×

মুক্তচিন্তা

সমস্যার উৎসমূলে যাওয়া দরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪৭ পিএম

ক’দিন আগে রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও-লেভেলের এক ছাত্রী তার এক বন্ধুর বাসায় ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনায় যথারীতি সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনার বীভৎসতায় ক্ষোভে-বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সারাদেশ। এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে এবং সংঘটিত অপরাধের কঠোর শাস্তির দাবিতে মাঠে নামে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন, মোমবাতি প্রজ্বালন, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ইত্যাকার নানাবিধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এরূপ কোনো ঘটনা ঘটলে যা হয় আর কী! একেকটি ঘটনা ঘটে আর চারদিকে হৈচৈ পড় যায়। প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরাও পড়ে। বিচার-আচার হয় এবং শেষাবধি অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এখানেও হয়তো এগুলো সবই হবে। মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। আশা করা যায়, বিচারও হবে। এতে হয়তো ভিকটিমের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন, সতীর্থ-শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষ এক ধরনের মানসিক সান্ত¦না পাবে। কিন্তু যে মেয়েটি তার সম্ভ্রম হারাল, অব্যক্ত যন্ত্রণার শিকার হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে কি আর ফিরে আসবে? আরো বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ব্যবস্থা নেয়াতে কি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হচ্ছে বা হবে? না হয়ে থাকলে কেন? এ দেশে আবহমান কাল থেকে কিছু প্রবাদ-প্রবচন চালু আছে। এসব প্রবাদ-প্রবচন যুগের পর যুগ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মানুষের অর্জিত ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। এমনই একটি প্রবচন : ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’ রবিঠাকুরের ‘পুরাতন ভৃত্য’ শীর্ষক কবিতার এই কবিতাংশটুকুও হয়তো একই রকম অর্থ বহন করে : ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর!’। এ দেশে যখন কোনো কিশোরী-তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হন, কিছু লোক অতি সহজে এ অন্যায়ের দায়দায়িত্ব চাপানোর জন্য দুটো সহজ টার্গেট বেছে নেন। এক, ভুক্তভোগী মেয়ে ও তার অভিভাবক। আপনি দেখে থাকবেন, মেয়ের চরিত্র ভালো নয়, অভিভাবকরা মেয়েকে দেখে-শুনে রাখেননি কেন... এ ধরনের কথাবার্তা জনে জনে মুখে মুখে ফিরছে। দুই, সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ। এদের অকর্মন্যতাই যেসব নষ্টের মূল, আমাদের কিছু বন্ধু অতি দ্রæত প্রচÐ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ রায় দিয়ে ফেলেন। আজকের দিনে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সমাজ ও রাষ্ট্র অনেক সোচ্চার। নারী নির্যাতন ও নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধেও উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু এতে করে কর্মজীবী নারীদের সংসার নির্বাহ ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তা নিরসনে আমরা কতটুকু দৃষ্টি দিচ্ছি? আমরা কি রাষ্ট্রীয়/সামাজিক ব্যবস্থাপনায় তাদের সন্তান-সন্ততিদের দেখভালের একটি ব্যাপকভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে এই ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে পারে? কর্মজীবী নারীদের এ অসুবিধার কথাটি বিবেচনায় নিয়ে তাদের কর্ম-ঘণ্টা কি কমিয়ে দেয়া যেতে পারে? তাদের অফিসে উপস্থিতির বিষয়ে কি একটু নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা যেতে পারে? পারিবারিক প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যে অফিসের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার বিষয়টি কি সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে? যেখানে প্রযোজ্য, নারীদের জন্য কি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ সিস্টেম চালু করা যেতে পারে? সমাজে উঠতি বয়সের মেয়েদের পদে পদে অনেক বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। এর মধ্যে একটি হলো, স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে কিংবা ক্যাম্পাসে কিছু ছেলে তাদের পিছু নেয়। এদের মধ্যে আবার কিছু ছেলে পারিবারিক প্রতিপত্তি কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে দুর্বিনীত হয়ে উঠে এবং স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলে। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে তার কাছে প্রেম প্রস্তাব পাঠায় এবং তা গৃহীত না হলে মেয়েটিকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে তার জীবনকে অসহনীয় করে তুলে। আরেকটি অংশ থাকে যারা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ গোছের এবং প্রথম গ্রæপটির মতো অতটা আগ্রাসী না হলেও তাদের প্রেম-ভালোবাসার চাহিদা মেটাতে সতত মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। আসলে বয়সটাই এমন। এ বয়সি ছেলেমেয়েদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণ কাজ করে। কাজেই, আপনি এমন কিছু মেয়েও খুঁজে পাবেন যারা ছেলে পছন্দ হলে সোৎসাহে তার প্রচণ্ডভাবে সাড়া দেয়। এদের কেউ কেউ আবার নিজেরাই পছন্দমতো ছেলের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এটি সহজাত মানবীয় প্রবৃত্তিরই একটি অংশ। কাজেই আপনি এটাকে কেবল বাঁকা চোখে দেখলে মানব প্রকৃতিকেই অস্বীকার করা হবে। সমস্যা দেখা দেয়, একটি মেয়ে যখন এমন কারো সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যার নীতিবোধ দুর্বল, যার চরিত্রে মিশে আছে প্রতারণা ও লাম্পট্য। সব হারিয়ে একটি মেয়ে যখন বিষয়টি বুঝতে সমর্থ হয়, দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত, আলোচিত ও দামি শব্দটি মনে হয় ‘ভালোবাসা’। যদিও ভালোবাসার ব্যপ্তি অনেক বড়, সাধারণভাবে বয়ঃপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের পারস্পরিক ভালোবাসার বিষয়টিই সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ রক্ষণশীল। এ সমাজ ছেলেমেয়েদের বিবাহ-পূর্ব প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে উৎসাহ জোগায় না। কিন্তু তাতে কি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা সমাজের বৃহত্তর পরিসরে তো ছেলেমেয়েরা অনায়াসে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। তা ছাড়া এ বয়সি ছেলেমেয়েদের গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটার, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদির প্রতি বিশেষ আগ্রহ কাজ করে, যাদের বেশিরভাগেরই অন্যতম প্রধান উপজীব্য হয়ে থাকে নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসার রসায়ন। সুতরাং পরস্পরের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুবাদে কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে একটি রিলেশন গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত এসে থামলে হয়তো অনেকেই তেমন কিছু মনে করতেন না। তবে আপনার মনে রাখা দরকার, এটি ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির যুগ। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। বাটনের এক চাপে যেখানে ইচ্ছে ঢুকে পড়া যায়, এমনকি নারী-পুরুষের বেড রুমেও। ফলত বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল সহজাত আকর্ষণ, এন্টারটেইনমেন্ট শিল্পের নিরন্তর ‘ভালোবাসা-ভালোবাসা’ গুঞ্জরন এবং ‘অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার’ প্রচণ্ড ঔৎসুক্য এই রিলেশনকে অনেক সময় এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যাকে এ সমাজ কোনোভাবেই অনুমোদন দিতে প্রস্তুত নয়। বিপত্তির শুরুটা হয় এখানেই। ছেলেমেয়ে অভিভাবকদের অগোচরে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা এ সমাজ কেবল বিবাহিত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেই অনুমোদন করে। বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলছে, সমাজে লুকিয়ে-চুরিয়ে নানাবিধ যৌন উত্তেজক মাদকের প্রাপ্যতা, যা সহজেই তাদের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। অনেক সময় এসব রিলেশন টেকে না। শুরু হয় অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকদ্দমা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা এমনকি আত্মহত্যা কিংবা হত্যা পর্যন্তও গড়ায়। সমস্যাটা যতটা না প্রশাসনিক বা বিচারিক, তার চেয়েও বেশি সামাজিক। এখানেই ফের চলে আসে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন। ইতোপূর্বে যেমনটি আলোচনা করা হয়েছে, এ সমস্যার এমন অনেক দিক রয়েছে যেগুলোর সমাধান ব্যক্তি বা পরিবারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি/পরিবার বড়জোর গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারে। সমাধান করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমস্যার প্রতিটি দিক নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এটাও ঠিক, একটি সমাজে যখন কোনো অনাচার বিস্তৃতি লাভ করে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের একার পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না। কাজেই রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকার পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে সমাজ ও সাধারণ্যের ইতিবাচক অংশগ্রহণেই কেবল বিদ্যমান সমস্যার নিষ্পত্তি হতে পারে। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তসমূহ রাষ্ট্রের কাছ থেকেই আসতে হবে। সবাই ভালো থাকুন।

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App