×

সারাদেশ

তদন্তেই আটকে আছে রাজাকারের তালিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১৯ এএম

তদন্তেই আটকে আছে রাজাকারের তালিকা

প্রতীকী ছবি

তদন্তেই আটকে আছে রাজাকারের তালিকা। এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। ২০১৯ সালে বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী। কিন্তু ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার মুখে সংশোধনের জন্য ওই তালিকা স্থগিত করা হয়। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নামের ব্যাপারে তদন্ত করে শিগগিরই সঠিক, নির্ভুল তালিকা প্রকাশের কথা বলা হলেও তদন্তই শুরু হয়নি আজো। তবে আর যেন কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়, এজন্য নির্ভুল তালিকা প্রণয়নে প্রতিটি উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সহযোগিতা চাইবে সরকার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এবং গেজেট প্রকাশ করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা প্রণয়নে অর্ধশতক : বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ফারসি শব্দ রাজাকার অর্থ স্বেচ্ছাসেবী। ১৯৪০-এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে রাজাকার নামে কাসেম রিজভী একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হায়দ্রাবাদের ওই সশস্ত্র বাহিনীর আদলে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের খান সেনারা। একাত্তরের মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনীর যাত্রা শুরু। রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয় ওই সময়ের ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে। শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেয়া হয়। প্রথমপর্যায়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন থাকলেও ১ জুন পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন জেনারেল টিক্কা খান। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল নিয়াজি। নিয়াজির বইয়ে ৫০ হাজার লোককে রিক্রুট করার কথা উল্লেখ রয়েছে। বিজয়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এজন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২’ প্রণয়ন করা হয়, যা দালাল আইন হিসেবে পরিচিত ছিল। দালাল আইনে ৩৭ হাজার রাজাকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে যাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি তারা সাধারণ ক্ষমা পায়। তবে গণহত্যাসহ ১৮টি অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষমা করেননি বঙ্গবন্ধু। তাদের বিচার শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কিন্তু জিয়া ক্ষমতায় এসে ১১ হাজার যুদ্ধবন্দিকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, মোটামুটি ৫০ হাজারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। ওই নামগুলোর সঙ্গে কিছু নাম সংযোজন করা হলেই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির চেয়েও রাজাকারদের তালিকা তৈরি সহজ বলে মন্তব্য গবেষকদের। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয়। কিন্তু রাজাকারের তালিকায় এসব কিছুই নেই। অল্প কিছুসংখ্যক লোক স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। আমরাই প্রথম ১৯৮৫ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ বই বের করি। এটিই এখনো বিভিন্ন জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হয়। পঞ্চাশ বছরেও রাজাকারের তালিকা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না এমন মন্তব্য তাদের। জানতে চাইলে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর ৪ সহযোগীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থকরা ছিল। তারা রাজাকারদের শুধু মুক্তিই দেয়নি, রাজাকারপ্রধান কুখ্যাত গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে, মন্ত্রী বানিয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি। মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মতোই রাজাকারের তালিকা জরুরি। প্রতিটি এলাকায় রাজাকারদের নাম টানিয়ে রাখা প্রয়োজন যেন মানুষ জানতে পারে, ওই এলাকায় কারা কারা স্বাধীনতাযুদ্ধে মীর জাফরের ভ‚মিকায় ছিল। শাহরিয়ার কবির বলেন, রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তদন্ত করার কথা বলা হলেও এখনো তদন্ত কাজ শুরু হয়নি। এটি দুর্ভাগ্যজনক। বঙ্গবন্ধুর সময় করা রাজাকারের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে কিছু নাম শুধু যোগ করলেই তালিকা করা সম্ভব। তবে আমলাদের দ্বারা আলবদর-রাজাকারদের তালিকা সম্ভব নয়। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এক্ষেত্রে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিতর্ক এড়াতে রাজাকারের তালিকা প্রণয়নে মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ ব্যাপারে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তৈরি হবে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা। আর যেন কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়, এজন্য মুক্তিযোদ্ধা গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে শিগগিরই প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করা হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেই নির্ভুল তালিকা সম্ভব এমন আশাবাদ মন্ত্রীর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App