×

সাময়িকী

ধ্রুবকথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১২ পিএম

ধ্রুবকথা

ছবি : কামরুল হাসান মিথুন

ধ্রুব এষের জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জে। মা লীলা এষ, বাবা ভ‚পতি এষ। চারুকলা শিল্পী ধ্রুব এষকে মানুষ চেনেন একজন নামজাদা প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পে তার ভ‚মিকা রীতিমতো অবিস্মরণীয় ঘটনা। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ধ্রুব এষকে নামে চেনেন দীর্ঘকাল, সরাসরি দেখেননি। সহস্রাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় বইগুলোর অধিকাংশ প্রচ্ছদ তার করা। অসংখ্য প্রচ্ছদের ভিড়ে পাঠকের চিনে নিতে কষ্ট হয় না ধ্রুবর কাজগুলো। সাহিত্যিক হিসেবে রয়েছে ধ্রুবএষের আলাদা খ্যাতি। বিশেষ করে ছোটদের জন্য লেখা তার ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প ও সায়েন্স ফিকশন আলাদাভাবে মূল্যবান। ধ্রুব এষের লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। আঁকা-লেখা দুই জায়গাতেই তিনি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। বন্ধু অদ্রীশ বিশ্বাসের ভাষায়, ‘বাংলা প্রচ্ছদে সুররিয়ালিজমের প্রবর্তক ধ্রুব এষ। যদিও অনেক দেরি হলো এই লক্ষণ আসতে কিন্তু দেরিতে হলেও যা ঘটেছে তার মূল্য অসীম। কারণ নামি থেকে আমজনতার প্রচ্ছদে এই ফরাসি চিত্রকলার ধর্মটা, আন্দোলনের প্রভাবটা ধরা পড়েছে। উনিই সম্ভবত দুই বাংলার সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদশিল্পীর রেকর্ডের অধিকারী। একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন শুধু একুশে বইমেলা উপলক্ষে যে বই বের হয় বাংলাদেশে তাতে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ প্রচ্ছদ উনি বানান। এটা আর কেউ কখনো মানসিক ও শারীরিকভাবে করতে পারেননি। এই অসম্ভব ঘটনাটা প্রত্যেক বছর তিনি ঘটান। আর তার সঙ্গে ওর কাজে একটা মান থাকে, একটা বুড়ো আঙুলের ছাপ থাকে, নিজস্বতা, আইডেনটিটি, যেটা উনি ধারাবাহিকভাবে মেনটেন করেন। তো, সেই আইডেনটিটি বা সুররিয়ালিজম ধর্মটা সব পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। তিনি সেই ধারাটা সম্পর্কে জানুন বা না জানুন। এর ফলে এক ধরনের শিল্প-শিক্ষায় শিক্ষিত করেন ওর প্রচ্ছদের মধ্য দিয়ে।’ পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে তুলির আঁচড়ে বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষ। বইমেলা এলে তার দিন-রাত কাটে ভীষণ ব্যস্ততায়। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আড্ডা দেন সবার সঙ্গে। সে আড্ডায় অনেক কথা বলেন- প্রয়োজনের কথা, স্বপ্নের কথা, শিল্পের কথা, সাহিত্যের কথা, আরও কত কী। এ নিবন্ধে তার বলা নানা সময়ের কথা বা আলাপের একটা অংশ এখানে তুলে ধরছি : -আসলে বইমেলা নিয়ে আমার আলাদা কোনো ব্যস্ততা নেই। সারা বছরই আমার তুমুল ব্যস্ততা। তবে বইমেলার প্রচ্ছদের কাজ শুরু করি প্রতি বছর নভেম্বরের পর থেকে এবং কাজ চলতে থাকে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ পর্যন্ত। কতগুলো প্রচ্ছদ এখন পর্যন্ত করেছি তার সঠিক হিসাব নেই। কয়েক হাজারের অধিক প্রচ্ছদের কাজ এরই মধ্যে করা হয়েছে। আমাদের বিখ্যাত লেখক যারা আছেন তাদের সবার প্রচ্ছদের কাজই করেছি। এর মধ্যে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, শামসুজ্জামান খান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক- আর কত নাম বলব? প্রায় সব লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদের কাজ করেছি। আমি নিজে এ কাজ করে স্বাবলম্বী। এটা করেই তো আমি জীবিকা নির্বাহ করি। অন্য যারা প্রচ্ছদ-অলঙ্করণ করছেন, তারাও স্বাবলম্বী। এখন অনেক বই হচ্ছে। মোট কথা হচ্ছে, প্রচ্ছদ শিল্পকে এখন পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। -এবারের মেলায় আমার বেশ ক’টা বই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমার বইয়ের প্রচ্ছদ আমি করি না। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটা করতে হয়। বইমেলায় আমার যাওয়া হয় না। কীভাবে যাব? রাত-দিন কাজের চাপে থাকি। মন চাইলেও যেতে পারি না। -আমাদের দেশে এখন আর প্রচ্ছদশিল্পীর সংকট নেই। অনেক প্রতিভাবান লোকজন এ অঙ্গনে কাজ করছে। খুব ভালো শিল্পীর মধ্যে সব্যসাচী হাজরা একজন। এ ছাড়া মোস্তাফিজ কারিগর আছে। নতুন কয়েকজন আছে- রাজীব দত্ত, বিপ্লব চক্রবর্তী, রজত, এরা খুব ভালো করছে। মানবেন্দ্র গোলদার, মামুন হোসাইনরা খুবই ভালো আঁকছে। আর একটা কথা, রজত তো আমার বেশ কটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছে। -অতীতের সঙ্গে বর্তমানের প্রচ্ছদ না মেলানোই ভালো। দশ বছর আগের কাজের সঙ্গেই তো বর্তমান কাজের অনেক পার্থক্য। তারও আগে বøক করে প্রচ্ছদ করা হতো। কিন্তু এখন কম্পিউটারে কাজ করা হয়। বর্তমান প্রচ্ছদ সম্পূর্ণভাবে কম্পিউটারাইজড। আগে উপন্যাসে প্রচ্ছদ মানেই মনে করা হতো মানুষের ফিগার। কিন্তু এখন একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়েও প্রচ্ছদ হচ্ছে। বলা যায় এখনকার প্রচ্ছদে শিল্পী অনেক কিছুই ব্যবহার করছেন। আসল ব্যাপার হলো, যা প্রকাশ করা প্রয়োজন তা প্রকাশিত হচ্ছে কিনা। মানুষের ধারণার মধ্যে যা আছে, সবই প্রচ্ছদের উপাদান। আমার কাজে লেখকরা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ভাই। হুমায়ূন আহমেদ তো আমাকে বলেই দিয়েছিলেন, তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো। তার প্রচ্ছদ নিয়ে কোনো বাধাধরা নিয়ম ছিল না। বরং আমি বলব, বর্তমান প্রচ্ছদে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান রয়েছে। তার বইয়ের প্রচ্ছদেই প্রথম নানা বিষয় বিচিত্রভাবে উঠে আসে। আমাকে কোনো প্রকাশকও এমন কিছু বলেন না। আর এমন কেউ বললে আমি তার কাজ করি না। কারণ কাজের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো কাজ করা যায় না। কাজের স্বাধীনতাই কাজকে আরও মানসম্পন্ন এবং গতিশীল করে। -একজন প্রচ্ছদশিল্পী বা অলঙ্করণশিল্পীকে যথেষ্ট সিনসিয়ার হতে হয়। তরুণদের প্রচুর ভাবতে হবে। যথেষ্ট অনুশীলন করতে হবে। পড়তে হবে তারও বেশি। মোট কথা বইয়ের ভেতর ঢুকতে হবে। ভালো কাজ করতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আর অবশ্যই কাজের মধ্যে থাকতে হবে স্বাধীনতা। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণশিল্পীর কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পরিধিও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এখনো আমাদের গ্রাফিকস ডিজাইনারের খুব অভাব। -কথা সত্যি। অনেক বেশি চুপচাপ ছিলাম। একদমই দস্যি ছিলাম না। গাছে চড়তাম না, দুষ্টুমি করতাম না। বন্ধু ছিল বেশ কয়েকজন। তাদের সঙ্গেই ঘুরতাম। খুব বেশি কথা বলতাম না। নিজের মতো করেই থাকতে চেষ্টা করতাম। অনেকটা যাকে বলে নির্ভেজাল ভালো মানুষ। ছোটবেলাতে এমন একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল, যাকে এক কথায় বলা যায় ‘প্রথম চুরির ঘটনা’। প্রথম চুরি করেছিলাম দুই টাকা, তাও আবার বাবার পকেট থেকে। তখন আমি ক্লাস টুতে পড়ি। তখন দুই টাকা মানে অনেক টাকা। সেই টাকা নিয়ে বাড়ির পাশের সুলতান ভাইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম। তিনি আমার হাতে এত টাকা দেখে একটু অবাক হয়েছিলেন। হাতে চা আর বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তুই বস আমি একটু আসছি। এর অনেকক্ষণ পর আমি যখন বাড়ি ফিরলাম তখনই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। সুলতান ভাই তখন আমাদের বাড়ির ভেতরে। মিটমিট করে হাসছে। ধরা পড়ে গেলাম। তখন আমার এক পিসতুতো ভাই ছিল। সে আমাকে একটা শাস্তি দিল। আমাকে নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরাল। এবাড়ি ওবাড়ির যে-ই জানতে চায় কী হয়েছে, তাকেই বলল, চুরি করে ধরা পড়েছে। অপমান ঠিক লেগেছিল কিনা মনে নেই। তবে ঘটনাটা বেশ মনে আছে আমার। আসলে আমি তো শান্তই ছিলাম। কিন্তু আমার বন্ধুরা যে দুষ্টুমিগুলো করত সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম আর কী। মাছ ধরার সময়ও ওরা ধরত আর আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে দেখতাম। নিজে সেভাবে চুরি করতাম না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App