হে সম্রাট কবি
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৩৩ পিএম
যে দেশের প্রেসিডেন্ট ঢের কবিতা লিখেও কবির স্বীকৃতি পাননি সে দেশের নাগরিক হয়ে কবিতা না লেখা শাসককে ‘হে সম্রাট কবি’ বলে সম্বোধন করার ধৃষ্টতা আমি দেখাব না, এটাই সত্যি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি এভাবে সম্বোধন করেন তার প্রতিধ্বনি যে দোষণীয় হবে না, এটা জেনেই শিরোনাম তুলে এনেছি তার কবিতা থেকে। হে সম্রাট কবি এই তব হৃদয়ের ছবি এই তব নব মেঘদূত অপূর্ব অদ্ভুত ছন্দে গানে উঠিয়াছে অলক্ষের পানে...
রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান’-এর কথা : তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি এড়াইয়া কালের প্রহরী চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়াÑ ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া মমতাজ মহলের জন্য শাহজাহানের প্রেমের ঘনত্ব নিয়ে যত সন্দেহ-চর্চাই হোক না কেন রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রেমের সিংহাসনেই স্থায়ী আসন করে দিয়েছেন। সন্দেহ নেই, বাবরের মতো উদ্যম ও মেধা আকবরের মতো জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন না তিনি, মোগল সম্রাটদের কট্টর সমালোচক রামপ্রাণ গুপ্ত ১৩১১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘মোগল বংশ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : ‘কেবলমাত্র শূন্যগর্ভ বাহ্যাড়ম্বরেই শাহজাহানের শাসনকাল অতিবাহিত হয় নাই। বস্তুত তাঁহার সময়েই মোগল সাম্রাজ্য উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হইয়াছিল। আকবর শাহ প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ অধিকৃত করিয়া সাম্রাজ্যের শাসন সংরক্ষণের সুবন্দোবস্ত করেন। শাহজাহানের অধ্যবসায়ে আকবরের প্রবর্তিত ব্যবস্থা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। অন্তর্ব্বিগ্রহ শাহজাহানের রাজত্বকালে ছিল না। ...তিনি কখনো রাজকার্যের পর্যালোচনায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করেন নাই, শাসনকার্যের শৃঙ্খলা বিধানে সর্ব্বদা অবহিত থাকিবেন। তিনি রাজকর্ম্মচারী নিয়োগকালে প্রতিভাশালী কার্যদক্ষ প্রতিষ্ঠাপন্ন ব্যক্তিদিগকে মনোনীত করিতেন।’ আমরা একালে যাকে গুড গভার্নেন্স বা সুশাসন বলি তা-ই ছিল শাহজাহানের শাসনব্যবস্থার মূল শক্তি। তিনি প্রজাহিতৈষী ছিলেন এবং প্রজাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। তার অধিক্ষেত্রে পরিবারের কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেননি। ফলে ‘শাসনকার্যের শৃঙ্খলা স্থাপনে, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানে ও রাজকার্যের সুচারু পরিচালনে ভারতবর্ষের কোনো নরপতিই শাহজাহানের সমকক্ষ ছিলেন না।’ বিদেশি পর্যটক ট্যাভার্নিয়ার লিখেছেন, শাহজাহানের রাজ্যে চোরদস্যু ও রাজপুরুষদের অত্যাচার বলতে গেলে ছিলই না। ফলে আর্থিক কর্মে ব্যাঘাত ঘটেনিÑ এতে একদিকে যেমন প্রজাদের হাতে অর্থ এসেছে, তাদের করের টাকায় রাজকোষও ক্রমাগত স্ফিত হয়ে উঠেছে। সেই অর্থে বড় সড়ক নির্মাণসহ দিল্লি ও আগ্রা নগরীকে সৌন্দর্য সৌধের নগরীতে পরিণত করতে পেরেছেন। ‘বাদশাহ’ শাহজাহানের প্রধান শক্তি ছিল সাম্রাজ্যের রাজকোষ। তার সময়েই ভারতবর্ষ বিদ্রোহীদের হাতে কিংবা বহিঃশক্তির হাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে কম। তিনি সীমান্তে সমরে লিপ্ত হয়ে একদিকে দেশ রক্ষা করেন, অন্যদিকে সীমান্ত সম্প্রসারণ করেন। এতদিনের অজেয় আহমদনগর, গোলকুন্ডা ও বিজাপুর মোগল মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়।
মোগল মিনেয়েচার পেইন্টিং সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী শাহাবউদ্দীন মুহাম্মদ খুররম চতুর্থ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পুত্র, মা মারওয়ারের রাজকুমারী রাজপুত নারী জগৎ গোসাইনি, ধর্মান্তরিত হয়ে বিলকিস মাখানি; খুররমের জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৫৯২ লাহোরে। তিনি জাহাঙ্গিরের তৃতীয় পুত্র এবং যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশলে জাহাঙ্গিরের অন্য যে কোনো ওয়ারিশের চেয়ে সাম্রাজ্যের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। তিনি ১৩ বছর পর্যন্ত লালিত হন সম্রাট আকবরের নিঃসন্তান স্ত্রী, শাহজাহানের সৎ দাদি রোকাইয়া সুলতানা বেগমের কাছে। সম্রাট জাহাঙ্গির ও তার বড় ছেলে খসরুর (শাহজাহানের বৈমাত্রেয় ভাই) ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব শাহজাহান নীরব দর্শক ছিলেন। জাহাঙ্গির খসরুকে দমন করার পর শাহজাহানের অনুরক্ত হয়ে উঠেন এবং স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর সমর্থন নিয়ে তিনি ভারত সম্রাটের আসনে বসেন এবং ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত প্রায় নিরুপদ্রব শাসন চালিয়ে যান।
স্থাপত্য ও নগরায়ণ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই সম্রাটের শঙ্কিত হৃদয় সৌন্দর্যে ভুলায়ে সময়ের হৃদয়হরণ করতে চেয়েছে। শাসনের পাশাপাশি ক্রমাগত সৌন্দর্য সৃষ্টি করে চলেছেন। স্থাপত্য-সৌন্দর্য কৈশোর থেকেই তাকে আকৃষ্ট করেছে। যখন ক্ষমতাসীন হলেন একদিকে পুরনো সৌধ যেমন মেরামত করালেন তেমনি সৃষ্টি করলেন নতুন স্থাপনা-শৈল্পিক বিচারে তার কোনোটাই বিশ^মানের নিচে নয়। কেবল তাজমহল নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ। তার নির্দেশে ও তত্ত¡াবধানে নির্মিত সৌধসমূহের মধ্যে রয়েছে দিল্লির রেড ফোর্ট বা লাল কেল্লা, জামে মসজিদ, ওয়াজির খান মসজিদ, মতি মসজিদ, শালিমার বাগ, আগ্রা ফোর্ট ও লাহোর ফোর্টের উল্লেখযোগ্য অংশ, পেশোয়ারের মহব্বত খান মসজিদ, সম্রাট জাহাঙ্গিরের সমাধি (সমাধি নির্মাণ তত্ত¡াবধান করেছেন শাহজাহানের সৎমা নূরজাহান)। (যাকে নিয়ে নজরুলের বিখ্যাত গান : নূরজাহান/নূরজাহান, সিন্ধু নদীতে ভেসে, এলে মেঘলামতির দেশে/ইরানি গুলিস্তান।) সিন্ধুর থাট্টায় নির্মিত শাহজাহান মসজিদ তারই কীর্তি। ১৬৪৭ সালে নির্মাণ সমাপ্ত হওয়া এই মসজিদ পৃথিবীতে সর্বাধিক সংখ্যক গম্বুজের সর্ববৃহৎ মসজিদ। শাহজাহানের প্রায় সকল কীর্তি বিশ^ ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে। শাহজাহানের সময় আগ্রা শহর এতটাই সুসজ্জিত হয়ে উঠেছিল যে, সেখানে সৌধমালার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতিরও বহুল বিকাশ ঘটেছে। ম্যান্ডিস্নোর বর্ণনায় আগ্রা পারস্যের ইস্পাহান শহরের দ্বিগুণ আকৃতির সুদৃশ্য নগর; সেই নগরের রাজপথ প্রশস্ত, শোভন বৃক্ষরাজি, সুদৃশ্য পণ্যবীথিকা, অসংখ্য স্নানাগার ও পথের প্রান্তের স্বাগত জানানো এমন পান্থশালা কোথাও নেই। শাহজাহানের সময় ভারতে আগত পর্যটক ম্যান্ডিস্নো লিখেছেন, দিল্লি, আগ্রা, গুজরাটের সমৃদ্ধির কথা, ট্যাভার্নিয়ার লিখেছেন সার্বিকভাবে ভারতে ঐশ্বর্যের কথা।
স্থিতির পরিমাণ ২৪ কোটি মুদ্রার অধিক) যুদ্ধহীন শান্তিপূর্ণ দেশ, প্রজার সন্তুষ্টির কোনো কমতি নেই, তবুও সম্রাট শাহজাহানের ব্যক্তিগত জীবনে, অন্তত শেষ অধ্যায়ে সুখ ও শান্তি ছিল আলেয়ার মতো- কারণ তার উচ্চাভিলাষী চারপুত্রের পরস্পরের প্রতি বৈরীভাব এবং সহিংসতা। রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেছেন ‘পাদশাহ (বাদশাহ, ফার্সি উচ্চারণে) ভ্রাতৃবর্গের মনোমালিন্যের মূলোচ্ছেদ কবিবার অভিপ্রায়ে তাঁহাদিগকে কার্যভার প্রদান করিয়া দূরদেশে প্রেরণ করেন। সুজা বঙ্গদেশের, আওরঙ্গজেব দক্ষিণাত্যের এবং মুরাদ গুজরাটের শাসন-কর্ত্তার পদ লাভ করেন। দারা সর্ব্বো জ্যেষ্ঠ, সিংহাসনের অধিকারী বলিয়া রাজ সন্নিধান্যেই থাকেন।’ সম্রাট হিসেবে দায়িত্বরত থাকার শেষ বছর তিনি অসুস্থ হলে গুজব রটে যায় যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুবরণ করেছেন। অমনি সুজা ও মুরাদ নিজেদের সম্রাট ঘোষণা করলেন এবং রাজধানী দখল করতে এগোলেন। দারার বাহিনীর হাতে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর সুজা পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব কৌশলী, তার ক্ষমতালিপ্সা গোপন করেন এবং মুরাদকে ক্ষমতাসীন করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে তার সাথে জোট বেঁধে দিল্লি আক্রমণ করে দারার বাহিনীকে পরাস্ত করেন, সম্রাট শাহজাহানকে বন্দি করেন এবং পলায়নরত দারাকে ধরে এনে হত্যা করে তার কর্তিত মুণ্ডু রাজকীয় রেকাবে স্থাপন করে কারারুদ্ধ শাহজাহানের কাছে প্রেরণ করেন। আর হতভাগ্য মুরাদও বন্দি হন এবং রাজ-পরিবারের একটি হত্যাকাণ্ডের দায় তার ওপর চাপিয়ে তাকেও মৃত্যুদÐ দিয়ে আওরঙ্গজেব পরবর্তী ৫০ বছর ভারত সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকার পথ কণ্টকহীন করে ফেলেন। চরম মর্মবেদনা নিয়ে সাত বছরের বন্দিজীবন জানালাপথে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থেকে, নিঃশব্দ অশ্রæপাত করতে করতে ২২ জানুয়ারি ১৬৬৬ মোগল সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ও প্রজাহিতৈষী শাহজাহান মৃত্যুবরণ করেন। মোগল স্থাপত্য মূলত ইসলামি পারসিক ও ভারতীয় স্থাপত্যের একটি মিশ্রণ। যমুনার তীরবর্তী আগ্রায় ৪২ একর জায়গার ওপর শাহজাহান তার প্রয়াত স্ত্রী মমতাজ-মহলের সমাধিসৌধ হিসেবে তাজমহল প্রতিষ্ঠা করেন। তা একক কোনো স্থপতির কীর্তি নয়। বিভিন্ন দেশীয় মেধাবী স্থপতি ও শিল্পীর সম্মিলিত উদ্যোগে নির্মিত। মূল সমাধির নির্মাণ কাজ ১৬৪৮ সালে শেষ হয়। ১৬৬৩ সালে আগ্রা ভ্রমণকারী ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের লেখেন, দুটো সৌধ আগ্রার মর্যাদা দিল্লির ওপরে স্থাপন করে একটি আকবরের সমাধি, অন্যটি মমতাজ মহলের, এখানেই শাহজাহানও শায়িত। বনফুলের তাজমহল সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের অমর স্মৃতিসৌধ বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘তাজমহল’-এর পাশাপাশি ভিন্ন এক গল্পের তাজমহল গড়ায় হাত দিয়েছেন বনফুল। গল্পের লেখক আগ্রার একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ে চাকরি নিয়ে এসেছেন; তিনি চিকিৎসক। শুরুতে তাজমহলের বৈভব দেখে আর সম্রাট শাহজাহানের কাহিনী শুনে তিনি মুগ্ধ। কিন্তু একটি ঘটনা তাকে তাজমহল সম্পর্কে মোহমুক্ত করল। এক ‘দরিদ্র’ বৃদ্ধ মুসলমান ঝুড়িতে বসিয়ে তার বোরকাপরা অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে, এই ডাক্তারকে দেখাবে। তার ফি দেবার সামর্থ্য নেই। বোরকা সরাতেই ডাক্তার ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ পেলেন, তার মুখ ও গালের মাংস পচে গেছে, অসুখটার নাম ‘ক্যাংক্রাম ওরিস’, হাসপাতালের ওয়ার্ডে জায়গা নেই, তাকে বারান্দায় রাখা হলে দুর্গন্ধে অন্য রোগীদের টেকা দায়; কম্পাউন্ডার, ড্রেসার এমনকি মেথর পর্যন্ত তার কাছে যেতে চায় না। অগত্যা হাসপাতালের বাইরে একটি গাছের নিচে বুড়ো তার স্ত্রীর শোয়ার ব্যবস্থা করে, বুড়োই সারা দিনরাতের সেবক, ডাক্তার মাঝে মাঝে গিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে আসেন। একদিন প্রবল বৃষ্টিতে ডাক্তারের চোখে পড়ল বুড়ো চাদরের আচ্ছাদনে বৃষ্টি ঠেকাতে চেষ্টা করছে আর অসুস্থ স্ত্রী ভিজে একেবারে চুপচুপে। ডাক্তার বললেন, আপাতত বারান্দাতেই নিয়ে এসো। বুড়ো প্রশ্ন করে, তার বেগমের কি বাঁচার আশা আছে? ডাক্তার সত্যটাই বলেন, না নেই। পরদিন আর দু’জনের কাউকে দেখা গেল না। কয়েকদিন পর ডাক্তারের চোখে পড়ল বুড়ো ভাঙা ইট আর কাদা দিয়ে একটা কিছু গাঁথার চেষ্টা করছে। কি করছে জিজ্ঞেস করতেই বলল, বেগমের কবর গাঁথছি হুজুর। আরো দু’একটি কথার পর ডাক্তার বুড়োর নাম জিজ্ঞেস করলে বলল, ফকির শাহজাহান। সমাজে সংসারে আরো কিছু ফকির শাহজাহানের দেখা মেলে, কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য ভালোবাসার সৌধ নির্মাণ করে যেতে পারে না বলে তারা অতলে তলিয়ে যায়। অদৃশ্য তাজমহল নিত্যই নির্মিত হচ্ছে। নজরুলের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি স্মরণ করতে হয় : হয়তো তোমারে দেখিয়াছি, তুমি যাও নও তাই ক’রে ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে? সুন্দর যদি করে তোমারে আমার আঁখির জল হারা-মোমতাজে লয়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজম’ল বল তাহে কার ক্ষতি তোমারে লইয়া সাজাব না ঘর, সৃজিব অমরাবতী।