×

মুক্তচিন্তা

আনুশকাদের বাঁচাতে হলে দিশানদের ঠেকাতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪০ পিএম

সবচেয়ে বেশি দরকার পরিবার ও নিজেদের ভেতর পুরনো সেই বন্ধন আবার ফিরিয়ে আনা। রোজ সবাই মিলে আহার করা, আড্ডা দেয়া, একসঙ্গে নাটক-সিনেমা দেখাÑ এগুলো আবার শুরু হোক। জানতে হবে কে কোথায় কখন কার সঙ্গে আছে। এমন না যে তাদের বিরক্ত করতে হবে কিন্তু খবর রাখা জরুরি। রাখতে হবে নজরদারি। তখনই বাঁচবে আনুশকারা।
আনুশকা হত্যার বিচার চেয়ে রোজ কিছু না কিছু হচ্ছে দেশে। এই প্রার্থনা, এই আবেদন, এই আর্তিতে কি কোনো কাজ হবে? মনে হয় না এতে কোনো কাজ হবে আদৌ। কেন হবে না তার ব্যাখ্যা দেয়ারও দরকার নেই। আপনি একটু সময় ব্যয় করে গত এক দশক বা বিগত বছরগুলোয় চোখ বুলালেই দেখবেন উত্তর মিলে যাচ্ছে। এর আগেও এমন কত ঘটনা ঘটেছে। এর চেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতীর ঘটনা ঘটেনি তাও কিন্তু নয়। অথচ বিচার হলে শাস্তি হয়নি। আর বিচার হয়নি ঝুলে আছে এমন ঘটনাও কম নয়। এমন সমাজে কীভাবে আনুশকার সঠিক বিচার আশা করব আমরা? সমালোচনার দিকে পা না বাড়িয়ে আসুন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশে থাকি না বলে এমন না যে খবর রাখি না। বরং মানসিকভাবে সবসময় দেশে থাকি বলে জানি পরিবারের ভেতর ঢুকে গেছে বৈরী। দুশমন কিলবিল করছে মগজে। আজকাল সামাজিক মিডিয়া আর নানা ধরনের গেমসহ বিনোদনের নামে সময় কেড়ে নিয়েছে মোবাইল। বায়বীয় টানে মানুষ ভুলেছে আপনজন। পরিবারে কে যে কার আর কে কার সঙ্গে কথা বলে বলে নাÑ এসব এখন বড় রহস্যময়। আনুশকার জন্য মায়া আর ভালোবাসা বুকে রেখেই বলি কোথায় ছিলেন তার অভিভাবক? কেন তারা খবর রাখতেন না মেয়েটি সারাদিন কী করত? কোথায় যেত, কীভাবে সময় কাটাত? আমাদের বড় হওয়ার দিনগুলো কি আনন্দময় ছিল না? আমি বড় হয়েছি চার চারটি বোনের সঙ্গে। বয়সে বড় দিদিগুলোর বেড়ে ওঠার সময় দেখেছি বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত একজন একজন করে মায়ের সঙ্গে ঘুমাতেন। তাদের স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেন অভিভাবকরা। এই জায়গাটা আজকাল না ছেলে না মেয়ে কারো জন্য মানার বালাই নেই। দিশান নামের এই ছেলেটি কী করত কেন বা কোথায় যেতÑ এগুলো তার অভিভাবকরা কি খোঁজ রাখতেন? রাখতেন না বলেই আজ ঘটনার পর হাহুতাশ আর শোক প্রকাশ ছাড়া কিছু করার নেই তাদের। আমি খুব অবাক হয়ে দেখি এত বড় ঘটনার পরও চলছে সেই স্বাভাবিক রাজনীতির অস্বাভাবিক কাজকর্ম। আমরা জানি রাজনীতি এখন অচল। দেশে সবকিছু একমুখী। তারপরও যেটুকু নিভু নিভু আলো তার চেহারা দেখুন। বিএনপি প্রতিবাদ সমাবেশ করে সমাজ বিশৃঙ্খলা বা সামাজিক প্রতিরোধের কথা বলেনি। তারা তাদের ভাঙা রেকর্ড বাজিবে আওয়ামী লীগ আর তাদের ভাষায় দুঃশাসনের কথা বলে ফেনা তুললেও একবারের জন্য বলেনি কীভাবে এই অপরাধ প্রবণতা কমানো যায় কিংবা দমন করা সম্ভব? তাদের টার্গেটে তারা সবসময় এক। যেনতেন প্রকারে সরকার হটানোই তাদের উদ্দেশ্য। আনুশকা মরল না বাঁচল তাতে রাজনীতির থোড়াই কিছু যায় আসে। অন্যদিকে সরকারি দল আছে গদি আগলে নিজেদের সুনাম আর আধিপত্য বজায় রাখার মহতী দায়িত্বে। তারা সবসময় এক কথায় বিশ্বাসী। তাদের ভাষ্যে এসব অপরাধ আগে আরো বেশি হতো। আর এখন হলেও তারাই পারবে নির্মূল করতে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? বা আনুশকার পরিবারসহ দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কন্যাদের বাঁচাতে তারা কী করছেন বা করবেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সন্তান-সন্ততিদের পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের কী হবে তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ধরি মাছ না ছুঁই পানির কথাবার্তা এখন সত্যি বিরক্তির। মাঝখানে গ্যাঁড়াকলে আছেন সাধারণ মানুষ। তাদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে যেমন বিপত্তি তেমনি তাদের ডুবিয়ে রাখা হয়েছে বায়বীয় জগতে। এশিয়ার খুব কম দেশে বাংলাদেশের মতো মোবাইলের ব্যবহার হয়। আমি এশিয়ার বেশ ক’টি দেশে দেখেছি সরকার বা রাষ্ট্র কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার ব্যাঘাত না ঘটার মতো করে সামাজিক মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ আজ জরুরি হলেও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করা যাবে না। তাতে সমাজের খুঁটি নামে পরিচিত করপোরেট বিদ্রোহ করবে। বেঁকে বসবে মাথা আউলা তারুণ্য। ভেতরে ভেতরে নাখোশ হব আমরা যারা বয়সি তারাও। নির্ঘুম রাতের রাতজাগা মানুষ এখন নেশায় বুঁদ। এ এক মারাত্মক নেশা। যার জন্য কোনো পানীয় কিংবা ট্যাবলেট কিংবা অন্য কিছুর দরকার পড়ে না। এ এক নীরব ঘাতক। সারারাত জাগিয়ে রাখে দিনে কাজ করতে দেয় না। এর ছোবলে পরিবার প্রায় ধ্বংসের পথে। মানসিক দূরত্বে মানুষ একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তারা এক ছাদের তলায় থেকেও অচেনা আর একা। এই ভঙ্গুর সমাজের কন্যা, সমাজের প্রতীক আনুশকা। আর এই অপরাধপ্রবণ সমাজের প্রতিনিধি দিশান। এই দিশান একা কেউ নয়। ঘরে ঘরে কিশোর তরুণরা আজ বিকলাঙ্গ এক চিন্তার ফসল। তারা না পারছে বাইরে যেতে, না পারছে খোলা মাঠে খেলতে, না আছে সুষ্ঠু কোনো বিনোদন। ঘরেও তারা আগন্তুক মা-বাবা বা বড়দের সঙ্গে সম্পর্ক টাকা-পয়সার। সম্পর্ক একসঙ্গে থাকা ও খাবার। তারপর যার যার মতো নীল পর্দার দাস। এই দিশানরা ঘরে ঘরে আজ বিকৃত যৌনতার শিকার। এসব ঠেকাতে হলে কথায় কাজ হবে না। ধরনা দিয়ে কিংবা রাজপথে নেমে বা দাঁড়িয়ে সমাধান মিলবে না। সবকিছুর দুর্গ যে পরিবার যে গৃহকোণ সেখান থেকেই শক্তি নিতে হবে। সে শক্তি খুব দামি কিংবা অপ্রাপ্য কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে তা ছিল আছে থাকবে। শুধু আমরাই তা ভুলে বসে আছি। কবে আমরা দেখব তারুণ্যের জন্য নতুন একটি সিনেমা হচ্ছে? কবে তাদের সামনে রেখে কবিতা হবে নাটক হবে, তারা আবার ফিরবে গান-বাজনায়? এগুলো ছিল বলেই অপরাধ কম ছিল। তারুণ্য মজে থাকত ভালো কাজে। সে যুগ বিগত হয়ে যখন থেকে এই বায়বীয় জগৎ আমাদের গ্রাস করল তখন থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলাম। প্রযুক্তির আশীর্বাদও নিতে হবে। প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকা সমাধান নয়। সমাধান তার সঠিক ব্যবহার। সে জায়গাটা একেবারেই এলোমেলো। বিদেশে তথা উন্নত নামের দেশগুলোতে ইন্টারনেট বা মোবাইলের প্রতি এমন আকর্ষণ বা বেপরোয়া মনোভাব নেই। কারণ এখানে মেলামেশা সহজ। বন্ধুত্ব সব সময় উদার ও অবারিত। আমাদের সীমাবদ্ধ সমাজ আর পায়ে পায়ে বাধা আর ধর্মের নামে সংস্কারের নামে নানা বিধিনিষেধের বেড়াজাল থাকলেও ভেতরে ভেতরে সব খোলা। এই ছিদ্র বন্ধ না করলে সমাজের এই দুর্ভোগ এড়ানো যাবে না। সবচেয়ে বেশি দরকার পরিবার ও নিজেদের ভেতর পুরনো সেই বন্ধন আবার ফিরিয়ে আনা। রোজ সবাই মিলে আহার করা, আড্ডা দেয়া, একসঙ্গে নাটক-সিনেমা দেখা এগুলো আবার শুরু হোক। জানতে হবে কে কোথায় কখন কার সঙ্গে আছে। এমন না যে তাদের বিরক্ত করতে হবে কিন্তু খবর রাখা জরুরি। রাখতে হবে নজরদারি। তখনই বাঁচবে আনুশকারা। তখন দমে যাবে দিশানরা। আর তা না করে আহাজারি আর মানববন্ধন আরো একটি এমন ঘটনার প্রত্যাশা ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App