×

মুক্তচিন্তা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক আজ, কিন্তু তাতে আমাদের কী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ১০:০৯ পিএম

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম এবং প্রধানতম ভিকটিম, সেহেতু বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত সহায়তা এবং সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা নতুন করে বেড়ে যাবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও জো বাইডেনের প্রশাসন এবং সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সাহায্য ও সহযোগিতা বাংলাদেশ পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। জো বাইডেনের সরকারের কাছ থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এক ধরনের সক্রিয় সহযোগিতা পাবে।
আজ যুক্তরাষ্ট্রের সময় দুপুর ঠিক ১২টায় ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেবেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হবেন। যদি কোনো অপ্রত্যাশিক অঘটন না ঘটে, তাহলে ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকবেন। মার্কিন সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী প্রতি চার বছরান্তে নভেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জানুয়ারির ২০ তারিখ ঠিক দুপুর ১২টায় নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় অভিষিক্ত হবে এবং পুরনো প্রেসিডেন্ট বিদায় নেবেন। ১৯৩৭ সালের ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজবেল্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন এবং তখন থেকেই নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রতি চার বছরান্তে জানুয়ারির ২০ তারিখ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে অভিষিক্ত হন। বিগত প্রায় আট দশক ধরে এ রীতি জারি আছে। স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব আজ নজর রাখবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বিশ্ববাসীর কাছে, বিশেষ করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে একটি আকর্ষণীয় ইভেন্ট হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নানান অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে এ অনুষ্ঠানকে অধিকতর আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। সর্বশেষ ক্যাপিটল হিলে হামলা, পাঁচজন মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্ট প্রভৃতি কারণে এ শপথ গ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠান এমনিতেই নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সঙ্গে আছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, কেননা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে যে কোনো কিছুই করা সম্ভব। যদিও এখন তার পক্ষে আর তেমন কিছু করার সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা নেই। নির্বাচনের ফলকে বিতর্কিত করতে, ফলকে উল্টে দিতে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, কিন্তু আখেরে খুব একটা লাভ হয়নি। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত মজবুত, ক্রিয়াশীল এবং আইনসিদ্ধ যে, খুব সহজে সে সিস্টেমকে মেনিপুলেট করে পুরো নির্বাচনী ফলকে উল্টে দেয়ার ক্ষমতা খোদ প্রেসিডেন্টেরই নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প যা ক্ষতি করার করেছেন কিন্তু শেষ সময়ে ক্ষমতার জোরে তার আর তেমন কোনো কিছু করার ছিল না বা নেই। ফলে আজ জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করছেন এবং গোটা বিশ্ব ট্রাম্প-উত্তর একটি নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখার অপেক্ষায় দিন গুনছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করলে আমাদের কী লাভ? প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় ক‚টনীতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা ও পারস্পরিক লাভালাভের হিসাব দিয়ে। রাষ্ট্রের ক‚টনৈতিক বাছবিচারের জায়গা থেকে বিবেচনায় নিয়ে রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্রেট সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ক‚টনৈতিক সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ভালোতর, বন্ধুসুলভ এবং সহযোগিতামুখী। সে বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে জো বাইডেনের সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ক‚টনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো যাবে, এটা প্রত্যাশিত। অথনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকেও জো বাইডেনের উদার-অর্থনৈতিক পলিসির কারণে বাংলাদেশ নানান ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে সেটাও আশা করা যায়। বিশেষ করে রপ্তানি সুবিধা বেড়ে যাবে, পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশা করা যায়, বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, ট্যারিফ মওকুফ সুবিধা পুরোপুরি না হলেও কোটা সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে, যা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া প্রচুর বাংলাদেশি অভিবাসী আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। যেহেতু বাইডেনের সরকার হবে অভিবাসীবান্ধব, সেহেতু অন্য অভিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিভিন্ন স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টিও রাষ্ট্রীয় পলিসির অংশ হিসেবে নিশ্চিত হবে, সেটাও আশা করা যায়। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সম্ভাবনাও নতুন করে সম্প্রসারিত হবে নিঃসন্দেহে। বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে দ্রুত এবং সেখানেও বাংলাদেশ একটা বিশেষ সুবিধা পাবে। আরেকটি বড় ইস্যু হচ্ছে, আমেরিকা থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো ব্যাপক অঙ্কের রেমিট্যান্স। ২০২০ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ হাজার ১৭৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যার কারণে গত ৩০ ডিসেম্বরে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় প্রায় ৪৩.১৭ বিলিয়ন ডলার (সূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক)। সুতরাং জো বাইডেনের উদার অর্থনৈতিক পলিসির সুবাধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে আরো প্রবৃদ্ধি ঘটছে- এটা সহজেই অনুমেয়। কেননা ডোনাল্ড ট্রাম্পের শেষ সময়টা মার্কিন অর্থনীতি ছিল টালমাটাল। সঙ্গে ছিল করোনা ভাইরাসের ব্যাপক প্রসার এবং প্রভাব। ফলে জো বাইডেন মার্কিন অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করার যে নানান পলিসি গ্রহণ করছেন এবং করবেন, তাতে নিঃসন্দেহে মার্কিন অর্থনীতি ফের ঘুরে দঁড়াবে। আর মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, বাংলাদেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণেরও পরিবৃদ্ধি ঘটছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জো বাইডেনের ইমিগ্রেশনবান্ধব পলিসির কারণে আমেরিকায় পুনরায় অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং প্রচুর বাংলাদেশি এ ইমিগ্রেশন সুবিধা পাবে এবং নেবে, যার ভেতর দিয়ে রেমিট্যান্স অধিকতর ত্বরান্বিত হবে। প্যারিস জলবায়ু এজেন্ডায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় সংযুক্তির কারণে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন পলিসি এবং তহবিলে একটা গুণগত এবং ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। যেহেতু বাংলাদেশ জলবায়ু পরবির্তনের একটি অন্যতম এবং প্রধানতম ভিকটিম, সেহেতু বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত সহায়তা এবং সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা নতুন করে বেড়ে যাবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও জো বাইডেনের প্রশাসন এবং সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সাহায্য ও সহযোগিতা বাংলাদেশ পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ তিন বছরাধিক সময় ধরে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। জো বাইডেনের সরকারের কাছ থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এক ধরনের সক্রিয় সহযোগিতা পাবে। ফলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠান আমাদেরও কিছুটা যায়-আসে! পরিশেষে বলব, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জো বাইডেন যে কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। পত্রিকান্তরে আমি লিখেছি, ‘পুঁজিবাদের বিকাশে, করপোরেট প্রমোশনে, মুনাফা ও বেনিয়াবৃত্তিতে, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে, বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়, বিশ্বের মোড়লত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে, প্যালেস্টাইন ইস্যুতে, চীন-উত্তর কোরিয়া-ইরান ইস্যুতে এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতি এবং পররাষ্ট্র পলিসিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না।’ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বাধিয়ে নিজেদের ‘ওয়ার-ইন্ডাস্ট্রি’কে চাঙ্গা রাখা, যুদ্ধ বাধিয়ে ধ্বংসস্ত‚প তৈরি করে সেখানে উন্নয়নের নামে মার্কিন ‘রিকনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো’কে বাণিজ্য দেয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে মার্কিন তাঁবেদারি সরকার প্রতিস্থাপনে কাজ করা, বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়ে সে জঙ্গিবাদ দমনের নামে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের স্বার্থের ষোলোআনা হাসিলে জন্য বিভিন্ন দেশে নিজেদের এলিট এজেন্ট তৈরি করার যে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি তার কোনো গুণগত পরিবর্তন হয় না। প্রেসিডেন্ট যেই আসুক, তালগাছ আমার। সুতরাং জো বাইডেনের ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়া নিয়ে আমাদের কিছুটা ‘যায়-আসে’ বটে, কিন্তু বেসুমার আমোদ করার খুব বেশি কিছু নেই। তবে ইন্টেলিজেন্ট ডিপ্লোমেসি দিয়ে আমরা কতটুকু আমাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারি এবং আমরা আমাদের লাভালাভের পাল্লা ভারী করতে পারিÑ এখন সেটাই দেখার বিষয়। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App