×

সাময়িকী

শিল্প-সাহিত্যে তাজমহল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২৭ পিএম

শিল্প-সাহিত্যে তাজমহল

ছবি: প্রতিনিধি

মানুষের জীবনে কিছু জিনিসের কথা মানুষ মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারে না বা কোনোভাবেই তাকে নিজের জীবন থেকে ফেলে দেয়া সম্ভব না। বাল্যকাল থেকেই শুনে এসেছি ভালোবাসার প্রতীক- শাহজাহানের শোকের মিনার নন্দনশিল্পের এক জীবন্ত উদাহরণ তাজমহল। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শাহজাহান-মমতাজ, চণ্ডীদাস-রজকিনী কতশত নামÑ এই উপমহাদেশের প্রেমাশ্রয়ী কাব্যে-মহাকাব্যে-গল্পে-উপন্যাসের শোভাবর্ধন করে আসছে সেই আদিকাল থেকে। সব কিছুরই শীর্ষে অবস্থান করছেÑ মুঘল সম্রাট আকবরের দৌহিত্র এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর পুত্র-পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহান (জন্ম : ১৫৯২-১৬৬৬)। যার পুরো নাম ‘শাহেনশাহ আল সুলতান আল আজাম ওয়াল খোয়ান মুখারাম মালিক উল সালতানাত আবুল মুজাফর শাহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান’। শাহ জাহান নামের ফার্সি অর্থ ‘পৃথিবীর রাজা’। যিনি তার তৃতীয় স্ত্রী ‘মমতাজ মহল’-এর মৃত্যুতে ব্যথিত-মর্মাহত হয়ে তৈরি করেছেন ‘তাজমহল’। এই তাজমহল শিল্পে-সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং বর্তমানেও ফেলে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস-শেষের কবিতা এবং বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্পে তাজমহলকে দেখতে পাই। ননসেন্স রাইম বা অর্থহীন ছড়ার লেখক এডওয়ার্ড লিয়র ১৮৪৭ সালে তাজমহল দেখে বলেছিলেনÑ ‘এখন থেকে আমি পৃথিবীর অধিবাসীদের দুভাগে ভাগ করবোÑ তাজমহল দেখার দল আর তাজমহল না-দেখার দল।’ সম্পূর্ণ ভীনদেশি হওয়া সত্তে¡ও ভারত বর্ষের ইতিহাসকে যেন হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছেন লেখক দম্পতি মিশেল প্রেস্টনব আর ডায়ানা প্রেস্টন। প্রচলিত ইতিহাসের নানা সূত্রের গভীর বিশ্লেষণে তারা লিখেছেন এক অমর গ্রন্থ ‘এ টিয়ারড্রপ অন দ্য চিক অব টাইম : দ্য স্টোরি অব তাজমহল’। তাজমহল সাহিত্যের কতটা প্রভাব ফেলেছে একটু দৃষ্টিপাত করলেই আমরা বুঝতে পারবÑ শাজহাঁর শুভ্রকীর্তি, অটল সুন্দর!/অক্ষুণ্ণ অজর দেহ মর্মরে রচিত, /নীলা, পান্না, পোখ্ রাজে অন্তর খচিত/তুমি হাস, কোথা আজ দারা সেকেন্দর/সকলি সদর তব, নাহিকো অন্দর,/ব্যক্ত রূপ স্তরে স্তরে রয়েছে সঞ্চিত।/প্রেমের রহস্যে কিন্তু একান্ত বঞ্চিত,/ছায়ামায়াশূন্য তব হৃদয়-কন্দর।/মুম্ তাজ! তাজ নহে বেদনার মূর্তি। Ñ তাজমহল, প্রমথ চৌধুরী এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান/কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।, /... যদি লুপ্ত হয়ে যাক, শুধু থাক/এক বিন্দু নয়নের জল/কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল। Ñ বলাকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ কি তার প্রাণ?/অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শাহজাহান। Ñ ‘নারী’, কাজী নজরুল ইসলাম জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লী-লাহোর-ফতেহ্পুর,/যমুনা জলের পুরনো বাঁশীতে বেজেছে নবীন সুর?/নতুন প্রেমের রাগে/তাজমহলের অরুণিমা আজও উষার অরুণে জাগে। Ñ হিন্দু-মুসলমান, জীবনানন্দ দাশ তেজিয়ান সাজিহান দিল্লী অধিপতি/ভার্য্যা তাহার বসুমতি অতিরূপবতী,/তাহারি স্মরণ হেতু ভ’প সাজিহান/গৌরবে করিল তাজমহল নির্মাণ। Ñ সুরধনী, দীনবন্ধু মিত্র তীর্থ তুমি গো তাজ নিখিল প্রেমীর,/মরমীর হিয়ার আরাম,/অশ্রæ-সায়রে তুমি অমল-শরীর/কমল-কোরক অভিরাম! তনু-সম্পুট তুমি চির-ধরণী/মৃত্যু-বিজয় তব নাম। Ñ অভ্র আবীর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।/বহুদিন মণিমুক্তো, মহফিল, তাজা ঘোড়া, তরুণ গোলাপ/এবং স্থাপত্য নিয়ে ভাঙাগড়া সব ভুলে আছো/... Ñ তুমি এলে সূর্যোদয় হয়, পূর্ণেন্দু পত্রী ...নিজে হয়েছি এক নিঃসঙ্গ ফাঁসির আসামী/আমার আপাদ-মস্তক আজ কালো কাপড়ে ঢাকা/দেখতে পায় না কেউ তার প্রকৃত অবয়ব/...তাই সন্দেহের আগুনে আমি আজ ভস্ম দেখি/ভস্মের মধ্যে ভালোবাসার ছায়া, তাজমহল/তাজমহল পুড়িয়ে আমি যমুনার জল ফেলে দেবো, Ñ পোড়াবো তাজমহল, ত্রিদিব দস্তিদার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তার ছোটগল্প ‘তাজমহল’-এ এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। যা আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। একজন মুসলমান তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিজের কাঁধে করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তার কাছ থেকে এত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে কেউ আশ্রয় দেয়নি, শেষ পর্যন্ত তিনি আশ্রয় নেন একগাছের তলে এবং শেষমেশ তার স্ত্রী মারা যায়। গল্পের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাইÑ প্রথম যখন আগ্রা গিয়েছিলাম, তাজমহল দেখতেই গিয়েছিলাম। প্রথম দর্শনের সে বিস্ময়টা এখনো মনে আছে। ট্রেন তখনো আগ্রা স্টেশনে পৌঁছায়নি। একজন সহযাত্রী বলে উঠলেন, ওই যে তাজমহল দেখা যাচ্ছে... কী হচ্ছে এখানে মিঞা সাহেব? বৃদ্ধ সম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সেলাম করলে আমাকে। বেগমের কবর গাঁথছি হুজুর! কবর? হ্যাঁ হুজুর। চুপ করে রইলাম। খানিকক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর জিজ্ঞাসা করলাম তুমি থাক কোথায়? আগ্রার আশেপাশে ভিক্ষে করে বেড়াই গরিব-পরবয়। দেখিনি তো কখনো তোমাকে। কী নাম তোমার? ফকির শা-জাহান! নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জীবনে শেষ প্রান্তে এসে রবি ঠাকুর দুজন মানব-মানবীর প্রেমের কাহিনী লিখলেন। তাও এ কোনো সররৈখিক প্রেম নয়, এ এক চতুর্ভুজাকৃতির প্রেম। তাই তো ১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনের শেষ পর্যায় এসে পৌঁছালেন তখনই তার হাতে রচিত হয় কালজয়ী উপন্যাস, ‘শেষের কবিতা’। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে গত ৯৩ বছরে একই জনপ্রিয়তা ও ব্যাপক পাঠ্যবহুলতার মধ্যে রয়েছে। নায়ক অমিতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষাকে আরো বেশি ঋদ্ধতা দান করেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক অমিত ছন্নছাড়া এবং কারো যুক্তিকে সে কেয়ার করে না। সে নানান যুক্তির মধ্য দিয়ে তার কথাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যেমনÑ তাজমহলের পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত আরক্তমুখে বলে উঠল, ‘ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো।’ কিন্তু অমিত বলল তার ঠিক উল্টোটা, ‘বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।’ আমরা আজ শাহজাহানের প্রেমকে বিভিন্ন মতবাদের আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করলেও প্রেমিক হিসেবে একজন প্রেমিকার প্রতি যে কী ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাই লেখক জীবন-এর বিশ্লেষণেই পেয়ে যায়Ñ ‘চর্তুদশ শতকে ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ প্রবর্তিত ‘বৈষ্ণব সহজিয়া’ মতবাদে বিশ্বাসীগণ নিজেদের সহজ রসিক বা সহজ পথের পথিক মনে করতেন। এখানে ‘সহজপথ’ অর্থ প্রেমের এবং প্রেমসাধনার মাধ্যমে অজিত হয় সিদ্ধি। সহজিয়া মতবাদের সাধকগণ বিশ্বাস করেনÑ পরকীয়া প্রেমের মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সিদ্ধিলাভ লাভ হয়। ফলে এরা বাস্তব জীবনেও পরকীয়া প্রেম প্রয়োগ বা প্রসারে বিশ্বাসী। যে কারণে বড়ু চণ্ডীদাস নিজেও ব্রাহ্ম্যকুল ত্যাগ করেছিলেন প্রেমিকা ‘রামী রজকিনীর’ জন্য। অপরদিকে শ্রীচৈতন্যদেব কর্তৃক প্রবর্তিত ‘গৌড়ীয় সহজিয়া’ মতবাদিগণ ‘পরকীয় প্রেমকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করলেও তারা পরকীয়া প্রেমকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগে বিশ্বাসী নন। তবে সহজিয়া মতবাদে বিশ্বাসীগণ ঈশ্বর সাধনার পথে বেদ-উপনিষদ নির্ভরতা এড়াতে পারলেও ভগবানে বিশ্বাস এবং রাধা-কৃষ্ণের স্বর্গীয় প্রেমে ঠিকই আস্থা রেখেছেন। যে কারণে আজো এই উপমহাদেশে সংসারে-সমাজে-গল্পে-কাব্যে-মহাকাব্যে অবতার কৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমকাহিনী স্বর্গীয় প্রেম হিসেবে গণ্য-মান্য হয়ে থাকে। অপরদিকে বৌদ্ধ সহজিয়াগণ (উল্লেখ্য যে, এরাই প্রথম সহজ পথে মোক্ষ প্রাপ্তির পথ সৃজন করেন) মোক্ষলাভের কঠিন ও জটিল পথকে এড়িয়ে গিয়ে সহজ পথে সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বর সান্নিধ্য প্রাপ্তি সাধনা করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, যেহেতু গৌতম বুদ্ধ প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে বাস করেন, সেহেতু কেবলমাত্র প্রেমাসিক্ত সহজ সাধনার মাধ্যমেই তার কৃপা লাভ করা সম্ভব। মরমি সুফি সাধক, বৈপ্লবিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সুন্নি বংশোভ‚ত মনসুর আল হাল্লাজ বলেন যে, সমগ্র মানবজাতির এক নিগূঢ় অন্তদর্শন আছে, যার মাধ্যমে-সাহায্যে তিনি স্রষ্টাকে অন্তরের অন্তস্থলে খুঁজে পেতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঐশ্বরিক বাস্তবতায় জন্য গৎবাঁধা আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মের ঊর্ধ্বে ওঠতে হবে। এই মতবাদ-বিশ্বাস প্রচারের কারণে তাকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে ৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কারাগারে বন্দি করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ জনসমক্ষে বিচারকদের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। অন্যান্য বিখ্যাত সুফি দার্শনিকগণও শরিয়ত প্রথাকে ‘জাহিরি প্রথা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে হৃদয়স্থিত শুদ্ধ সাধনার (প্রেমাশ্রিত) মাধ্যমে নিরাকার সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্রাট শাহজাহান ও প্রেম সৌধ্য তাজমহল। (তথ্য : মুক্তমনা ব্লক) তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন মতবাদ বা শিল্প-সাহিত্যে নানাভাবে তাজমহলকে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী প্রেমের নিদর্শন হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন এবং তাদের বহুমাত্রিকতায় তাজমহল যেন সাধারণ মানুষের অন্তরে আরো আগ্রহ সঞ্চালন করে চলেছে। যা এক জীবন্ত প্রেমের করুণ আকুতির ভেতর দিয়ে অন্তর্বেদনাময় গভীর মমতারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পরিগণিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App