×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:২২ পিএম

পারমিতার জগৎ

বিকেলে আবার গিয়েও ছিলাম সবুজের সাথে দেখা করতে, কিন্তু বিকালে ওয়ার্ডে অনেক মানুষের ভিড়; সবুজের ওখানেও বেশ ক’জন দর্শনার্থী, আমি সবুজকে বিকালেও কয়েকটি আঙুর খাওয়ালাম। বারবার স্পর্শ করতে চাইছিলাম, সবুজের চোখেও আমি স্পর্শ-তৃষ্ণা দেখতে পাচ্ছিলাম; কিন্তু মানুষের ভীড় আমাদের তৃষিতই রাখলো। সন্ধ্যার পর যথারীতি পারভিন এলো এবং আমাকে হোস্টেলে নিয়ে গেল। রাতে আমার ঘুম হলো না। আমার অস্থিরতা পারভিন টের পেয়েছিলো, ও আমাকে সান্তনা দিয়ে বললো, “পারমিতা নিজেকে একটু সামলে নে। কালকে সকালে জরুরি ক্লাস আছে দু’টি, মিস করা যাবে না। কালকে তোর কবির অপারেশনও হবে। নে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।” আজকের ক্লাসটা যেনো অন্য পাঁচদিনের মতো নয়; আমি ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে মৃদু গুঞ্জরণ, কানাকানি হাসাহাসি বেড়ে গেলো মনে হলো। মনে হলো আমাদের সোহাগপর্বটি আমি ক্লাসে ঢোকার আগেই আলোচিত হয়ে গেছে। সহপাঠীদের এ আচরণে আমার কিঞ্চিত বিরক্তির উদ্রেক হলো, সেই বিরক্তিই শতগুণ বেড়ে গেল, যখন রেজা নিজের সিট থেকে উঠে এসে আমায় বললো, “দোস্ত জরুরি কথা আছে, ক্লাশ ছুটির পর একটু সময় দিস আমায়।” মুহূর্তে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠলো, কিসের দোস্ত আমি তার! কেনো গায়ে পড়ে প্রতিদিন পিতলা খাতির করতে আসে আমার কাছে? দিনটাই যেনো বিগড়ে গেল পলকে। পারভিন আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “কাকে নিয়ে বিরক্ত হচ্ছিস তুই! ও একটা ফাউল ছেলে, বিয়েতেও যুকার দেয় হাঙ্গাতেও! ওকে নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কী?” পারভিনের কথায় যেনো উত্তেজনা সামান্য প্রশমন হলো। পারভিন রহস্য করে কানে কানে প্রশ্ন করলো, “কবিকে না-কি নতুন কবিতার বিশাল রসদভাণ্ড দিয়ে আসলি? সবাই তো তোকে নিয়ে সে কথাই আলোচনা করছে!” আমি ওর পিঠে আলতো করে একটা কিল দিয়ে দু’চোখের ইশারায় ওকে সতর্ক করে দিলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম ক্লাসে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আমায় নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। হঠাৎ যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলাম; পারভিনকে মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলাম, “কী বলছে সবাই?” পারভিন হেঁয়ালির সাথে বললো, “আরে বাদ দে ওদের কথা! নিজের ইচ্ছায় তুই কিস করেছিস! তাতে ওদের কী?” পলকে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। তার মানে গতকাল যে সাহসিকতায় সবুজকে চুম্বন করেছিলাম সেটা আজ সবার আলোচ্যসূচিতে আছে? কিন্তু আমি তো সাহসিকতায় কিছু করিনি, যা করেছি, তা স্বতঃস্ফূর্ততায় করেছি, করার আগেও কিছু ভাবিনি, পরেও না। তবুও নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জানতে চাইলাম, কেনো সবুজের সাথে এই ঘনিষ্টতা, প্রকাশ্য দিবালোকে কেনো তাকে চুম্বন করা? ওকে তো আমি কখনো ‘তুমি’ সম্বোধনে ডাকিনি, তাহলে কেনো তাকে হঠাৎ ‘তুমি’ সম্বোধনে ডাকতে শুরু করলাম? ভেতর থেকে এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পেলাম না। মনে মনে কিছুটা অনুতপ্ত হলাম। সত্যিই আমার এমনটি করা ঠিক হয়নি। পারভিন আমায় মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “কীরে কী ভাবছিস? সত্যি সত্যিই তুই কবিকে কিস করেছিস না-কি?” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। ও আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বললো, “সমস্যা কোথায়? ভালোবেসেই তো চুম্বন করেছিস!” আমি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললাম, “আমার আসলে খারাপ লাগছিলো খুব ওর জন্য। ভাবলাম কাল অপারেশন হবে, যদি ওর একটা কিছু ....!” কথা শেষ করতে পারলাম না আমি, বুক ভেঙে কান্না এলো; দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। পারভিন যেনো অস্বস্তিতে পড়লো, আমায় টেনে নিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে চলে গেল। আমাদের ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসাটা কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখলো হয়তো বা। আমার বুকের ভেতর কী একটা সংশয় যেনো গোপন এক আশঙ্কার ইঙ্গিত করে গেল। আমি বিস্মিত হলাম আবার নিজেকে নিয়ে। কেনো আমার এ পরিবর্তন; কৃতকর্মের পরিনাম ভেবে শঙ্কিত হবার মতো দুর্বলতা তো কখনই আমার ছিলো না! পারভিন আমায় ভরসা দিয়ে বললো, “কীরে পারমিতা তুই কি অনুতপ্ত, না-কি শঙ্কিত?” আমি গা ঝারা দিয়ে নিজেকে শক্ত করে নিলাম। “কীসের অনুতাপ! কেনো শঙ্কা? কী অপরাধ করেছি আমি! ভালোবাসা কি অপরাধ?” পারভিন ওর সুর পাল্টালো, “দেখ পারমিতা, ভালোবাসা অপরাধ নয়, কিন্তু আমাদের সমাজ যুবক-যুবতীর ভালোবাসাকে নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখে। ঘটনাটা যদি তোর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, কী হবে ভাবতে পারছিস?” আমার মধ্যে কিঞ্চিত চাঞ্চল্য জাগলো, “আমি এখন আর কিছুই ভাবতে চাই না! আমি কেবল কবিকে নিয়েই ভাবতে চাই। ওর অপরেশন হচ্ছে আজ, জানি না যথাসময়ে জ্ঞান ফিরবে কি-না; এ সময় আমাকে মানসিকভাবে টর্চার করা কি উচিৎ? প্লিজ আমাকে এখন শুধুই সবুজের কথা ভাবতে দে।” আমি আর পারভিন চলে গেলাম অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ওখানে সবুজের দু’জন বন্ধু, ভাই আর একমাত্র বোন অপেক্ষা করছিলো। আমরা যাওয়াতে সবাই যেন কিছুটা চাঙা হয়ে উঠলো। তখনো সবুজ ভেতরেই আছে, সবার ধারনা আমরা ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে পারবো; কিন্তু সে সুযোগ ছিলো না। যখন কামাল স্যার বেরিয়ে এলেন আমি এগিয়ে গেলাম। স্যার আমায় সাহস দিয়ে বললেন, “তোমার রুগীর অপারেশন ভালোই হয়েছে; কোন কমপ্লিকেশন নেই, টেনশানের কিছুই নেই।” কামাল স্যার নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। এনেস্থিসিস্ট তুহিন স্যার তখনও বেরোননি, সুতরাং অপেক্ষা করার বিকল্প ছিলো না। সবুজের অপারেশন হয়েছে অনেক্ষণ; আমরা অপেক্ষা করছিলাম কখন ওকে পোস্টঅপারেটিভে দেয়া হবে। সবাই টেনশান করছে, আমারও টেনশান হচ্ছিলো। এসময় সবুজের বোন মাধবী আমার কাছে এগিয়ে এলো, “পারমিতা আপু সেজভাইকে অপরেশন থিয়েটার থেকে বের করা হচ্ছে না কেন? তুমি কি একটু খোঁজ নেবে?” আমি নিজের উদ্বেগ গোপন করে বললাম, “টেনশান করো না মাধবী, আমি খোঁজ নিচ্ছি।” পারভিনকে নিয়ে আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলাম। পোস্টঅপারেটিভে থাকতেই আমার আত্মীয় পরিচয়ে আমি সবুজের জন্য কেবিনে থাকার ব্যবস্থা করলাম। আমি চাইছিলাম সবুজ যেনো ওয়ার্ডে না থেকে বাকি ক’টা দিন কেবিনে নিরিবিলি থাকতে পারে। পারভিন অবশ্য আমার এ উদ্যোগটিকে ভিন্ন অর্থ করে আমায় বলে, “বুদ্ধিটা কিন্তু বেশ আবিষ্কার করেছিস তুই, এবার নিরিবিলিতে তোর কবির কাছে যেতে পারবি। তোর মায়াস্পর্শে নতুন নতুন কবিতাও লেখা হবে কবির।” পারভিনের কথায় আমি একবার চমকে উঠলাম, “তুই যেমনটি ব্যাখ্যা করলি বিষয়টি কিছুতেই তেমন কিছু নয়। আমি কেবল ওর নিরাপত্তার কথাই ভেবেছি।” আশা করছিলাম আজই সবুজকে কেবিনে শিফট করতে পারবো। আমরা যেখানটায় থাকি, সেটা আসলে মেডিকেল ছাত্রীদের নির্ধারিত হোস্টেল নয়, প্রশিক্ষণার্থী নার্সদের হোস্টেল। তারই একপাশের চারটি রুম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের জন্য। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে কলেজ কম্পাউন্ডে পা রাখতেই দেখি মাসুম রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই বললো, “তোমার কি এখন কাজ আছে?” মাসুমের কথায় আমি একটু অবাক হলাম, “কাজ আছে মানে? আমার ক্লাস আছে; ক্লাস ছাড়া আমার অন্য কী কাজ?” কী জানি কেনো মাসুমের কথাগুলো আমার একটু বাঁকা মনে হলো। মাসুম কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললো, “তোমাকে একবার বাসায় যেতে হবে। বিষয়টা জরুরি। রুহুল আসছে বারোটার ট্রেনে।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “ভাইয়া আসছে হঠাৎ! কেনো? কী হয়েছে?” মাসুম বললো, “তাতো আমি জানি না। ভাবী বললেন, তোমাকে নিয়ে যেতে। চলো, এখনই যেতে হবে।” এক মুহূর্ত আমি চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম, “এক্ষণি তো যেতে পারবো না। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে, ক্লাস শেষ করে যাবো।” মাসুম সাথে সাথে বললো, “তাহলে আমি ক’টায় আসবো তোমাকে নিতে?” আমি অবাক, “তোমাকে আসতে হবে কেনো? আমি একাই চলে যেতে পারবো। তুমি যাও, আমি ক্লাস দু’টি শেষ করেই চলে আসবো।” মাসুম অনিচ্ছায়ও চলে যায়। আমার ভেতর যেনো হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে গেল। পারভিনকে বললাম, “দোস্ত তুই ক্লাসে যা, আমার আজ আর ক্লাস করা হবে না। আমি কবিকে কেবিনে তুলে দিয়ে মেজ’পার বাসায় যাবো। আমি তো জানি না খবরটা কী, ভাইয়া কেনো আসছে, তাও জানি না। আমি না আসা পর্যন্ত তুই কবির একটু খোঁজ রাখবি, বল?” পারভিন বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “সে কথা তোর বলে দিতে হবে! তুই কিচ্ছু ভাবিস না পারমিতা, তোর কবির খোঁজ আমি ঠিকঠাক রাখবো।” মুহূর্তে মনটাকে গুছিয়ে নিলাম। “তুই ক্লাসে যা পারভিন, আমি ওকে কেবিনে উঠিয়ে দিয়ে আসছি।” আমি হাসপাতালের অফিসের দিকে পা বাড়াই, পারভিন পেছন থেকে বলে- : আমি কি তোর সাথে আসবো? : আসতে হবে না, তুই ক্লাস ফলো করে যা ঠিক করে। পারভিন ক্লাসে যায়, আমি অফিসের দিকে হাঁটি। ওয়ার্ড থেকে সবুজকে নিউকেবিনের তিন নম্বর কক্ষে শিফটের ব্যবস্থা করে ওকে শুইয়ে দিয়ে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। একদিকে বাড়ি থেকে হঠাৎ তলবের উদ্বেগ, অন্যদিকে সবুজকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ছেড়ে যাবার কষ্ট আমার ভেতরে ভাঙচুর করে চলছিলো। সবুজ তন্দ্রার ঘোরে আচ্ছন্ন অচেতন পড়ে আছে, অথচ আমাকে চলে যেতে হচ্ছে ওকে ছেড়ে। অবসন্ন পায়ে আমি সবুজের কাছে পৌঁছলাম। ওর বাঁ হাতে স্যালাইন চলছিলো, আমি ওর ডান হাতটা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে মনে প্রাণে ওকে আহ্বান করি, কিছুক্ষণের মধ্যে সবুজের শরীরে আমি স্পন্দন টের পেলাম। মনে হলো সবুজ যেনো এবার আমার কথা শুনবে। আমি সবুজের হাতটা নিজের গালে ছুঁইয়ে বললাম, “সবুজ, তুমি একদম টেনশান করবে না। আমি জরুরি খবর পেয়ে বাসায় যাচ্ছি, জানি না, কেনো আমায় ডাকা হয়েছে; যদি জামালপুর যেতে হয়, তাহলে হয়তো ফিরতে দু’চারদিন বিলম্ব হবে, না হয় সন্ধ্যায়ই ফিরবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App