×

মুক্তচিন্তা

করোনার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ব্রিটেনে ভ্যাকসিনবিরোধীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৬ পিএম

মহাকালের এই অধ্যায়ে করোনাও চিহ্নিত করে গেল লোভাতুর সেই পাষাণ হৃদয়গুলো, যারা নিজের মরণ ভুলেছেÑ এই করোনাকালেও। তাদের লোভাতুর চোখ মরণকে তুচ্ছ ভেবেছে, এই চোখগুলো সম্পদের হাতছানি দেখেছে। সেই মরণভোলা হাতছানিতে ভ্যাকসিন-বাণিজ্যে বাংলাদেশের বিলিয়নিয়াররাও শোষবে পাষাণের মতো।
ব্রিটেনে লাফিয়ে লাফিয়ে যেন বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। গত সপ্তাহে দেখা গেছে প্রতি ৫০ জনে একজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও ঘটছে সেভাবেই। স্কাই কিংবা বিবিসির শোকাবহ নিউজ না দেখতে চ্যানেল বদলে ফেলি আমরা অনেকেই। কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় তো বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই যেন অতীতের রেকর্ড মøান হচ্ছে ব্রিটেনে, আক্রান্তের কিংবা মৃত্যুর। একটা শঙ্কা তাড়া করছে প্রতিটি পরিবারকে। আজ কিংবা কাল কিংবা আগামীর যে কোনো সময় আঘাত হানবে অদৃশ্য দানব। বন্ধু-স্বজন আর সজ্জনদের আক্রান্তের খবরে মুষড়ে পড়ছে সবাই। দেশের আপনজনরা, বিশেষত মা-বাবারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, চিন্তার রেখা তাদের কপাল ছুঁয়েছে, অশ্রু নামছে গাল বেয়ে। লন্ডন শহর থমকে গেছে। থেমে গেছে যেন স্পন্দন। তারপরও ভাবলেশহীন মানুষগুলো চলছে নির্বিকার। ক্রিসমাস কিংবা নিউ ইয়ারে প্রতিবন্ধকতা মানেনি এই এরাই। মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্বকে কেয়ার করছে না ওই মানুষগুলো। এশিয়ান কমিউনিটি, সেই আগের মতোই, ভিড় করছে- ক্যাশ এন্ড ক্যারি কিংবা গ্রোসারি সোপগুলোতে। আশঙ্কার কথা হলো, করোনা আক্রান্ত ৩ জন মানুষের মাঝে ১ জন জানে না তিনি যে আক্রান্তÑ এ কথাটি বলেছেন পাবলিক হেলথ যুক্তরাজ্যের একজন পরিচালক এবং ওই ‘একজন’রা অজান্তেই ছড়াচ্ছেন করোনা, অসংখ্য মানুষের মাঝে। সে জন্য এখন ঘরে থাকার কোনোই বিকল্প নেই। নিজেকে বাঁচাতে হলে যেমন, ঠিক তেমনি সারাদেশকে বাঁচাতে ঘরে থাকতেই হবে। আর সে জন্যই যুক্তরাজ্যের পাবলিক হেলথ অর্থাৎ পিএইচের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এ মৃত্যু আমরা আশা করতেই পারি, যদি না আমরা নিজেরা করোনা ছড়িয়ে দেয়া বন্ধ না করি।’ এনএইচএসে কর্মী সংকট থাকবেই। তা ছাড়া আক্রান্ত এমন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে যে, ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে, আগের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। লন্ডনের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জায়গা সংকট দেখা দিয়েছে। ম্যানচেস্টারের এক জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিশনার), যিনি নর্থ ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের দুটি হাসপাতালেও এই করোনাকালীন সময়ে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন, তিনি জানালেন লন্ডন থেকে অনেক করোনা রোগীর ম্যানচেস্টারের বিভিন্ন হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কেউ কেউ ছুটি নিচ্ছেন বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে। সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড সংকটের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করতে হচ্ছে দেশটিকে। আক্রান্তের সংখ্যা গত ৩-৪ দিন আগে ৭০ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মৃত্যুও পৌঁছেছে ১ হাজার ৫৬৪ জনে গত বুধবার। এটাই ছিল ব্রিটেনের সর্বোচ্চ মৃত্যু গত মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত। সব মিলিয়ে লাখ ছাড়িয়েছে মৃত মানুষের সংখ্যা। অর্থাৎ করোনার ভয়াবহতা এতই প্রকট যে, জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় তা আমেরিকার মৃত্যুর চেয়েও অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পুলিশপ্রধান সবাই পালা করে রাষ্ট্রের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসে কোনো কিছু ধামাচাপা না দিয়েই করোনা পরিস্থিতি তুলে ধরছেন। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি এসে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য মন্ত্রীরাও। ডার্বিশায়ারের দুই মহিলা পাঁচ মাইল গাড়ি চালিয়ে হাঁটতে গিয়েছিলেন এক রিজার্ভায়ারের (কৃত্রিম জলাশয়) কাছাকাছি এবং তারা তখন সে এলাকার পুলিশের মুখোমুখি হন এবং প্রতিজনে ২০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয়। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন যদি সে জন্য তাদের ওপর জরিমানা আরোপ করা হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী ব্যায়ামের জন্য ৭ মাইল সাইকেল চালান কীভাবে? যদিও পরবর্তীতে জরিমানা তুলে নেয়া হয় এবং পুলিশ ক্ষমা চায়। লকডাউন সময়কালীন উপার্জনহীন কিংবা অল্প উপার্জনকারী অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের (ছাত্রছাত্রী) স্কুলমিল বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগা স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন পাবলিক চাপের মুখে তা আবার নতুনভাবে চালু করতে বাধ্য হলেন এবং সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসে বললেন, তিনি অত্যন্ত খুশি যে, পাবলিক মিল চালু করছেন, তখন সাংবাদিক তার কথার ওপরই বলে দিলেন এটা আপনার জন্য খুশির ব্যাপার হলো কীভাবে কারণ আপনিই তো চাইছিলেন তা বন্ধ করে দিতে। আমতা আমতা করা ছাড়া আর পথই খোলা ছিল না তার সে সময়। উল্লেখ্য, এখন বাসায় বাসায় পাঠাতে হচ্ছে স্কুলমিল। দুর্যোগময় এ সময়ে সরকার ব্যর্থ, এটা বলা যাবে না। মানুষের বাঁচার নিশ্চয়তা আছে, চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্মীদের। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা কিংবা একগুঁয়েমিতে করোনা পরিস্থিতি যে বেড়েছে, তা দেশটার মানুষ মনে করছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধান মেডিকেল অফিসারÑ চারদিক থেকেই সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চভাবে, ঘরে থাকতে হবে, বাঁচাতে হবে দেশ। করোনার ধরন বদলেছে, যেন করোনাও প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাই তো সংক্রমণ বাড়ছে। ব্রাজিল, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনার নতুন নতুন শক্তির কারণে অনেক দেশ থেকে মানুষের আগমনের ওপর বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। কিন্তু মানবসভ্যতা থেমে নেই। একটা বহু পুরনো কথা- দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে, তখন সামনে আগাতেই হয়। করোনা নামক দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে মানবসভ্যতার। তাই তো ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ, পৃথিবীর দেশে দেশে। আশার কথা হলো- বিজ্ঞান জয় করছে। এখন পর্যন্ত করোনার ৩টি ভ্যাকসিন ব্রিটেনে তথা পৃথিবীতে আশা জাগিয়েছে। আরো ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্ধকার টানেল থেকে দেখা যাচ্ছে দূরে আলোর রশ্মি। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মানব জাতি আবারো। আর এ সময়ই কেন জানি ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মাঝে একটা প্রতিক্রিয়াশীলতা কাজ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডগুলোর কিছু মানুষ কেন যেন করোনার বিপরীতে কথা বলছে সেই প্রথম থেকেই। আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউন তথা করোনাবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে, যা বিজ্ঞানের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ। তারা এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এই দেশগুলোকেই সংকটের মাঝে ফেলছে। কারণ তাদের লকডাউনবিরোধী তথা করোনাবিরোধী বিক্ষোভ করোনা সংক্রমণকেই বাড়িয়েছে সময়ে সময়ে, আজো এই নির্বিকার শ্রেণি শুধু তাদের দেশ নয়, মানবজাতির জন্য সংকট প্রলম্বিত করছে। এই যখন অবস্থা, সে সময়ে ধর্মীয় অনুভ‚তিকে ব্যবহার করে একটা অতি ক্ষুদ্র শ্রেণি এখন ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিরোধিতা করছে। ব্রিটেনে এ রকম একটা শ্রেণি ইউটিউব বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে। সত্যি কথা বলতে গিয়ে এই প্রচারটাকে লুফে নিচ্ছে আরেকটা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীও। কারণ এরা যেসব শব্দ প্রয়োগ করছে, এতে ‘এনিমেল ফ্যাট’, ‘হারাম’, ‘মুসলমান’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে ভ্যাকসিনবিরোধী একটা ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এরা নিজেরা এমন এক আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে যে, তারা জানে না যে, ব্রিটেনের ৬৬ মিলিয়নের অধিক মানুষের মাঝে মাত্র ৩.৪ মিলিয়নের কাছাকাছি মানুষ মুসলমান। এই মুসলমানদের জন্য তারা কেন তাদের বাকি মানুষগুলোকেও ভ্যাকসিনাইজেশনের মাধ্যমে মাইক্রোচিপের আওতায় আনবে কিংবা সব মেয়েকে বন্ধ্যা করে দেবে? হয় বোকার স্বর্গে বাস করছে এই মানুষগুলো, না হয় ব্রেনওয়াশ ক‚পমণ্ড‚কদের মতো এই মানুষগুলো আসলে মুসলমানদের হয়ে কাজ করছে না। তারা কাজ করছে সেই ক্ষুদ্র অপশক্তির, যারা মূলত মুসলমানদের একটা অন্ধকার যুগের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চায় বিশ্বব্যাপী। এই ভাড়াটে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এসব অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের বরং হেয় করছে। প্রকারান্তরে শত-সহস্র মুসলিম চিকিৎসক বিজ্ঞানীকে অপমান করছে। সুতরাং এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে গিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাই প্রয়োজন এই সংকটময় সময়ে। কারণ এরা এবং উগ্র লকডাউনবিরোধীরা মূলত একই কাতারেরই মানুষ। লকডাউনবিরোধীরা কিংবা ব্রেনওয়াশ ধর্মীয় লেবাসধারীরা যা-ই বলুক, আরো মাত্র কয়েকটা মাস। পশ্চিমের দেশগুলোর বরফাচ্ছাদিত সকালেই ঝিলিক দেবে সূর্য। হেসে উঠবে পৃথিবী। মানবজাতি জয় করবে করোনাকাল। তবে মহাকালের এই অধ্যায়ে করোনাও চিহ্নিত করে গেল লোভাতুর সেই পাষাণ হৃদয়গুলো, যারা নিজের মরণ ভুলেছেÑ এই করোনাকালেও। তাদের লোভাতুর চোখ মরণকে তুচ্ছ ভেবেছে, এই চোখগুলো সম্পদের হাতছানি দেখেছে। সেই মরণভোলা হাতছানিতে ভ্যাকসিন-বাণিজ্যে বাংলাদেশের বিলিয়নিয়াররাও শোষবে পাষাণের মতো। ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App