×

জাতীয়

সড়ক-মহাসড়কে এখন মোটরসাইকেল ‘ত্রাস’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ১০:১৮ এএম

সড়ক-মহাসড়কে এখন মোটরসাইকেল ‘ত্রাস’

প্রতীকী ছবি

এক বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত দেড় হাজার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ

রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র পারভেজ সাভার থেকে মোটরসাইকেলযোগে প্রতিদিনই ঢাকায় এসে ক্লাস করতেন। গত মঙ্গলবার ঢাকায় আসার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুরের বলিয়াপুরে এনআর সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনের সড়কে গাড়ি চাপায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর হাইওয়ে পুলিশ ঘাতক গাড়িটি শনাক্ত করতে পারেনি। পারভেজের মতো অসংখ্য মোটরসাইকেল আরোহী সারাদেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় অকালে মারা যাচ্ছেন। গত দুই বছরে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ও চালক যেমন বেড়েছে, তেমনি দুর্ঘটনার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। গত এক বছরে দেশে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ফলে সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল এখন ‘ত্রাস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সড়কে মোটরসাইকেলের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, ২০২০ সালে সারাদেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ হাজার ৪৩১ জন নিহত ও ৭ হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে ১ হাজার ৩৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের এই হার মোট নিহতের ২৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ২৯ দশমিক ১০ শতাংশ। দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলের দায় ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স এন্ড ম্যানুফেকচারার্স এসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) প্রতিনিধি ও টিভিএস কোম্পানির সিইও বিপ্লব কুমার রায় জানান, ২০১৯ সালে সারাদেশে প্রায় ৫ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। এর ৮০ শতাংশই বাংলাদেশে তৈরি মোটরসাইকেল। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ২ মাস লকডাউন থাকায় মানুষের চলাচলও নিয়ন্ত্রিত ছিল। তারপরও ৪ লাখের মতো মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে এবং চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সড়কের প্রধান দেখার বিষয়টি হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কয়েকটি মহাসড়ক ছাড়া দেশের অন্য সব সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি অবকাঠামোগত বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেনি। সড়কে প্রশস্ততার পাশাপাশি লাইন, লেইন ও রোড ডিভাইডার না থাকায় একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে এবং মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্ঘটনা রোধে পুলিশও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। দ্রুতগামী যানের পাশে কম গতির মোটরসাইকেল খুবই বেমানান। কিন্তু দেদার মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এককভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এখন সড়কের ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কে লাইন-লেইন নির্দিষ্ট না করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা ও না মানার প্রবণতা, সড়ক নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ না হওয়া এবং হাইওয়ে পুলিশের উদাসীনতা দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল চালকরা সড়ক-মহাসড়কে চরম বেপরোয়া। অনেকেই নতুন চালক, লাইসেন্স নেই। তারা কোনো ধরনের আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না। তিনজন যাত্রী ও মালামালের বোঝা মোটরসাইকেলে নিয়ে সড়ক-মহাসড়ক পাড়ি দিচ্ছে। এই মোটরসাইকেল চালকরাই বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের ৬৮ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।

এ প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মো. হারুন অর রশীদ ভোরের কাগজকে বলেন, হাইওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচলের কথা না। কিন্তু আমাদের দেশের এবং গ্রাম এলাকার সড়কে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মূল সড়ক দিয়েই মোটরসাইকেল চলাচল করে। তারপরও প্রতিদিনই আমরা মোটরসাইকেলসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল প্রতিরোধে অভিযান চালাই। এতে অনেক মোটরসাইকেল আটকের পর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমাদের ডাম্পিং স্টেশনগুলো এখন আটককৃত মোটরসাইকেলে পরিপূর্ণ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সংস্কৃতি চালু হওয়া, রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়া, শহর এলাকায় যানজট ও গণপরিবহনের বেহাল অবস্থার কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ও বিক্রি বেড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি মোট দামের ১০ শতাংশ কমানোর জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে প্রস্তাবটি কার্যকর হবে। তখন মোটরসাইকেলের দাম আরো কমবে এবং আরো মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে। এসব কারণে ঢাকার সড়ক পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে এখনই নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া এন্ড লিগ্যাল) ওয়ালিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, রাজধানীতে সুশৃঙ্খলভাবে মোটরসাইকেল চলাচলের ব্যাপারে চালকরা আরো সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমবে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল আটক ও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ কাজ করছে। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ নগরীর বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে, সমস্যা ধরা পড়লে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App