×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক ও মানসিক শক্তির সন্ধানে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০২ পিএম

বিধাতার প্রতি নৈবেদ্য, তার স্মরণ সব সমাজে অনবদ্য সাধনার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মানুষে মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে বিধাতার কাছে নৈবেদ্য নিবেদনের কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’র গান বা কবিতাগুলোর জন্য। স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার উপলব্ধি এবং তারই কাছে এর পরিত্রাণ প্রার্থনাই যে কোনো সংকট মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একজন মানুষের পূর্ণ সুস্থতার সংজ্ঞা দিয়েছে, ‘Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity’ অর্থাৎ রোগবালাই মুক্ত হলেই শুধু নয়, শারীরিক বা দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক সবলতাই সুস্থতা। একবিংশ শতাব্দীতে এ পর্যন্ত বৃহৎ বলে বিবেচিত করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক বিচরণে যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে তাতে পৃথিবীর তাবৎ নাগরিকের ব্যক্তিগত শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শান্তি ও সামাজিক সুরক্ষা সংকটের সম্মুখীন। উচ্চবিত্তবাদে মধ্যবিত্তসহ অন্যান্য সবাই (৯৬ শতাংশের বেশি মানুষ) স্বাভাবিক জীবনযাপনে ও ধারণে প্রাণান্ত সংগ্রামে। এ পরিস্থিতিতে মহামারি করোনা মোকাবিলায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঠাসা বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত এবং সমন্বয়হীন কর্মসূচি পালনের মহড়া চলছে। যে কোনো যুদ্ধে জয়ী হতে হলে গতস্য শোচনা ও সমালোচনা নাস্তি, টিকে থাকার জন্য নির্দেশনা মতো যথাপ্রস্তুতি সহকারে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য। সামাজিক সংহতি প্রাচীনকাল থেকেই দেশকাল পাত্রভেদে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করতে সবার ভালোর জন্য বারবার আহ্বান জানাতে হচ্ছে ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরির। এটিকে ছোঁয়াচে রোগ করোনার বিস্তৃতি প্রতিরোধের মোক্ষম উপায় ভাবা হচ্ছে। অথচ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারি নিয়ন্ত্রণে, মানুষকে উদ্ধারে সামাজিক সংহতির ভ‚মিকাই অগ্রগণ্য। ১৮৪৪ সালে কুষ্ঠ রোগীদের পরিবার ও সমাজ বিচ্ছিন্ন করে দ্বীপান্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কানাডার পূর্ব উপক‚লীয় রাষ্ট্র নিউ ব্রান্সউইক। ইতিহাসের পাতায় রয়েছে দারুণ অমানবিক অনুরূপ অনেক ঘটনা। করোনা বিশ্বমানবতাকে, সে রকম একটা সংকটের সামনে দাঁড় করিয়েছে। সহানুভ‚তি সমানুভ‚তির সুরক্ষা চীনের মতো একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী-ভোগবাদী উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক অ্যাডাইসিভ মিশ্রিত রাজনীতির রসে ভরা স্থূল (অবিস) সমাজ ও পেট মোটা অর্থনীতিতে কিংবা ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো তথাকথিত ওয়েলফেয়ার সমাজে প্রাণপ্রিয় জাতির কাছে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি একই আবেদন বা অবদান রাখতে পারে না। পক্ষান্তরে সেটা চলে না বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ও সামাজিক বন্ধনরীতি যেখানে সুদৃঢ়। করোনা মোকাবিলায় আক্রান্তের সেবা-শুশ্রুষায় চিকিৎসাকর্মীর সমানুভ‚তি, পারিবারিক নৈকট্য, সামাজিক সহানুভ‚তি এখানে বিশেষ টনিক হিসেবেই কাজ করবে। গোটা পরিবার এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীকে নির্বাসনে (কোয়ারেন্টাইন) নিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য রোগীকে একঘরেকরণের (আইসোলেশন) সামাজিক ভয় না ঢুকিয়ে বরং সবাইকে প্রত্যেকে আমরা পরের তরে এ ধরনের উপলব্ধিজাত সহানুভ‚তি সমাদরের হেতুতে পরিণত করাই তাহলে স্টিগমা কেটে যাবে, কর্মসূচিটি আমাদের সমাজের জন্য টেকসই হবে। শ্রমজীবী প্রবাসীরা দেশের জন্য রেমিট্যান্স আনেন, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যান না, তারাই বরং বিদেশের সম্পদ দেশের জন্য আনেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে। করোনার ক্রান্তিকালে কর্মহীন হয়ে করোনার হাত থেকে বাঁচার তাগিদে মৌলিক অধিকারে তারা দেশে স্বজনের কাছে ফিরেছেন, কিন্তু দেশে পৌঁছিয়েই তাদের বাধ্যতামূলক ‘কোয়ারেন্টাইনে’ রাখার সময় স্বাগত সান্ত¦না তো দূরের কথা, তাদের পর্যাপ্ত ও প্রযোজ্য প্রযত্ন তারা পাননি, যেটা করা হলে তারা কোয়ারেন্টাইন এড়িয়ে সবার মাঝে মিশে যেতে পারতেন না, ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত হয়ে জরিমানা গুনতে হতো না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নামে বিদেশ থেকে আগতদের খুঁজে বেড়ানো হতো, বাসাবাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হতো। অবস্থা এমন যে, এটা যেন তাদের দেশে ফিরে আসার প্রায়শ্চিত্ত। অথচ করোনায় সংক্রামিত হওয়ার সন্দেহে এবং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাকে কার্যকর করতে প্রবাসীদের জন্য সরকারি খরচে আলাদা থাকা-খাওয়া ও ‘একঘরে’ হয়ে অবস্থানের ব্যবস্থা করলে, সেটি মানবিক ও সামাজিকভাবে যৌক্তিক হতো। চীন চটজলদি হাজার হাজার বেডের হাসপাতাল তৈরি করেছিল করোনা প্রতিরোধের জন্য। বাংলাদেশে প্রবাসীরাই সংক্রমণের উৎস টার্গেট গ্রুপ ছিলেন, করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ তাদের জন্য শুরু হওয়া উচিত ছিল। করোনায় মৃত্যু হয়েছে কিনা মৃত্যুর পর তার পরীক্ষা করা এবং তার ভিত্তিতে তার পরিবার এমনকি তার গ্রামকে লকডাউন করা, তার স্বাভাবিক জানাজা ও দাফন-কাফন নিয়ে বিতর্ক-বিসংবাদ তৈরি হওয়ার স্টিগমা তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কোনো মতেই। চার-পাঁচ দশক আগেও গ্রামবাংলায় কলেরা বা ওলাওঠায় গ্রামকে গ্রাম মানুষ উজাড় হয়ে যেত, ভয়ে মৃতদের সৎকারের লোক পাওয়া যেত না। এ রকম পরিস্থিতিতে গণমৃতদের দাফন-কাফন জানাজা, তাদের দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য খানবাহাদুর আহছানউল্লা নিজ গ্রামে যুব সমাজকে সংগঠিত করে, নবীজির (দ.) হিলফুল ফযলের প্রেরণায় একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, মুষ্টির চাল ভিক্ষা করে খরচপাতি সংগ্রহ করে অসহায় মানুষের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতাগুলো পরিপালনের উপায় সৃষ্টি করেন। ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরার নলতায় গড়ে ওঠা সেই অতি সামান্য সংগঠন আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান আহছানিয়া মিশন। রামকৃষ্ণ মিশনও অনুরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার হাবলু মিয়ার লিচু বাগানে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন আজকের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবিগঞ্জের বুড়িচঙ্গের ফজলে হাসান আবেদের সুনামগঞ্জের সাল্লা ও দিরাইতে নেয়া ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকেই আজ বিশ্বের সেরা এনজিও ব্র্যাক। এসবই সামাজিক অন্তর্ভুক্তির প্রেরণা থেকে। সমাজের মধ্য থেকেই সামাজিক অন্তর্ভুক্তির উপায় ও উদ্যোগ এলে তা টেকসই হবে। সমন্বয়হীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি দায়িত্ব পালনের দ্বারা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সংহত হয় না। মানসিক শান্তি ও শক্তি দেশে-বিদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও ক্ষয়ক্ষতির বেহাল চিত্র দেখে আস্থাহীনতায় আতঙ্ক, আশঙ্কা বেড়েই চলেছে, যা মানসিক অশান্তির উপসর্গ। অথচ মানসিক শান্তি বা মনের বল করোনার মতো ভয়াবহ মহামারি মোকাবিলায় প্রাণশক্তি হতে পারে। বাংলাদেশে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও তৎপরতায় (যা উচ্চ আদালতও গত বছরের ৫ মার্চ সরকারকে জানাতে তাগিদ দিয়েছিলেন) বিলম্ব, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় যে আস্থাহীন অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা এখনো বলবত রয়েছে। কঠিন বাস্তবতায় করোনা মোকাবিলায় গৃহীত ব্যবস্থার স্বচ্ছতায় ও আন্তরিকতায় সবাইকে শামিল করতে পারলে ভয়-উৎকণ্ঠা কমে যাবে। কাণ্ডারিকে হুঁশিয়ার করে দিতে নজরুলের ছিল সেই আহ্বান, ‘ওরা হিন্দু না মুসলিম? এই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’। গৃহীত সব পদক্ষেপে বিচ্যুতির পরিবর্তে সবাইকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে আস্থা ও জাতীয় ঐক্য গড়া প্রয়োজন। ঐকমত্যের ঐশ্বর্য মতানৈক্যের মাসুল দিতে দিতে যেন শেষ না হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই, আমজনতার ব্যক্তিগত সতর্ক সচেতনাতেই বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ-প্রভাব অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম, এটাকে আত্মতুষ্টির উপায় উপলক্ষ ধরে নিলে এবং যা যা ন্যূনতম করার কথা তা না করলে এই পরিস্থিতিকে ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে এবং মানসিক শান্তি বিপন্ন হতে থাকবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতিতে সহন ক্ষমতা (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) ক্ষরণ হবে। আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রেরণা চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। চিন্তা বা নিয়ত বা কর্মপরিকল্পনা পল্লবিত হয় আত্মায়। পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে এই আত্মার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ঠিক থাকা জরুরি। কেননা ভালো-মন্দ, ভূত-ভবিষ্যৎ জ্ঞান পরমাত্মার এখতিয়ার। যুদ্ধের সময় অগ্রবর্তী দল সেনাবাহিনী যেমন সবসময় হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে নির্দেশনা মতো কাজ করে, হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে রসদ প্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটে, শত্রুর অবস্থানের নিশানা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে দিশাহারা হয়ে শত্রুর কব্জায় চলে যেতে পারে ওই বাহিনী। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, তার জীবন-সংগ্রামে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই সে পাবে প্রেরণা, বিপদ তাড়ানোর মদদ, বিপদে সৃষ্টিকর্তার কাছে জানাবে ফরিয়াদ, চাইবে মার্জনা। এটাই তার মনের শক্তি ও সান্ত্বনা অর্জনের পথ। করোনা মহামারি প্রকৃতির প্রতিশোধ, নানাবিধ সীমালঙ্ঘনের অভিঘাত, প্রতিফল। সুতরাং এ থেকে নিষ্কৃতি লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় অনুতপ্ত-অনুশোচনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাওয়া এবং তা পাওয়াই তার মানসিক শান্তি ও শক্তি। চীন থেকে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, সিঙ্গাপুর, ইরান, সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্র যার যার ধর্ম বিশ্বাস মতো সৃষ্টিকর্তার প্রতি আবেদন-নিবেদনে নত করোনাক্লিষ্ট রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে সবাই। বিধাতার প্রতি নৈবেদ্য, তার স্মরণ সব সমাজে অনবদ্য সাধনার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মানুষে মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের ব্যাপক ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে বিধাতার কাছে নৈবেদ্য নিবেদনের কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’র গান বা কবিতাগুলোর জন্য। স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার উপলব্ধি এবং তারই কাছে এর পরিত্রাণ প্রার্থনাই যে কোনো সংকট মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App