×

সাময়িকী

মমতাজের মৃত্যু ও শাহজাহানের হিন্দুস্তান বিক্রয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৫৭ পিএম

মমতাজের মৃত্যু ও শাহজাহানের হিন্দুস্তান বিক্রয়

অনেকের ধারণা-বিশ্বাস, গান যে ভালোবাসে না খুন করতে পারে সে, আর প্রেম যে করেনি কখনো গান শুনে তার চিত্তে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তবে সে খুনি হয় না। আরও বিশ্বাস যে প্রেমিকের হৃদয় হলো পুষ্পসম্ভার, কোমল ও নির্মল পবিত্র। দর্শনে যাই থাকুক, ডেসডেমোনার খুনিকে প্রেমিক না বলে উপায় নেই, তার পাপ আরো তিক্ত সে যখন জানলো যে নিজের প্রেমকে সে হত্যা করেছে, তাই দেহ তার জীবিত থাক চায়নি। প্রেমের জন্য আত্মহত্যা স্বাভাবিক, কিন্তু সে খুনি হয় না কখনো। আত্মহত্যার আগে নিজেকে সাজায় তারপর মৃত্যুকে সেটা নিবেদন করে। মৃত্যুকে মনে করে তার প্রেমিক বা প্রেমিকা। যে যাই বলুক, শাহজাহানকে কিছুতেই প্রেমিক বলা যায় না। যখন তিনি শাসনকর্তা ছিলেন না তখন হয়তো বা কিছুটা প্রেমিক হতে পারেন, কিন্তু বাকি তার জীবনকাল একজন নিষ্ঠুর অপ্রেমিকের জীবনের চাইতে নিকৃষ্ট ছিল। নূরজাহানের কোনো প্রেম অনুভূতি ছিল না, যাকে মিনাবাজারে প্রেম বিক্রি করতে গিয়েছেন এবং পরে জেনেছেন সে প্রেমিক নয়, রূপসন্ধানী নারী, শিকারি মাত্র; আর যদি বাধ্য হয়ে ফরমান দ্বারা বন্দি হয়ে হেরেমে আসতেন কোনো প্রেমিককে তিনি কখনো দেখতে পেতেন না। তাই শের আফগানের সঙ্গে বজরায় উঠলেন অত্যন্ত স্বস্তিতে পালাতে পারলেন। শের আফগানকে যে তিনি ভালোবাসতেন সে কথাও ঝুট, অর্থাৎ তার চিত্তে কখনো প্রেমের উন্মেষ ছিল না, অথচ দুনিয়া বলে নূরজাহান হলেন প্রেমের আলো, সেটা না ভেবেই বলেন। কিন্তু মমতাজ তা নন, সত্যিকারে কিশোর প্রেমের বাস্তব মানবী তিনি। দুনিয়াতে কিশোর প্রেমের কথাতে উন্মাদ সবাই, মজনুর প্রেম মুছিয়ে দেবার জন্য কাবার সামনে নেয়া হলে সে কাবাকে জড়িয়ে ধরলো; জানালা দিয়ে চাঁদ উঠেছে মেঘের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে। রোমিও রোমিও করে কিশোরী উন্মাদ হয়ে চাঁদকে ডাকছে। কিন্তু এসব ছবি বাস্তবে কোথাও ওঠেনি, কবির কল্পনা থেকে পাওয়া গেছে। আশ্চর্য যে, কবিও বলতে পারেন না মজনু কে বা রোমিও কে, তবে কিশোর প্রেমের ছবি আমাদের হাতে বাস্তবেই আছে মমতাজ। মজনু কিংবা রোমিওর স্মৃতিসৌধ নেই, মমতাজের স্মৃতিসৌধে ভিড়। প্রত্যেকের জীবনে কিশোর প্রেম থাকে সেটা কাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না, অন্তত মমতাজের পাথরকে জড়িয়ে ধরা যায়, হোক মৃত্যু তাতে কী? মৃত্যু তো একদিন হবেই, কিন্তু যে প্রেমকে ধরতে পারিনি জানবে তাকে জড়িয়ে মৃত্যুই সার্থক। তাহলে শাহজাহান কেন, তিনি তো প্রেমিক নন হয়তো বা আবার সাতষট্টি বছর বয়সে সতেরো বছরের বালিকা ধর্ষণ কী করে করেছিলেন? অপ্রেমকে প্রেমের জৌলুস দিয়ে জগতে তিনটি রমণী অসীম শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাদের এই রূপের যুপকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছে অনেকে, অনেকে এখনো তাদের স্তুতিগানে বিশ্ব মুখরিত রাখে। তাদের ভেতর মিসরের রানি ক্লিওপেট্রা, তার প্রেমের জন্য কত যুদ্ধ হয়েছেÑ কত লেখক সেসব কথা লিখতে লিখতে মরেছে। এখনো সে ধরনের দৃষ্টান্ত তাকে স্মরণ করেন, কিন্তু তিনি কখনই কোথায় কাকে ভালোবেসেছিলেন। এবং প্রেমের জন্য একটু ত্যাগ স্বীকার করেছেন কেউ জানে না। রানি ক্যাথেরিনের রূপ সৌন্দর্য ক্ষমতায়ন চারদিকে সমস্ত যুবক চিত্তের মৌচাকটি, কত কঠিন ফুলবন থেকে মধু নিয়ে এসে তাঁর চিত্ত ভরতে চেয়েছেন তার হিসাব নেই। আর নূরজাহান, তাঁর কথা তো আমাদের জানাই আছে। ভারতেশ্বরী তিনি, তার ক্ষমতা এমনই তুঙ্গে উঠেছিল যে, রূপের মোহে সম্রাটও দগ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু এমন রূপরূপিণী, শক্তিরূপিণী মনতস্য পুজোর স্ত্রোত্র লাভ করেছে বিশ্বের কাছে। আর শাহজাহান প্রেমিক হিসেবে পুজো পাচ্ছেন তেমনি, অথচ তাঁকে প্রেমিক বলতেই পারা যায় না। বড় ভাই খসরুকে তিনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বাদশাহী মসনদ নিরঙ্কুশভাবে মুক্ত করেন। অভিষেকের পরদিন আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রি আগ্রা দিল্লিতে যারা ভবিষ্যৎ সিংহাসনের দাবিদার হতে পারেন অর্থাৎ তাঁর ভ্রাতৃবংশ কিংবা অন্য কোনো মোগল যে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে সিংহাসন দাবি করার সম্ভাবনা আছে এমন কেউ রেহাই পায়নি, লিস্টি করা আছে তা ধরে কাউকে রেহাই দেয়া হলো না, এক গোপন নির্দেশে রাতের আঁধারে খতম করা হলো। তাজমহল তৈরি করেছিলেন যারা সেই বিশ হাজার লোকেরও একই দশা হয়েছিল একই রাতে। তিনি নিজের কন্যার প্রেমিককে পানিতে সিদ্ধ করে মারেন, কাউকে ক্ষমা করেননি, কেবল আওরঙ্গজেবকে পারেননি, বলা হয় পুত্রমোহে তিনি অন্ধ ছিলেন। আওরঙ্গজেব সবকিছু জানতেন, আর একদিন আক্রমণ করতে দেরি হলে শাহজাহান তার মুণ্ড খসিয়ে নিতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব নিষ্ঠুর ছিলেন না, পিতাকে হত্যা করেননি, বন্দি করে রেখে তার সমস্ত সুখবিলাসেরও জোগান দিয়েছেন। ইতিহাসে এমনটি আর দৃষ্টান্ত নেই। প্রেমিক যারা তাজমহলে যায় মমতাজের জন্য শুধু শুধু শাহজাহানের পাথরটা রাখা হয়েছে তাঁর পাশে। কেউ প্রেমে বিলকুল নিজেকে জীবনশূন্য মনে করলে মমতাজ পাথরকে জড়িয়ে ধরে নরনারী এবং শাস্তি হিসেবে সুড়ঙ্গপথে যমুনায় চলে যায় ভাসতে, অথবা পেশীরা সজাক থাকলেও টুক করে কখন দোতলা বা তিনতলা থেকে মমতাজ পাথরে পড়ে জীবন দেয়, কিন্তু তেমনি ভুলে কেউ শাহজাহান পাথরে পড়তে পারে না, প্রেমিক-প্রেমিকরা মমতাজ পাথরে ফুল দেয় যারা শুধু তাজমহলে দেখতে যায় আর ভেতরে দর্শন তাদের কেউ অযথা শাহজাহান পাথরে ফুল রেখে আসে। অথচ সে পাথরের ফুল গ্রহণ করার অধিকার নেই। যা হোক, যে নূরজাহান ভাইঝিকে নিজের জিদের কারণে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেই ভাইঝি ফুপির ষড়যন্ত্রের লড়াইতে জিতে গেলেন। আরজুমন্দ বাদশাহী বেগম হওয়ার পর ভাগ্যের কী পরিহাস, মমতাজ মাত্র চার বছর বেঁচেছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর শাহজাহান-মমতাজের দাম্পত্য জীবন কাটে। ১৬৩১ খ্রিস্টাবে এ অতুল ঐশ্বর্য দুনিয়া শ্রেষ্ঠ তাঁর প্রেমিক বাদশা এবং সাতটি পুত্র-কন্যা ও আত্মীয়দের ছেড়ে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে তাঁকে চিরবিদায় নিতে হলো। যৌবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়ে এ কঠিন আঘাত নিষ্ঠুরকাল সহ্য করতে পারলেও কালে কালের মানুষ সহ্য করতে পারেনি, সকলের চিত্তে মমতাজ মমতাজ কান্না গুমরে মরেছে। এই কুড়ি বছর দাম্পত্য জীবনে প্রতি দুই বছর কি তিন বছর অন্তর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হতেন। শাহজাহান এ সময় অন্য কোনো নারীতে আসক্ত হওয়া তো দূরের কথা, কারো দিকেও তাকিয়ে দেখেননি। ঐতিহাসিকরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, রামচন্দ্র হলেন শাহজাহান শুধু সীতা চিন্তায় থাকতেন, রামচন্দ্রও চিরকাল এক সীতায় জীবনÑ এখন সন্দেহ করা হয়, ল²ণ পিতৃসম বড় ভাইকে সীতার প্রতি অবিচার করাতে গদা হাতে নিয়ে মারতে চেয়েছেন, রামচন্দ্রর সীতার প্রতি বিশ্বাসহারা হয়ে তাকে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু যেটুকু জীবনে শাহজাহান মমতাজ বেঁচেছিলেন। পত্নী প্রেমের একনিষ্ঠতার দোহাই এমনি বোধ হয় দুনিয়াতে আর কোথাও নেই। তবে শাহজাহান প্রায় চৌদ্দজন পুত্র কন্যার জনক ছিলেন, তার ভেতর মাত্র সাতজন হলো মমতাজের গর্ভের। অন্যগুলোর দায়িত্ব শাহজাহানের নয়, তিনি সে জন্য বাধ্য হয়েছিলেন, নিজের আগ্রহে সেসব নয়, বাদশাহী রেওয়াজের এ হলো অন্ধকার দিক। মাত্র একশত বছর আগেও ধনী-ঐশ্বর্যশালীরা ঘরের বউ রেখে বাইজি আস্বাদন করতেন, নইলে কিসের জমিদারি আভিজাত্য? কলকাতার বাবু বা মোগল সে ঐতিহ্য অনুসরণ করতেন, সে কথা সবাই জানে, তার ভেতর শাহজাহানের কুড়ি বছরে দাম্পত্য জীবনের এই কুড়ি কখনো ইতিহাস থেকে পড়ে যাবে না। এতগুলো পুত্র-কন্যা বাড়তি থাকলেও মমতাজের প্রতি একনিষ্ঠতার প্রশ্ন এই কারণে উত্তরহীন। দুজনের ভেতর প্রথম পরিচয়ের পর দীর্ঘ সাড়ে চার বছরে কঠোর প্রতীক্ষা এবং দাম্পত্য জীবনে শাহজাহান একদিনের জন্যও মমতাজকে ছেড়ে বাস করেননি। এ সময় মমতাজ তাঁকে হাতে তুলে তার যে আহার তা অতি আদরে পরিবেশন করলে তবে তাই তিনি মুখে তুলতেন। শাহজাহানের খাওয়ার আগে মমতাজ নিজে একটুখানি না খাইয়ে তাকে খেতে দিতেন না, বা যাকে দিয়ে আহার্য দ্রব্য রান্না করা হতো তাকে তার থেকে তুলে খাওয়ানো হতো। সম্রাটের পরিধানের জন্য পোশাক মমতাজ স্বহস্তে নির্বাচন করতেন, সকাল দুপুর বিকেল ও রাত্রি বেলার আলাদা আলাদা দিনের রঙ মেপে, শীত গ্রীষ্ম বর্ষাও সে মাপে ছিল। তাই শাহজাহানকে পরতে হতো, ঠিক সময়ে মমতাজ পোশাক হাতে নিয়েই এলেই শাহজাহান বুঝতেন এখন দরবারের নকিবের আওয়াজ শুনবেন, দপ্তরের যাবতীয় কাজকর্মের ভেতর ফাইল বন্ধনে মমতাজের পরামর্শ লুকিয়ে থাকতো, শাহজাহান খুলে মাত্র তা বুঝতে পারতেন, মীর মুন্সির সহায়তার জন্য অপেক্ষা করতেন না। দিল্লির জুমা মসজিদ শাহজাহান নির্মাণ করেছেন, জুমার দিন বাদশা সেখানে নামাজ আদায় করতেন, সেদিনের পোশাক এবং সঙ্গী-সহচরদের যাবতীয় মিছিল সহকারে বাদশাহের যাওয়া এবং নিরাপত্তার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর হাতে ছিল। প্রত্যেক জুমার দিন কে কে যাবেন মমতাজ আগে থেকে তার গোপন তালিকা করে রাখতেন। দিওয়ান-ই-খাস ও দিওয়ান-ই-আম তাদের জন্য প্রতিনিধি বা সপ্তাহে সেদিন সম্রাট জনসাধারণ কিংবা পরিষদবর্গের সঙ্গে মিলিত হতেন তার আগাম তালিকা ও অনুমতি মমতাজের হাতে ছিল। শাহজাহানও অতি তেজস্বী সম্রাট ছিলেন কিন্তু তার তেজস্বীতার উৎস ছিল মমতাজ। জাহাঙ্গির ও নূরজাহানের শাসন অব্যবস্থার দরুন সমগ্র হিন্দুস্তান অচল হয়ে পড়েছিল। শাহজাহান শাসনভার গ্রহণ করে যুদ্ধ ও শাসন ব্যবস্থা মজবুত করার জন্য কাবুল থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বারবার তাকে অবিরাম ছোটাছুটি করতে হয়েছিল। সঙ্গে মমতাজ সম্রাটের ছায়া হয়ে ছুটেছেন, কোথাও একটু হোঁচট খেলে সামলে নিয়েছেন। সর্বশেষ ১৬৩১ সালে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমন করতে বুরহানপুরে যেতে হয়েছিল। সে সময় মমতাজ আসন্ন সন্তানসম্ভবা। চিকিৎসকের কঠোর নিষেধ সত্তে¡ও মমতাজ সম্রাটকে একা যেতে দিতে রাজি হননি। নিরুপায় সম্রাট মমতাজের মনোবলের ওপর নির্ভর করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজি হন। কিন্তু যাত্রা পথের ধকল সইতে না পেরে মমতাজ সপ্তম সন্তানটি গওহরআরাকে জন্ম দিয়েই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। পার্শ্ববর্তী কক্ষে অবস্থানরত সম্রাটকে গভীর রাতে জানানো হয়েছিল মমতাজের জীবন সংকটের কথা, সে সময় মমতাজের আশপাশে দুজন বাদী ও দুজন চিকিৎসক হেকিম। তারা বললেন, হুজুর জাঁহাপনা নিরুপায়, সম্রাট হাঁটু ভেঙে শয্যাপাশে বসলেন, রোগ পাণ্ডুর প্রিয়তমার হাতখানি তুলে নিজের হাতে নিলেন, কিন্তু কোনো কথা মুখে উচ্চারণ করলেন না, কেবল চোখের পানিতে যা বলতে পারেন। মমতাজের তখনও বাকশক্তি রোধ হয়নি, তার দুচোখে অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছিল। মমতাজ কী যেন বলতে চাইলেন। শাহজাহান ঝুঁকে পড়ে তার কথা শোনার চেষ্টা করলেন, বিদায় মুহূর্তে আঁখির আর্জি এবং অস্পষ্ট স্বরে ফিস ফিস করে বললেন, শাহেনশাহ, আপনার প্রেমের এ অশ্রু যেন আমার কবরের ওপর প্রস্ফুটিত হয়, আর কিছু বলার আগেই সব শেষ। শাহজাহান তারপর সেখানে লাজবাব পাষণ হয়ে বসে রইলেন, তাঁর পাশে তাঁর জীবনের অংশ লাজবাব একটি জড় পদার্থ লাশ যা তার প্রিয়তমা মমতাজ। এখন তুচ্ছ একটা ইট কাঠ পাথর মাত্র। তবে প্রসূতির কক্ষ হতে কোনো মতে তাকে সরানো হলো। নির্বাক একটা পাষাণকে টেনে পাশের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। কী অদ্ভুত, সে কক্ষে ঢুকে সে পাষণ একটু পরে কী করে কক্ষের অর্গল বদ্ধ করে দিলেন। বহু চেষ্টা করেও কেউ সে কঠোর দ্বার খুলতে পারেন না বা সে পাষাণের কোনো সাড়া শব্দ শুনতে পেল না। শতবার ডাকও ফিরে এলো। সে কক্ষে কোনো খাদ্য পানীয় মজুদ ছিল না। এদিকে বাইরে সারা হিন্দুস্তান যেন দুঃখে শোকের মাতমে কেঁদে যে অস্থির হয়েছে; সম্রাট সে কথাও জানতে পারলেন না। শাহজাহান দীর্ঘ আট দিন দুই ঘণ্টা, কারো মতে সাতদিন আট ঘণ্টা, সেই প্রকোষ্ঠে নিজেকে সমাহিত করে রেখে দিলেন। দ্বার ভেঙে যতবার লোকজন সেখানে ঢুকতে গেলো গুম গুম আওয়াজ হলে মনে করলো মমতাজই আজ্ঞা করছেন বিরক্ত না করতে, এ কাজ যেন না করে কারণ তাকে সাথে করে নিয়ে যাবেন। মমতাজের শব কফিনে আবদ্ধ করা হলো ছিদ্রবিহীন করে, তার আগে যত রকম আরক ও প্রলেপ মাখানো হলো। সদ্যোজাত সন্তানের জন্য একটি দাই জোগাড় করে আনা হলো। দুর্ভাগা মেয়েটি এমন যে, জন্মের পর যেটুকু কান্না শোনা গিয়েছিল তারপর একটুকুও কাঁদেনি, সবাই মনে করেছিল এটি কী বেঁচে থাকবে? আর বেঁচে থেকে লাভটা কী তার? কিন্তু কী দিব্যি সুস্থ এবং কাউকে বিরক্ত না করে বাড়ন্ত হতে লাগলো। আট দিন পর দিনের দশটা আন্দাজ নিজের হাতে দরজার অর্গল খুলে বের হলেন এক মুর্দা।

একি চেহারা! সবাই তাজ্জব হয়ে দেখল, না মুর্দা নয়, তিনি সম্রাট শাহজাহান স্বয়ং। কিন্তু একি, বিদ্যুৎ বজ্রাঘাতে যেন স্তম্ভিত সবাই, খেয়াল করলো, সম্রাটের সেই নধর কান্তি শরীর, বলতে গেলে একটি টিঙ্গটিঙ্গে ফড়িংয়ের সমান একটা অদ্ভুত আশ্চর্য প্রাণী জরাজীর্ণ, কুঁজো হয়ে তিনি আর কী ভাবে বের হচ্ছেন যেন পা রাখছেন কোথা সেটা তিনি জানেন না। দুই একটা ঠোকর খেলে লোকজন ছুটে এসে ধরলেন তাঁকে। তাঁর মুখমÐলের সেই কোকিল কালো শুক্ররাজি একেবারে বকের পাখা, সাদা রূপ ধারণ করেছে। মাথার কেশ গুচ্ছও, কোঠরগত চোখ, যেন বহুদূর থেকে তাকিয়ে কোঠরগত চোখ। অশ্রুসিক্ত সবাই, বার বার নিজেদের চোখ ঘষে যা দেখছে তা সত্য কিনা যাচাই করেও বিশ্বাস করলো না। তাদের মনে হলো, হয়তো বা তাদের দেখার ভুল হচ্ছে। না, তাদের দৃষ্টিভ্রম কিছুই নয়, মমতাজ তার মৃত্যুর সাথে প্রকৃত শাহজাহানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন, হয়তো কফিনে মমতাজের সাথে আসল শাহজাহানকে পাওয়া যাবে। একথা কাব্যরূপে কিংবা দর্শন রূপে দেখে বলা হলেও, পরবর্তী কালে বাস্তবে তাই সেই প্রেমিক শাহজাহানেরও সেদিন মৃত্যু হলো, স্মৃতি আঁকড়ে একজন সম্রাটই ছিলেন, প্রেম দুনিয়াকে মিথ্যা করে দেয় শাহজাহান বুঝতে পেরেছিলেন। সেটা শাহজাহান নয়, শাহজাহানের খাঁচা, পাখি উড়ে গেছে, খাঁচায় আঁকড়ে কাপড়ে ঢাকা আছে, তাই বোঝা যায় না। শাহজাহান শৈশবেই স্থাপত্য চিন্তায় বেশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কাবুলে অবস্থান কালে তাঁর তরুণ মনের প্রতিফলন তাঁর স্থাপত্য শিল্পের স্পৃহা ও সূ² ও কারুকাজ রুচি আস্বাদন এ চেতনা দৃষ্টির জন্য সম্রাট জাহাঙ্গিরের নজরে তা এলে বাদশা মুগ্ধ হয়ে তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি তাই এত খুশি হয়েছিলেন যে খুররমের ওজনে যতটা ধরে মেপে তার মূল্য নির্ধারণের চেষ্টা করেন। একথা স্থূল হলেও প্রতিভাকে সোনা দিয়ে মেপে ঠিক করা যায় না, জাহাঙ্গির তা জানতেন কিন্তু তখন খুররম ছিপছিপে ছিলেন, অল্প ওজনের সোনা তো খুররমকে প্রকাশ করে না, তাই তিনি ভাবলেন, হীরা মেপে খুররমকে পুরস্কৃত করবেন। শেষ পর্যন্ত হীরা ও সোনা মিশ্রিত করে তার মূল্য নির্ধারণ করেন। সে থেকে খুররম সোনার গায়ে হীরা জড়িয়ে শিল্প সৃষ্টি করতেন। কোহিনুর হেরেমে কোনো বেগমের কোটরে পড়েছিল, কিন্তু শাহজাহান তাকে শিরস্ত্রাণের মূলে স্থাপন করে জগৎ বিখ্যাত করেন। কাবুলে। শৈশবে অবস্থান কালে খুররম সে স্থাপত্য কৌশল রপ্ত করেছিলেন, তারপর যেখানে থাকেন সেখানকার কোনো না কোনো ইমারতের স্থানীয় রূপ কৌশল, তার আঞ্চলিক প্রভাব এবং কারিগরি মতামত সংগ্রহ করতেন এবং স্পষ্টভাবে তা সব আয়ত্ত করতে চেষ্টা করতেন। বিশেষত বিভিন্ন প্রকারের পাথরের গুণাগুণ, মান ও পাথর কাটা সব সূ² ধারাল যান্ত্রিক কৌশল ও তার পদ্ধতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করার চেষ্টা করতেন। শুধু পাথর নয়, তিনি সব রকমের মণি মুক্তো হীরা জহরত চুনি মরকত কিংবা অন্যান্য দুর্লভ মাণিক্যের সম্যক পরিচয় ও সন্ধান নিতেন। তিনি অঙ্গুলি স্পর্শ করেই মণি মাণিক্যের রূপ কৌশল আবিষ্কার করে ফেলতেন। বলতে গেলে তিনি পাক্কা জহুরি ছিলেন। খালি চোখেও বের করে দিতে পারতেন, কোনটা গোলকুÐা, কোনটা কাবুলি আর কোনটা বদখসানি নাকি ইস্পাহানি। খুররম যুবক কাল থেকে সুরা সেবনে অনীহা পোষণ করতেন কিংবা অন্যান্য মাদকেও। সুরাট বন্দরে জাহাজে অন্তরীণ অবস্থানকালে দীর্ঘ দশ বছর অপেক্ষা করেও ব্রিটিশ বণিকরা খুররমের কৃপা লাভ করতে পারলো না। তাদের প্রেরিত মদ্য ধাতব তৈজসপত্রাদি অকাতরে ফিরিয়ে দেন। এমনকি তাঁর অনমোনীয় মনোভাবের দরুন ইংরেজরা হিন্দুস্তানের ডাঙ্গায়ও একদিনের জন্য পা রাখতে পারেননি। প্রথমে অঢেল দামি দামি মদের পিপে পাঠালে তিনি পদাঘাতে তা সব ভেঙে চুরমার করলেন। পরে তাঁর পোশাক প্রীতির কথা জেনে বিলাতি লেইস ও সার্টিন পাঠিয়ে দিলে তিনি সব গরু-ছাগলকে পরালেন। তারপর দেশি মসলিন কিংবা ইরানি কায়দার বুটি লেইস খুঁজে পেলেন না। তাই তাদের বিলাতি লেইস পরালেন দারওয়ান প্রহরীদের। ফিরিঙ্গি বা ফ্রান্সের এসেন্স ও বিলাতি লাভেন্ডার পেলে দেখলেন তা মমতাজের আবিষ্কার করা গুলাবি আতরের চাইতে উৎকৃষ্ট মানের নয় বলে সব তা ময়লা পরিষ্কার যারা করে তাদের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। খুবরম ইংরেজ কিংবা ফরাসিদের প্রেরিত ভেট দ্রব্যের প্রতি খুব অনীহা দেখালেন। পরপর ব্যর্থ হয়েও ইংরেজ বাণিজ্য বহরের অধিনায়ক স্যার টমাস রো ব্যর্থতার বছর ধরে খুররমের কৃপা ভিক্ষার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। তাদের এ ধৈর্যের কথা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। রো তার পরচায় খুররমের চরিত্র সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা এখন গবেষণার বিষয়। তিনি লিখেছেন, খুররমের কোনো ভব্যতা বোধ নেই, রসবোধ বলতে গেলে সামান্য, একফোঁটা মদ স্পর্শ করে না, ধর্ম বর্বর মুসলমান মহলে ধর্মের নিয়মে তিনি কট্টর এবং নৃশংস, তার সৌজন্যবোধ বলতে কিছুই নেই। তিনি ভদ্রলোক নন, ইংরেজরা ভদ্র ব্যবহার করলেও তিনি বিধর্মী কাফের বলে তাদের সাথে কথা বলতে ঘৃণা প্রকাশ করেন। সর্বোপরি খুররমকে একজন অসভ্য শাসক বলা যায়। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, এ কথা সত্য যে এ অসভ্য বর্বর শাসকই। ইংরেজদের কপালে ফুলচন্দন দিয়ে তাদের হাতে হিন্দুস্তানের ভাগ্য ও শাসনভার তুলে দিলেন। শাহজাহান মমতাজের জীবন কালে প্রেমে যেমন অন্ধ ছিলেন, তাঁর পুত্রকন্যাদের স্নেহেও অন্ধ ছিলেন তিনি। এ অন্ধতার সুযোগে কোনো অন্ধ বৈরিতা ইংরেজদের জন্য সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। তাহলে কখনো ইংরেজ এ দেশ শাসন করার সুযোগ পেতেন না, ফরাসি দিনেমার পর্তুগিজদের মতো তাদেরও এক সময় খালি হাতে ফিরে যেতে হতো। কীভাবে শাহজাহান তাদের কপাল খুলে দিলেন আর কোন পথে ১৫৪৪ সালে সামান্য একটা কারণে শাহজাহান কন্যা বাদশাহী বেগম জাহানারা হঠাৎ করে অগ্নিদগ্ধ হন। জাহানারা ছিলেন হুবহু মমতাজ, মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান আর শাদি করলেন না। জাহানারার দিকে তাকিয়ে মমতাজকে ভুলে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব হলো, শেষে এমনই হলো যে শাহজাহান কন্যাকেই বাদশাহী বেগমের দায়িত্ব ভার দেন। মমতাজ শাহজাহান যেভাবে সেবা আদর আপ্যায়ন করতেন জাহানারা তা লক্ষ্য করেছিলেন, পিতার জন্য মা যে ধরনের ব্যবহার করেছেন একই ধরনের আচরণ করতেন। জাহানারা মায়ের আকৃতি, চেহারা ও স্বভাব পেয়েছেন, এমনকি কণ্ঠস্বরও। সে কারণে শাহজাহানও এক মুহূর্তের জন্য জাহানারাকে না দেখে থাকতে পারতেন না, আদর করে তাকে হিন্দুস্তানের মাতা সম্বোধন করতেন। কারণ জাহানারার সে গুণ ছিল। অতুল ক্ষমতা ভার, বাদশাহও তার পরামর্শ ছাড়া চলতেন না। শাহজাহানের কোনো ইচ্ছা ছিল না জাহানারাকে কোথাও পাত্রস্থ করা বা কোথাও শাদি দেয়া; এমনিতে মোগল হেরেমে শাহজাদীদের শাদি হয় না, কারণ জামাতা তখন সিংহাসনের দাবিদার হয়ে ওঠেন। তাই শাহজাহানের ইচ্ছা জাহানারাকে হিন্দুস্তানের পরবর্তী বাদশা করবেন। পাঠান যুগে ইলতুতমিশ কন্যা সুলতানা রাজিয়া হিন্দুস্তানের কর্তৃত্ব ভার গ্রহণ করেছিলেন, যদিও অরাজকতার ভেতর শেষ পর্যন্ত সিংহাসন ও প্রাণ হারান। কট্টর মুসলমানদের বিশ্বাস যে নারীর কখনো পুরুষের ওপর শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ইসলামের বিধান নারী কেবল ঘরের আমানত, জেয়র কিংবা অন্যান্য সম্পদের মতে, পুরুষের ভোগ তৃষ্ণ মেটাবার জন্য তারা, নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধ। তবু শাহজাহান জাহানারাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আমির ওমরাহদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করছিলেন। এ মিশ্র প্রতিক্রিয়ার ভেতর গুপ্তচর মুখে জানলেন না যে জাহানারার একজন প্রেমিক রয়েছে, যে একজন উচ্চপদস্ত আমির পত্র, খুব গোপনীয়তার সঙ্গে কদাচিত তারা মিলিত হন। একদিন বাদশা তাজ তৈরির কাজ তদারক করার জন্য আগ্রা যাওয়ার কথা বলেন, এ সুযোগে প্রেমিকবর গোপনে জাহানারার কক্ষে প্রবেশ করবেন সিদ্ধান্ত হয়, এ কাজও বাদশাকে গুপ্তচর জানিয়ে দিলেন। বাদশা আগ্রা যাত্রা স্থগিত করেন এবং যখন প্রেমিকবর তার প্রিয়তমার কক্ষে গোপনে প্রবেশ করেন বাদশা জাহানারাকে সংবাদ পাঠান, আজ শরীর ভালো যাচ্ছে না তাই আগ্রা যাওয়া হচ্ছে না আর জাহানারার সঙ্গ পেয়েই দিনটা কাটাবেন। জাহানারা ও তার প্রেমিক বিপদে পড়লেন। বাদশা আসছেন, সঙ্গে অনুচরেরা তো আছেই, সামনের দিকে পালিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাবেন। জাহানারা বুদ্ধি করে তাকে গোসলের পানি গরম করার পাত্রে লুকিয়ে মুখ ঢাকিয়ে দিলেন, বাদশা চলে গেলে তাকে বের করে পূর্ব মতো প্রেমস্ফুর্তি মেটাবেন। জাহানারার হেরেম কক্ষের সামনে বাদশা এলে নকিব হাঁকলেন, শাহেন শাহ, খুররম বাদশা শাহজাহান হাজির ইজাযত আস্ত। জাহানারা কক্ষের দরজা খুলে পিতাকে আলিঙ্গন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাদশা বললেন, জাহানারা, তোমার কাছে এলে আমার প্রাণে ফুর্তি, ঘানে গুলাবি সুবাস লাগে মমতাজ যা তৈরি করে গেছেন, এই যে শয্যাপাশে জানালা দিয়ে গোলাপ দেখতে পাচ্ছি, আমি কিছুক্ষণ তোমার শয্যায় শুয়ে গোলাপ দৃশ্য ও গুলাবি সুবাসের আরাম উপভোগ করব তুমি কিছু বলবে না তো? হুজৌর জাঁহাপনা, এটা আমার সৌভাগ্য, বলে জাহানারা পিতাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলেন বিজে শিয়রে বসে বাদশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন। শরীর কত শুকিয়ে গেছে, হ্যাঁ দুচারটা চুল তো আসমানি তারার মতো জ্বলছে অন্ধকারে আর থাকতে চায় না তারা। হ্যাঁ, জাহানারা, তারার জন্য বাবা আর ভালোবাসো না। সেটা আমি জানি, তবে কি জানো মনে আছে মিনা বাজারেÑ ও তুমি না, বেচারা মমতাজ আমার ঝাকরা চুলের কুঁটি আকড়ে ধরে কি করেছিল, সে কখনো ভোলা যায়, তারা তখন উঁকি দিতে সাহস পেতো না। না, না, শাহেন শাহ, আমিও খুঁজে বের করবো তাদের, তা আমার ভুল হয়েছে, আমি তাদের লুকিয়ে ফেলবো, বলে একটা সাদা চুল তুলে একটা কৌটায় রাখলেন। চুলটা দেখে আমি অস্থির বোধ করছি, আমি একটু গোসল করতে চাই। তোমার গোসল ঘরে। মনে শান্তি আসুক। জুরুর জুরুর, জাঁহাপনা। জাহানারা চিত্ত কেঁপে উঠলো, শাহেন শাহের ইচ্ছা, কোনো উপায় নেই রোধ করার, সেই বিরাট ডেকসির ভেতর পানি ঢেলে চুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলো, দাউ দাউ করে জ্বলে পানি টগবগ করে সেদ্ধ হলে নোকর বলল, হুজুর জাঁহাপনা পানি একেবারে সেদ্ধ! শাহজাহান শরীরের আড়মোড় ভেঙে বললেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। গোসল করবো না, আজ তোমাকে অযথা বিরক্ত করলাম জাহানারা। আজ আসি বলে, বাইরে প্রতীক্ষারত অনুচরসহ সম্রাট চলে গেলেন। জাহানারার আশা বিলীন হয়ে গেল। এসব সমস্যার জন্য জাহানারা পক্ষে আর বিয়ের ভাগ্য ফুটলো না। তিনি সারাক্ষণ সম্রাটের সঙ্গদান করতেন, মমতাজ যা করেছিলেন অবিকল ঠিক ঠিক তাই করতেন সে কারণে একটা তাদের অপেয়া গুজব তৎকালে হিন্দুস্তানে গোময় ছিটানোর মতো দেখা গেল বলে বার্নিয়ার তাঁর বইতে রেখে গেছেন। মোগল হেরেম সম্বন্ধে বহু জায়গায় এমন সব কথাতে সেজন্য সে বই পড়তে গেলে এখনও গন্ধ লাগে। কথাটা হলো, শাহজাহানের সঙ্গে নাকি তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। গুজব হতে হতে দরবারে যখন প্রকাশ্যে আলোচনার পর্যায়ে চলে গেলো, অবশ্য সে দরবারটা তখন শাহজাহানের নয়, আওরঙ্গজেবের তখন মুফতি মাওলানাদের ডাক পড়লো, একটা বিশেষ ধরনের মজলিশই সুরায় তা উত্থাপন করা হলো সেখান থেকে মুফতি সাহেব ও গ্র্যান্ড মুফতি, যিনি জুমা মসজিদের পেশ ইমাম, তাঁর নেতৃত্বে একটা ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছিল যে, যে বৃক্ষ ফুলফল উৎপাদন করে থাকে, সে বৃক্ষে যে ফল নিজে আস্বাদন করতে পারে কিনা। না সাধারণত এটা সত্য নয় যে তারও অন্যের মতো অধিকার আছে ফুল ফল আস্বাদনের। এটা মোগল গৌরবকে স্নান ও কুৎসিত করার ফরাসি অপচেষ্টা বা মতলব সেটা সহজেই বোঝা যায়। তবু অন্য ইতিহাস লেখক বলেন, এটা। আওরঙ্গজেবের ময়লা ঘরের কারসাজি মাত্র। তিনি জাহানারাকে মোটেই সহ্য বা পছন্দ করতেন না। আগ্রা দুর্গে শাহজাহানকে বন্দি করে রাখা হলেও এবং জাহানারার নিকট থেকে বাদশাহী বেগমের পদ মর্যাদা কেড়ে নেয়া হলেও তড়িঘড়ি বড় ভগ্নি জাহানারা তাকে অন্য ভাইদের নৃশংসভাবে হত্যার জন্য ভৎসনা করবেন। তখন আওরঙ্গজেব কিছু কিছু কট্টর মাওলানা লাগিয়ে এ ধরনের কুৎসিত ফতোয়া প্রকাশ করেছিলেন, বড় ভগ্নি হলেও জাহানারা তার অনুগত থাকবেন। অনেকের ধারণা কুটিল আওরঙ্গজেব কৌশলে এক ফতোয়া তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারাশিকোকে বিধর্মী হিন্দু হিসেবে আখ্যা দিয়ে, এই দোষের অপরাধে তাকে হত্যা করেন দারাশিকো উপনিষদের অনুবাদ ফার্সি ভাষার প্রকাশ করেছিলেন। এটাও তার দোষের কর্ম। তাই তাকে বিধর্মী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। যে যাই হোক অগ্নিদগ্ধ মরণাপন্ন জাহানারাকে বাঁচিয়ে তুলার জন্য শাহজাহান হিন্দুস্তানের সর্বত্র চিকিৎসক হেকিম আয়ুর্বেদী সবাইকে এত্তেলা দিলেও কেউ কিছু করতে পারলো না। এদিকে ইংরেজ শিবিরে একথা গিয়ে পৌঁছেছে, তাই টমাস রোর নির্দেশে ইংরেজ ডাক্তার জিবরাইল বোটন দিল্লি গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে জাহানারাকে সারিয়ে তোলেন, শাহাজাহান তখন অতিশয় আনন্দিত, অত্যন্ত আহলাদিত হয়ে ইংরেজ ডাক্তারের পদতলে। প্রাসাদের যাবতীয় মণি-মাণিক্য হীরা জহরত সম্পদরাজি উজাড় করে দিলেন। পরে বললেন, নাও, ডাক্তার নিজের ইচ্ছামতো যা নিতে পার নিয়ে গিয়ে তোমার গরিব দেশকে ভরিয়ে দাও। মিসকিনের মতো দীর্ঘদিন ধরে ভিক্ষা প্রার্থনা করেছিলেন আমি তো এক পয়সাও তোমাদের দিইনি। এখন নাও, আমার প্রাণের অধিক প্রিয় সন্তানের সম্পদের বিনিময়ে তোমাকে এসব দিয়ে দিলাম। নিয়ে গিয়ে জাহাজে করে দেশে চলে যাও। ডাক্তার বিনীতভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, জাঁহাপনা, আপনার এই খুশির উপযুক্ত কোনো কাজ আমি করিনি। আমি ডাক্তার, কেবল পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ স্পৃহাও তেমন কিছু নেই। পুরস্কার যদি সামান্য কাজের জন্য দিতে আগ্রহী হয়ে থাকেন, হে শাহেন শাহ মহান সম্রাট, তবে অতি সংক্ষেপে নিবেদন করি। আমার ইংল্যান্ডের লোক অতিশয় গরিব ঠিক, হিন্দুস্তানের মতো এত অতুল ঐশ্বর্য সেখানে নেই, সেই রূঢ় দেশে যত লোক রয়েছে তাদের মুখে তোলার উপযোগী খাদ্য উৎপাদন হয় না, বাকি যা হয় বছরে মাত্র তিন মাসের অধিক চলে না, সেই ঘুটে কুড়ানি দেশমাতা আমার ইংল্যান্ড আর বেশি জোগাতে পারে না। বাকি নয় মাসের খাবার আমরা চুরি চামারি লুটপাট করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ক্ষুণ্ণ বৃত্তি নিবারণ করি। তাই নিবেদন করছি হে মহান সম্রাট, আমার দেশের সেই দুস্থ বণিক দল আপনার মহান মুলুকের পশ্চিম প্রান্তে ছোট সুরাট বন্দরে অভুক্ত অবস্থায় দীর্ঘ দশ বারো বছর যাবৎ অবস্থান করে আপনার কৃপা ভিক্ষার অপেক্ষায় আছে। যদি আমাকে পুরস্কৃত কিছু করতে চান হে শাহেন শাহ তবে এই দুস্থ গরিব বণিকদের জন্য একখানি ফরমান মঞ্জুর করে দিন, যে ফরমানের বলে তারা হিন্দুস্তানের যে কোনো অঞ্চলের জমিনের কোণে নেমে একটু বাণিজ্য করতে পারে, সে অধিকার তারা পাবে। শাহজাহান গরিবের ওপর কোনো প্রকার জুলুম করতে চায় না, তোমরা হিন্দুস্তানের যে কোনো অঞ্চলের জমিনের কোণে নেমে একটু বাণিজ্য করতে পারো, তবে তার বাইরে যেতে পারবে না। এখন থেকে সেভাবে বাণিজ্য কর, এ ফরমান জারি করে দিলাম। জাঁহাপনা, আলম্পনা, দুনিয়ার মালিক, হিন্দুস্তান তো বহু বিশাল এক সাম্রাজ্য আছে, আমরা হলাম ক্ষুদ্র এক ব্যবসায়ী দল, আমাদের তাকত এমন নেই যে পর্তুগিজ দিনেমারও ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে টেক্কা মেরে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারি। বিশেষত আমাদের মাল সামানও তো তাদের সমান এত টেকসই হয় না এবং এত সস্তায়ও দিতে পারি না, তাই নিবেদন যে, শুধু একটা অঞ্চলে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার ফরমান মঞ্জুর করে দিন, তা হলে আমার প্রার্থনা ও আমি ধন্য হবো। তোমরা কোন অঞ্চলে বাণিজ্য করার জন্য শুল্কমুক্ত চাও? এমন কলাকৌশলী ও যুদ্ধ অভিজ্ঞ শাহজাহান অথচ সেদিন সামান্য এক ইংরেজ ডাক্তারের রাজনৈতিক খপ্পরে পড়ে সারা হিন্দুস্তান বিক্রি করে দিলেন বিনে পয়সায়। তাতে মনে হয় শাহজাহানের রাজনীতি জ্ঞান খুব সামান্যই ছিল, ক‚টনীতি জ্ঞান তো মোটেই ছিল না। কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দেশ কেন দুনিয়া দিয়ে দিতে হয়তো তাঁর দ্বিধা ছিল না। তাছাড়া তিনি অপত্য স্নেহের কাছে বারবার মার খেয়েছিলেন। মৃত্যুর একদিন আগেও সেটা তার সংশোধন হয়নি। জাহানারার জন্য এভাবে দেশ বিকিয়ে দেয়ার পর কোনো একটা স্থাপত্যকর্ম সৃষ্টি করলেন যেটার মূল্য এখন কিছুই না, তার মোহে দুনিয়া বিকিয়ে দিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App