×

অর্থনীতি

করোনাকালেও দেশে বাড়ছে আয়বৈষম্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৫৯ এএম

করোনাকালেও দেশে বাড়ছে আয়বৈষম্য
করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশেও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। নতুন বছরে একমাত্র ভরসা হচ্ছে ভ্যাকসিন। অর্থাৎ টিকা ছাড়া কোনো মুক্তি নেই। এ টিকা নিয়েও বিশ্বব্যাপী চলছে এক ধরনের ‘বৈষম্য’। অর্থাৎ টিকাপ্রাপ্তি ও টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে টিকা নিয়ে যখন বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তখন বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদ বাড়িয়ে চলেছেন। এতে করে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছেন। অপরদিকে বাড়ছে অতিদরিদ্রের সংখ্যা। উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প যেভাবে নেয়া হচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেভাবে বণ্টন হচ্ছে, তাতে জিডিপি বাড়লেও একই সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যও বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় কিছু লোকের হাতে অনেক বেশি সম্পদ চলে গেছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে অনেকে টাকা বাড়াচ্ছে। ফলে তারা ধনী হচ্ছে। করোনার মধ্যে এটা আরো বেড়েছে, অনেকে করোনার সুযোগ নিচ্ছে। আর কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় গরিব আরো নাজুক অবস্থায় পড়ছে। গত বছরের জুন মাসে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক গবেষণায় উল্লেখ করে, চলমান কোভিড-১৯ অতিমারিতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আয় ও ভোগবৈষম্য বাড়ছে। ২০২০ সালে দেশে আয়বৈষম্য গিনি সূচক শূন্য দশমিক ৫২, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮। ভোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বেড়ে হয়েছে গিনি সূচক শূন্য দশমিক ৩৫, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২। বরিশাল থেকে জীবিকার টানে ঢাকায় আসেন করিম শেখ। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে। পেশায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা। স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। ভালোই চলছিল সংসার। নিজেদের খরচ মিটিয়ে প্রতি মাসে বাবা-মার জন্য গ্রামের বাড়িতে কিছু টাকাও পাঠাতেন। মাস শেষে কিছু সঞ্চয়ও করতেন। করোনার প্রভাবে একদিকে ঝালমুড়ি বিক্রিতে যেমন ধস নেমেছে অন্যদিকে স্ত্রী কাজ হারিয়েছেন। ঝালমুড়ির আয় দিয়ে সংসার চলছিল না, কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রী আর সন্তানকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে ঢাকায় থাকছেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে করিম শেখ ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা ভাইরাসের ভয়ে মানুষ ঝালমুড়ি খেতে চায় না। সবার মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। তাছাড়া মানুষের আয় আগের মতো নাই, অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেকের বেতন কমে গেছে, ছাত্ররা ঢাকায় নাই। আমাদের বেচাকেনাও আগের মতো নেই। করিম শেখের মতো প্রায় একই অবস্থায় পড়েছেন রিকশা-ভ্যান মেরামত করা মোহাম্মদ বিপ্লব। প্রায় ৪০ বছর ধরে আছেন কাওরানবাজারে। এসেছেন রংপুর থেকে। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে থাকেন। ছেলে মাদরাসায় পড়াশোনা করে। মেয়ে বাসায় থাকে। এগারো বছর ধরে তিনি রিকশা-ভ্যান মেরামত করেন। রিকশাচালকদের আয় কমাতে তার আয়ও কমে গেছে বলে জানালেন। বিপ্লব বলেন, রিকশা চালকদের যখন আয় ভালো হতো তখন রিকশায় কোনো সমস্যা দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে নিয়ে আসত। এখন যে আয় হয় তা দিয়ে তারাই চলতে পারে না। রিকশায় টুকটাক সমস্যা দেখা দিলে সারাতে আসেন না, কষ্ট করে চালান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) মতে, করোনার সময়ে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চ মাসে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবার প্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা। ডিসেম্বর এসে আয় আরো কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছে মোট দেড় কোটি মানুষ। তবে করোনা মহামারির সময়ে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে, সেখানে দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারি প্রভাবের মধ্যেই গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১ কোটি টাকার বেশি জমা অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮৬৫টি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৯০টিতে। যা এপ্রিল শেষে ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। এ সময়েই দেশে করোনা ভাইরাস মহামারির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল। এসব অ্যাকাউন্টে জমা অর্থের পরিমাণও সেপ্টেম্বর শেষে ৩৮ হাজার ২ কোটি টাকা বেড়ে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৬ মাস আগেও এসব অ্যাকাউন্টে জমা ছিল ৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বিবেচনা করলে ১১ কোটি ২৭ লাখ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে কোটিপতি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা শূন্য দশমিক ০৭৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এসব অ্যাকাউন্টধারীদের আমানতের পরিমাণ মোট আমানতের ৪২ শতাংশ বা ১৩ লাখ ১২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। অপরদিকে ১০ কোটি ৪ লাখ বা ৮৯ শতাংশ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৭৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা বা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের আয়বৈষম্য, ভোগবৈষম্য এবং সম্পদবৈষম্য বাড়ছে। করোনা অতিমারির মধ্যে এ বৈষম্য আরো বাড়তে দেখা গেছে। যা অর্থনীতির জন্য খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার জন্য আয়বৈষম্য ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। এটা বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আয়বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আয়বৈষম্য বাড়ার বড় কারণ আমাদের বেতন মজুরি যে হারে বাড়ছে সে তুলনায় সম্পদের আয় বেশি। ভালো মজুরি এবং ভালো কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারছি না। ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আয়বৈষম্য। সুতরাং আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে, ভালো কর্ম সৃষ্টি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে এবং সম্পদ বেশি হলে সমাজে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে, আয়বৈষম্যের ফলে তা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। দেশে আয়বৈষম্য বাড়ার কারণ সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কলেন, করোনা মহামারির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য একটি বৈশ্বিক ঘটনা। বৈষম্য মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। করোনাকালীন সময়ে ধনী ব্যক্তিরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সমর্থন পেয়েছেন। এদের অনেকেই এ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। অপরদিকে, দরিদ্র লোকেরা এ জাতীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বড় শিল্পের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন হলেও এসএমই খাতে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। আরো দেখা গেছে, দেশের ধনী ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে কম কর দেয় এবং নানাভাবে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে অব্যাহতি পায়। বিশ্বব্যাপী বৈষম্য দূর করার জন্য কর ব্যবস্থার ব্যবহার করা হয়। দেশে কোটিপতি বাড়ছে, অথচ এ বিষয়ে কোনো প্রাসঙ্গিক গবেষণা করা হয়নি। মহামারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। দেশে আয় বৈষম্য কমাতে হলে উপযুক্ত নীতিমালা তৈরি করতে হবে।    

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App