করপোরেশনের মেয়র বরাবর। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৬৭নং ওয়ার্ডের জন্য সিটি করপোরেশনের বরাদ্দকৃত মশার ওষুধ যথা-নিয়মে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এলাকাবাসীর মন্তব্য প্রথমে যে মশার ওষুধ দিয়েছিলেন তার কার্যকারিতা ভালো ছিল। কিন্তু এখনকার ওষুধে সে রকম কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোসহ নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও হঠাৎ বিভিন্ন এলাকা থেকে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কারণ খুঁজতে দুই সিটি করপোরেশন কাজ করছে মশা গবেষকদের সঙ্গে। কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই জানান, বর্তমানে যে ওষুধগুলো বাবহার করা হচ্ছে সেগুলো গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের। যার কারণে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। এছাড়াও মশানিধনের কার্যকর ওষুধ পাওয়াই এখন সবচেয়ে জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করেও আশানুরূপ কার্যকর ওষুধ পাচ্ছে না সংস্থা ২টি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে গত বছরের শুরুতে ‘চতুর্থ প্রজন্মের’ লার্ভিসাইট ব্যবহার করার ঘোষণা দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ঘোষণা বাস্তবায়নে ট্রায়াল শেষ না হতেই অনেকটা তড়িঘড়ি করে যুক্তরাজ্য থেকে ৪৫ লাখ টাকার ‘নোভালিউরন’ নামে মশানিধনের একটি ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখছে উত্তর সিটি। গত অক্টোবর থেকে নোভালিউরন নামে এ ওষুধ সংস্থাটি ‘মসকিউরন’ ট্যাবলেট নামে ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু নতুন কোনো কীটনাশক বা ওষুধ আমদানি করে ব্যবহার করলে বেশ কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে যেতে হয়। নোভালিউরন একবার প্রয়োগ করলে কমপক্ষে ৯০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে বলে ডিএনসিসিকে জানায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘টেক ইন্টারন্যাশনাল’। কিন্তু সেই ট্যাবলেট এলেই ৯০ দিন পর্যন্ত কাজ করে কিনা, পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই ৪৫ লাখ টাকার বেশি ওষুধ কিনে নিয়েছে ডিএনসিসি। আবার ল্যাব ও মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আগেই কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে আমদানিকারককে। প্রায় ১২০টির মতো স্থানে এই ওষুধ প্রয়োগ করেছে সংস্থাটি। প্রতি কেজি নোভালিউরনের দাম ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩৮৬ টাকা ৫৫ পয়সা।

এই ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি ল্যাব ও মাঠপর্যায়ে পরীক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছে ডিএনসিসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সহযোগী অধ্যাপক তাহমিনা আক্তারের তত্ত¡াবধানে জনপ্রতিনিধিসহ ডিএনসিসির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসব পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। যেসব প্রাণীর দেহে ‘কাইটিন’ নামে একটি উপাদান রয়েছে, শুধু সেসব প্রাণীর লার্ভার বৃদ্ধি ঠেকিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই ওষুধ। মশার লার্ভায় কাইটিন নামে একটি উপাদান থাকায় স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে তা মশার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নোভালিউরন এমনটাই দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের দাবি নোভালিউরনে মশা মরছে না।

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, মশানিধনে ধাপে ধাপে কাজ করছি। সিনিয়র কীটতত্ত¡বিদদের সঙ্গে বৈঠক করে কিউলেক্স নিধনে আলাদা পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ কাজে লোকবল না বাড়িয়ে নতুন প্রযুক্তির মেশিন আনার ক্ষেত্রে গুরত্ব দিচ্ছি। মশা মারার পুরান মেশিন বদলে ফেলে উন্নত প্রযুক্তির ‘আলটা ইউএলপি’ মেশিন ইতোমধ্যে নিয়ে এসেছি। এছাড়া চতুর্থ প্রজন্মোর ওষুধ এনেছি (ট্যাবলেট) যেগুলো পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে। মশা মারতে ‘নোভালিউরন’ অত্যন্ত কার্যকর বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তা বেশির ভাগই মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং মিক্সিং। অতিরিক্ত পানি মিশিয়ে ওষুধ ছিটানোয় তা কোনো কাজে আসত না বলে স্বীকার করেন দক্ষিণ সিটির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন রতন। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধগুলো আগে কালোবাজারে বিক্রি হতো। এরোসল কোম্পানি ও কয়েল কোম্পানিতে বিক্রি হতো। আবার এরাই ওষুধ কিনে নিয়ে নগর ভবনের ওষুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে দিত। ওষুধ কাজ করছে না কারণ ওষুধে ভেজাল দেয়া হচ্ছে।

এদিকে গত বছরের শেষের দিকে মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় এসিআই ফর্মুলেশন লিমিটেডের সরবরাহ করা একলাখ লিটার ওষুধ ফেরত দিয়েছে ডিএসসিসি। ৯-১০ মাসে একাধিকবার দরপত্র আহŸান করেও ভালো মানের ওষুধ না পাওয়ায় তা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ। এর আগে বিদেশ থেকে ম্যালাথিয়ন ৫ শতাংশ আমদানি করে ডিএসসিসি। আমদানি করা এ ওষুধটি সরাসরি ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় এর সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ডিজেল ও ২৫-৫০ এমএল সাইট্রোনেলা মিশিয়ে ছিটাতে হয়। কিন্তু এ কাজ করার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো প্রযুক্তি নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেজাল ওষুধ সরবরাহের দায়ে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান- দ্য লিমিট এগ্রো প্রোডাক্টকেই ওষুধ ক্রয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বাছাই করেছে ডিএসসিসি। ওই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে উড়ন্ত মশানিধনে ব্যবহৃত ‘মেলাথিয়ন’ ওষুধ চীন থেকে ডিএসসিসি আমদানি করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করার দায়ে দ্য লিমিট এগ্রো প্রোডাক্টকে কালো তালিকাভুক্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

মিরপুর-৬ এলাকায় বাসিন্দা হাফেজ উদ্দিন বলেন, প্রায়ই সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। তাও কেন মশা কমে না। মশার যন্ত্রণায় টিকে থাকা কষ্টকর। ঘরের মধ্যে, গলির সড়কের কোথায়ও কিন্তু ময়লা-আবর্জনা নেই। তারপরও রয়েছে মশার উপদ্রব। ওষুধ কেন কার্যকর হচ্ছে না বিষয়টা করপোরেশনের খতিয়ে দেখা উচিত।

জাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেন, মশার যে উপদ্রব তা যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে লার্ভিসাইডিং পদ্ধতিতে জোরালো মনিটরিং করতে হবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর যদি লার্ভিসাইড করা না হয় তবে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App