×

জাতীয়

উপাচার্য নিয়োগে গড়িমসি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৪ এএম

উপাচার্য নিয়োগে গড়িমসি!

ইউজিসি

দেশের ৩২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (ভিসি) নেই। ৩৩টিতে নেই উপ-উপাচার্য এবং ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোষাধ্যক্ষ। এসব পদ পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে গত ৫ মাসে তিনবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। পদ পূরণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গড়িমসি রয়েছে। পরিচালনা ব্যয় সংকোচন ও অনিয়মের পথ খোলা রাখতেই এসব পদ পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনীহ বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এ নিয়ে গাছাড়াভাবে কাজ করছে। প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ রয়েছেন মাত্র ১১ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩২টিতে নেই উপাচার্য, ৩৩টিতে নেই উপ-উপাচার্য, ১৫টিতে নেই কোষাধ্যক্ষ, ১৩টি এখনও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। তিনটিতে আদালতের হস্তক্ষেপ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে ইউজিসিকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য/উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ পূরণের জন্য তিনজনের প্যানেল প্রস্তুত করে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তা করেনি। এ অবস্থায় একই বিষয়ে ফের চিঠি দিয়ে গত ৮ অক্টোবরের মধ্যে পদ পূরণের কথা জানায় মন্ত্রণালয়। তবুও প্রস্তাব আসেনি মন্ত্রণালয়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি ফের চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে পদ পূরণের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা করে অবশ্যই মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। এই সময়ের মধ্যে প্রস্তাব পাওয়া না গেলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানিয়েছে, মূলত দুটো কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে চায় না। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ইচ্ছে করেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পদ পূরণের জন্য আইন অনুযায়ী তালিকা দেয় না। তালিকাটি আইন অনুযায়ী না হলে চিঠি চালাচালি হবে, সময়ক্ষেপণ হবে। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পোয়াবারো। আরেকটি কারণ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য দুর্বল প্রার্থীদের তালিকা দেয়। এই দুর্বল তালিকা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে না। এর ফলে পদগুলো সহসা পূরণ হয় না। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই লাভ। তবে কমিশন বলছে, মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলবে যাতে দ্রুত পদগুলো পূরণ করা যায়। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ ভোরের কাগজকে বলেন, ওরা খুব চালাক, প্রতিটি কাজে চালাকি করে। তিনজনের নাম দিয়ে প্যানেল তৈরি করে পাঠায়, কিন্তু যাচাইকালে দেখা যায় একজন যোগ্য, বাকি দুজনই অযোগ্য। তালিকায় একজন অযোগ্য হলে সেটি অনুমোদন পাবে না জেনেও তারা পাঠায়। এছাড়া তারা নিজেদের মতো করে প্যানেল তৈরি করে। কিন্তু এটিও আইনের বিধি মেনে হয় না। তিনি বলেন, তারা জানে যতক্ষণ পর্যন্ত এসব চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের লোক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবে। এতে পরিচালনা ব্যয় কমবে, পাশাপাশি অনিয়মের পথও খোলা থাকবে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তা সম্ভব নয়। কমপক্ষে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ থাকতেই হবে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলেছি যতক্ষণ পর্যন্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন কোনো কোর্স চালু করতে পারবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে আইনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ এ পদ পূরণে অনীহা দেখাচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরেই তাগাদা দিয়ে এলেও তেমন সাড়া মিলছে না। শীর্ষ এ পদগুলোয় নিয়োগ না দিয়ে এর পরিবর্তে কোথাও ‘ডেজিগনেটেড’ আবার কোথাও ‘ভারপ্রাপ্ত’ দিয়ে চালাচ্ছে। এতে নামে অলাভজনক হলেও বাস্তবে লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে লাভবান হচ্ছে, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্র্যাজুয়েটরা। নিয়মিত উপাচার্য না থাকলে সমাবর্তন করা যায় না। মূল সনদ পাওয়া যায় না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক পক্ষ কর্তৃক নিযুক্তরা নানা পদবি ব্যবহার করে দায়িত্ব পালন করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী এ ধরনের পদে এভাবে নিয়োগ বা দায়িত্ব পালনের কোনোটিই বৈধ নয়। যে ১১টিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য আছে : আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য নেই : ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (সৈয়দপুর, নাটোর), নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি, রূপায়ন এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা খান বাহাদুর আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং আরটিএম আল কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ এ তিন পদে নিয়োগ দেন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি। তবে প্রাথমিক কাজটি করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পর তারাই সরকারের কাছে এসব পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। কিন্তু এই কাজে ঢিলেমি হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এ তিন পদে নিয়োগ দিতে একেকটি পদের বিপরীতে তিনজন অধ্যাপকের নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেগুলোর ইউজিসির মাধ্যমে যাচাই করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেন। ইউজিসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনুমোদিত ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শীর্ষ পদে নিয়োগের জন্য ৩২১ জন অধ্যাপকের প্রয়োজন। কিন্তু এত যোগ্য ও পছন্দ অনুযায়ী অধ্যাপক পাওয়া একটি সমস্যা। অভিযোগ আছে, আইন অমান্য করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে কাউকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়, যা আইনের পরিপন্থী। কারণ, রাষ্ট্রপতি ছাড়া এই তিন পদে অন্য কেউ নিয়োগ দিতে পারেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App