একজন শিল্পীর সংগ্রামী জীবনকথা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২১, ১০:১৭ পিএম
ছেলেকে নিয়ে অফিসে বসে আছেন। আলাপের এক ফাঁকেই বললেন, ছেলেকে ইঁদুর মারার বিষ খাইয়েছিলেন খাবার দিতে না পেরে, সঙ্গে নিজেও খেয়েছিলেন। পরে মহাখালী গিয়ে মা-ছেলে সে যাত্রায় বেঁচে যান।
শিল্পী আক্তারের গল্পটা জীবনযাত্রায় দোলাচলের। সংগ্রামের ছাপটাই সেখানে স্পষ্ট। হাসিমুখ দিয়ে যুদ্ধটাকে হয়তো ঢেকে দিতে চান, কিন্তু মুখের আঘাতের চিহ্ন সাফ জানিয়ে দেয় কী অতিক্রম করে তিনি এসেছেন। সমাজ শিল্পী আক্তারদের বিদেশফেরত নারী শ্রমিক হিসেবে চেনে। তাকে বয়স জিজ্ঞেস করার পর উত্তর দিলেন ৩০ বছর, এও বললেন তিনি নিশ্চিত নন। ২০০৯-এর দিকে ওমান যান দালালের মাধ্যমে। দালাল ১ লাখ টাকা চাইলে ভেঙে ভেঙে ৬০ হাজার পর্যন্ত দিতে পেরেছিলেন। জামাই দ্বিতীয় বিয়ে করায় কিছুটা অভিমান আর বাকিটা রোজগারের তাগিদে পাড়ি দেন বিদেশে। ৩ মাস পর ফেরত আসেন। ফেরত আসলে তাকে আসতে হয়। কারণ সেই তিন মাসের যাত্রায় নরকযন্ত্রণা তিনি পেয়ে গেছেন।
প্রবাসে তার গায়ে গরম পানি ছিটিয়েছিল বাসার মালিক, সঙ্গে প্রচণ্ড মারধর। শিল্পীর দোষ ছিল তিনি মালিকের নোংরা প্রস্তাবে রাজি হননি। সঙ্গে ‘অন্যায্যভাবে’ আবার তার ন্যায্য বেতনও চেয়েছিলেন। সেই প্রচণ্ড মারধর নিতে পারেননি, দেশে ফিরে যান। লোন তখন বেড়ে গেছে। তার ভাষায়, সরকারি অফিসে অফিসে তখন ছুটে বেড়াচ্ছেন। একটা কাজ কেউ দেয়নি। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং-মিছিলে গিয়েছেন। নিজের কথা বলেছেন, শুনিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। আগেরবারের ঋণ শোধ আর দুবেলা ভাত খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে আবারো কিস্তিতে লোন নিয়ে পুনরায় শিল্পীর বিদেশগমন। এবার যাত্রা জর্ডানে। দালালকে এবার দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। যুদ্ধ এবারো তার জন্য শেষ ছিল না। যে বাসায় ওঠেন মালিক ভালো ছিল প্রথম মাস। কিন্তু বেতন চাওয়ার পর শুরু হয় মারধর। শিল্পীকে জানানো হয় যে তাকে প্রথম তিন মাস কোনো টাকা দেয়া হবে না। কারণ মালিকপক্ষের দাবি, তারা টাকা খরচ করে শিল্পীকে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে শিল্পীর বক্তব্য ছিল, তিনি নিজের টাকা খরচ করে গিয়েছেন। ঠিক এই জায়গাটায় দালালের দৌরাত্ম্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই বাসায় বেল্ট দিয়ে তাকে পেটানো হতো, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টও করা হয়েছিল। সেই প্রথম বাসা থেকে বুদ্ধি করে শিল্পী বাংলাদেশ এম্বাসিতে চলে যান। এম্বাসিকে তাকে আরেক বাসায় পাঠায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে তৃতীয় বাসায় গেলে এবার ভাগ্যবিধাতা তার জন্য সদয় হন। প্রথমবারের মতো প্রবাসে মানসিক শান্তি পান শিল্পী। শিল্পীর বক্তব্য, এই মালিকের অশেষ দোয়া তিনি ভুলতে পারবেন না। সেই বাসা থেকেই তার যা আয় হওয়ার, তিনি করেন। এর মধ্যেই জর্ডান থেকে শিল্পী যখন দেশে ফিরতে চান, ফিরতে পারছিলেন না। কারণ তার পাসপোর্ট জমা ছিল প্রথম মালিকের কাছে যেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসেন মারধরের ভয়ে। ঠিক সেই সময়টাতে বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে) ত্রাতার ভ‚মিকায় আবিভর্‚ত হয়। বিএনএসকের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলামের সঙ্গে শিল্পীর পরিচয় হয়েছিল ওমান থেকে ফেরার পর যখন শিল্পী বিভিন্ন সংস্থায় যাচ্ছিলেন। সুমাইয়া ইসলামের তত্ত¡াবধানে বিএনএসকে তখন তাকে সাহায্য করে জর্ডান থেকে দেশে ফিরে আসতে।
জর্ডান থেকে ২০১৭ সালে ফিরে সেবারও শিল্পী চাকরি পাননি। তখন ছোট একটা বাচ্চাও হয়েছে। সেই বাচ্চা আর নিজের পেটে অন্ন জোগাড়ে তখন তাকে ছাই বিক্রিতে নামতে হয়। কী দয়াহীন জীবন। দুবেলা ভাতের আশায় যিনি নিজ মাটি ফেলে দুই দেশ ঘুরে মারধর সয়ে দেশে ফিরেছিলেন, তখনো সচ্ছলতার মুখ শিল্পী দেখেননি। শিল্পী তখন দূরদূরান্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাই বিক্রি শুরু করেছেন। ৪০-৬০ কেজি মাথায় নিয়ে যান, লাভ হয় প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা। এই করতে গিয়ে তার পায়ের হাড়ে সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তার দেখালে বলে হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। মাসে ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ দরকার যেটা তার কাছে নেই। মাথায়ও শিল্পী প্রচণ্ড ব্যথা টের পান প্রবাসকালীন সেই শারীরিক অত্যাচার থেকে। এখন পায়ের হাড় ক্ষয়ের কারণে তিনি সেলাইয়ের কাজ করছেন। শিল্পী দুঃখ করে বলেন, তার নিজের একটা সেলাই মেশিন থাকলে ঘরে বসে সেলাই করে তিনি মাস খরচ উঠিয়ে ফেলতে পারতেন নিজের আর তার বাচ্চার জন্য।
জীবনের সঙ্গে নিজের এই যুদ্ধেও শিল্পী সবার জন্য ভাবেন। বোন আর ভাইকে টাকা জমিয়ে তিনি বিদেশ পাঠিয়েছেন। যদিও সেই বোনও এখন খবর নেয় না। বিএনএসকের অফিসে বসে সেখানেও তিনি যেখানে থাকেন, সেই চনপাড়ার আরেক মেয়ের সমস্যার কথা বলে জানতে চাইলেন কোনো চাকরি সেই মেয়ের জন্য দেয়া সম্ভব কিনা।
প্রতিদিনের এই সংগ্রামের মধ্যেই শিল্পী তাও আবার স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি জর্ডান যাবেন। তার ভাষায়, তিনি জর্ডানের নিয়মকানুন এখন অনেকটাই বুঝে গেছেন। জর্ডান চলে গেলে তার ছেলের ভবিষ্যৎ তিনি গড়ে দিতে পারবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এবার গেলে আর ঠকবেন না। জর্ডানে একদম শেষে যে মহিলার বাসায় ছিলেন, যার কাছে থেকে তিনি একটু শান্তি পেয়েছিলেন, সেই মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শিল্পী। হাসি দিয়ে কৃতজ্ঞ শিল্পী জানান, জর্ডানে গিয়ে নিজের টাকা জমে গেলে তিনি তার সেই মহিলা মালিককে নিয়ে কোনো একদিন হজে যেতে চান।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের (বিএনএসকে) সহযোগিতায় শিল্পী জর্ডান থেকে দেশে আসে। বিএনএসকে চায়, শিল্পী আক্তাররা সম্মান, সাহস আর স্বনির্ভরতায় বাঁচুক। সেই লক্ষ্য থেকেই শিল্পীকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হয়। যাতে ঘরে বসে রোজগারের পাশাপাশি সন্তানের দেখাশোনাটাও সে করতে পারে। শিল্পীও তাতে খুশি। তার ভাষায়, ‘ঘরে বসে রোজগার করা গেলে অন্য কাজে কেন যাব’?
পরিচালক, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)।