×

মুক্তচিন্তা

নেতা পাচ্ছি অভিভাবক কি পাচ্ছি?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২১, ১০:১৪ পিএম

সাংবাদিকরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে দেশ। ভালো থাকবে সমাজ। সাংবাদিকদের কাজ অধিকার আদায়ে রাজপথে নামা নয়। সাংবাদিকদের কাজ দেশের স্বার্থ নিয়ে ভাবার। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা। এসব বিষয়ে আমাদের নতুন অভিভাবকরাও কাজ করবেন। নির্বাচনে জয়ী হলে নেতা হয়তো হওয়া যায় কিন্তু অভিভাবকের জায়গাটা দখল করে নিতে হয় মমতা দিয়ে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নেতা ও নেতৃত্ব শব্দযুগল বহুল পরিচিত। সবার ওপরে একটি বিষয়ে বাঙালিদের আগ্রহ লক্ষণীয়। আর তা হলো ‘রাজনীতি’। বাঙালি রাজনৈতিক প্রাণী। পেটে ভাত বা পকেটে টাকা না থাকলেও অনেক সময় চলে। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া বাঙালির যেন জীবন অচল। বলা যায় জন্মগতভাবেই বাঙালি রাজনৈতিক প্রাণী। চায়ের দোকানে, বাসে বা ট্রেনে, আড্ডায় বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অনায়াসেই উঠে আসে রাজনৈতিক আলোচনা। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি গোষ্ঠীই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রীয় উঁচু পর্যায় থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা এমনকি গ্রাম-গঞ্জে প্রতিটি জায়গায়ই দেখা মেলে নানা ধরনের সংগঠনের। ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়, শিল্পী, উকিল, ডাক্তার থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে সম্পৃক্ত। সবাই নানা নামে, নানা ভাগে গোষ্ঠীবদ্ধ। এর পেছনেও থাকে সুনির্দিষ্ট নেতৃত্ব। থাকেন নেতা। তা নিয়েও চলে নানা রাজনীতি। নেতা হন অনেকে সেবা করতে। অনেকে নিজ স্বার্থ উসুল করতে। বর্তমানে বলা যায়, সাধারণদের ওপর ভর করে তর তর করে উঠে যাওয়ার নামই রাজনীতি। যে নেতা যত চতুরতার সঙ্গে নিজেকে এগিয়ে নিতে পারেন বলা হয় তিনি তত ভালো রাজনীতিবিদ। তিনি তত ভালো রাজনীতি বোঝেন। প্রতারিত হয়ে অনেক সময় সেই নেতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণরা। তুলে আনে নতুন কাউকে। আবার শুরু হয় স্বপ্ন দেখা। বাঙালি স্বপ্নবাজ জাতি। আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। একসময় আমরা স্বপ্ন দেখলাম, মুসলমানের আলাদা দেশ হলে আমরা ভালো থাকব, সুখে থাকব। আমরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ হুঙ্কার দিয়ে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র তৈরি করলাম। কিন্তু মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ভাষার প্রশ্নে আমরা উপলব্ধি করলাম, আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছি। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকজুড়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছি একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার। সে জন্য লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে। অগুনতি মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক দেশ পেলাম বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুতেই আমরা হোঁচট খেলাম। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হলো। বৈষম্য বাড়তেই লাগল। আজো সে ধারাবাহিকতা চলমান। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গণমাধ্যমের নেতৃত্ব নিয়ে কিছু বলার প্রয়াস। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগ থেকেই গণমাধ্যম ব্যাপক ভ‚মিকা পালন করেছে। এরপর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনষাটের গণঅভুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনেই সাংবাদিকদের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। এখন পর্যন্ত দেশের যে কোনো আন্দোলন বা অধিকার আদায়ে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে দেশীয় গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় এ গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার কি বাস্তবায়ন হচ্ছে? ঢাকা শহরে এত এত সংগঠন থাকতেও অনেক সাংবাদিক বেতন না পেয়ে প্রতিনিয়ত ভুগছেন। অসহায়ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মালিকপক্ষ ঠিকই দাপটের সঙ্গে অস্বীকার করছে শ্রমিকের পাওনা। সাংবাদিককে অসহায় হয়েই ভুলে থাকতে হচ্ছে ন্যায্যপ্রাপ্যের কথা। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না পাশে। পেলেও তা অপ্রতুল। অথচ অন্য সব গোষ্ঠীর মতো সাংবাদিকদেরও সংগঠন রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বলা যায়, একটু বেশিই রয়েছে। দিনে দিনে যে হারে বাড়ছে সাংবাদিকের সংখ্যা সমান হারে বাড়ছে সাংবাদিক সংগঠনের সংখ্যা। বাড়ছে নেতার সংখ্যা। নেতার ব্যাখ্যায় একটি শব্দই ব্যবহার করা যায়। তা হলো ‘অভিভাবক’। কিন্তু বর্তমান সময়ের কতজন নেতার মধ্যে এই অভিভাবকত্ব রয়েছে? আমরা নেতা পাচ্ছি গণ্ডায় গণ্ডায় কিন্তু অভিভাবক কি পাচ্ছি সেভাবে? এখানেও দেখা মেলে সুবিধা সন্ধানী নেতাদের। আবার সাধারণদের অধিকার আদায়ের নেতাও রয়েছেন। যদিও তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এত সংগঠন, এত নেতা থাকা সত্তে¡ও গণমাধ্যমকর্মীদের সমস্যার সমাধান সেভাবে হচ্ছে না। বরং বাড়ছে অনেকটা। তবু আমরা আশ্রয় খুঁজি। প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আসে। নেতৃত্বে আসে নতুন মুখ। পুরনোরা যারা অভিভাবকসুলভ আচরণ করতে পেরেছেন বা সাধারণ সাংবাদিকদের পাশে থেকেছেন তাদের বারবার অভিভাবকের আসনে রাখা হয়। তাদের কাছে প্রত্যাশাও থাকে বেশি। থাকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ। সাংবাদিকদের বলা হয় রাষ্ট্রের পাহারাদার। গণতন্ত্রের পাহারাদার। আর সেই সাংবাদিকদের পাহারাদার হচ্ছে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। ঢাকায় অনেক সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন হিসেবেই পরিচিত এগুলো। দিনে দিনে এর সংখ্যাও বাড়ছে। এর মধ্যেও কিছু নির্ভরশীল সংগঠন রয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কয়েকটা উল্লেখযোগ্য সংগঠনের উৎসবমুখর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। শীর্ষ সংগঠন প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) নির্বাচন শেষ হতে না হতেই সামনে এলো ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের নির্বাচন। সামনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) নির্বাচন আছে। উল্লিখিত প্রত্যেকটি সংগঠনই নানাভাবে আলোচিত। অসংখ্য সংগঠনের মধ্যে তুলনামূলক মাথা উঁচু করেই আছে। এই ৬টি সংগঠনের পরিসংখ্যান ধরলেও নির্বাচিত নেতা রয়েছেন কমপক্ষে ১২০ জন। প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন তিন-চার গুণ। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ নেতা রয়েছেন সাংবাদিকদের। এই ৫০০ নেতা যদি একত্রিত হয়ে কোনো মালিকপক্ষের কাছে যান কর্মীর পাওনা আদায়ের জন্য, নিষ্ফল হওয়ার কথা নয়। তবু আমরা ব্যর্থ হই। প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হই। সাম্প্রতিক মহামারি করোনা-ধাক্কার মধ্যে বোধহয় একটু বেশিই নাড়া খেয়েছে গণমাধ্যমকর্মীরা। বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হয়েছে বড় অঙ্কে। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ছাঁটাইয়ের সঙ্গে বেতন অনিয়মিত করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বেতন কমিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে একটা খারাপ সময়ের মধ্যেই পড়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এই খারাপ সময়ে ক’জন নেতাকে আমরা পাশে পেয়েছি। একেবারে কাউকেই পাওয়া যায়নি সে কথা বলছি না। তবে আজ যারা নির্বাচিত হতে মাঠে পুরোদস্তুর সক্রিয়, সকাল-বিকাল ফোন-ফেসবুকে খোঁজ নিচ্ছেন তারা দুঃসময়ে কয়বার খোঁজ নিয়েছেন? তাদের ভ‚মিকাই বা কী ছিল? হিসাব প্রত্যেকের কাছেই আছে। সাধারণ ভোটারের ক্ষমতা নির্বাচনের সময়টুকুই। ওতে খুব কিছু ফল হয় কিনা সে নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। তবে একেবারেই মূল্যহীন বলার উপায় নিশ্চয় নেই। অতিক্ষুদ্রাকারে হলেও যতটুকু ক্ষমতা আছে নেতা বাছাই যথাযথ প্রয়োগ চাই। পেশাগত কারণেই অন্যদের তুলনায় সাংবাদিকদের একটু বেশি বিচক্ষণ হতে হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়। অন্যদের যে বিষয়ে পইপই করে বোঝাতে হয়, সাংবাদিকদের তা ইশারা করলেই চলে। চলার কথা। সেই চিন্তা থেকেই আজকের আহŸান। স্রোতে গা না ভাসিয়ে ভেবে-চিন্তে নেতা নির্বাচন করতে হবে। যোগ্য মানুষের হাতেই তুলে দিতে হবে নেতৃত্বের ঝাণ্ডা। অনেক অ-নেতার মধ্যেও কিছু যোগ্য নেতৃত্ব থাকেন। যারা নিভৃতে নন্দিত হন। যার প্রতি ভরসা থাকে, বিশ্বাস থাকে, আস্থা থাকে তাকেই বসানো যায় অভিভাবকের আসনে। এরপর থেকে অভিভাবকত্বের আসনে যারা বসবেন তাদের প্রতিও আমাদের আস্থা আছে। আছে কিছু প্রত্যাশাও। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান কৌশল হিসেবে নিয়োগপত্র না দিয়েই সাংবাদিক নিয়োগ দেন। যেন পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে আইনি সহায়তা না পান। সাংবাদিকরাও নিরুপায় হয়ে চাকরি হারানোর ভয়ে মেনে নেন। এ রকম অসংখ্য ফাঁক-ফোকর নিত্য তৈরি করে সাংবাদিক ঠকানোয় লিপ্ত রয়েছে নতুন নতুন কিছু প্রতিষ্ঠান। আশা করি নতুন নেতৃত্ব এসব বিষয়ে কাজ করবেন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে মালিকপক্ষের বিপক্ষে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবেন না। সাংবাদিকদের ভালো থাকার ব্যবস্থা হবে। আমার বিশ্বাস সাংবাদিকরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে দেশ। ভালো থাকবে সমাজ। সাংবাদিকদের কাজ অধিকার আদায়ে রাজপথে নামা নয়। সাংবাদিকদের কাজ দেশের স্বার্থ নিয়ে ভাবার। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা। এসব বিষয়ে আমাদের নতুন অভিভাবকরাও কাজ করবেন। নির্বাচনে জয়ী হলে নেতা হয়তো হওয়া যায় কিন্তু অভিভাবকের জায়গাটা দখল করে নিতে হয় মমতা দিয়ে। পাশে থেকে। সেটার জন্য নির্বাচনে জয়ী হওয়া জরুরি নয়। আমরা অভিভাবক চাই। রনি রেজা : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App