×

জাতীয়

মহাসড়কে শৃঙ্খলার বালাই নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:২৭ এএম

মহাসড়কে শৃঙ্খলার বালাই নেই

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দ্রুতগামী যানবাহনের পাশাপাশি অবাধে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। স্বল্প গতির এসব যানবাহনের এলোপাতাড়ি চলাচলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ১০ জানুয়ারি সাভারের বালিয়াপুর থেকে তোলা ছবি -মামুন আবেদীন

৫ বছরেও ধীরগতির যান চলাচল বন্ধ হয়নি আইন প্রয়োগে হাইওয়ে পুলিশ উদাসীন

দেশের সড়ক-মহাসড়কে কোনো আইন-কানুনের বালাই নেই। একদিকে যেমন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, অন্যদিকে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। আইন প্রয়োগে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনীহা এখনো আগের অবস্থায় রয়েছে। সুশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের দেয়া মতামত অদৃশ্য কারণে অগ্রাহ্যই থেকে গেছে।

গত দুই বছরে নতুন সড়ক আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন হয়নি। মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে থ্রি-হুইলারসহ সব ধরনের ধীরগতির যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও এখনো তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশের সব মহাসড়কে থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলারসহ সব ধরনের অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করার কথা জানান। এরপর থেকে দেশের ২২টি মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরই অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে যায়। সরকারের ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা একেবারেই টেকসই হয়নি।

যদিও এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে তখনই বিভিন্ন মহলে সংশয় দেখা দেয়। মহাসড়কে চলমান বিশৃঙ্খলার সর্বশেষ বলি হচ্ছে গত রবিবার মহমনসিংহে বাস-সিএনজি অটোরিকশা সংঘর্ষে ৭ অটোরিকশাযাত্রী। এর আগে ২০১৪ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার মহাসড়কে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নসিমন, করিমন ও ভটভটি চলাচলে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় সেই নির্দেশনাও কার্যকর হয়নি।

বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ এ প্রসঙ্গে বলেন, সড়ক নির্মাণের পর ‘সেফটি অডিট’ করা জরুরি। আমাদের দেশে এটা করা হয় না। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১১টি সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই সুপারিশেই সড়ক মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সব ধরনের গাইডলাইন দেয়া আছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মহাসড়কে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও সড়কে সব ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সারাদেশের সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, যানবাহনের বেপরোয়া গতি, সড়কের নানান ধরনের ত্রæটি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া বিপজ্জনক ওভারটেকিং, সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, মাদকসেবন করে যানবাহন চালানো, লেভেল ক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা এবং রাস্তায় ফুটপাত না থাকা কিংবা ফুটপাত বেদখলের কারণেই দুর্ঘটনা কমছে না।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, বিভিন্ন প্রয়োজনে সরকার আইন পাস করে। কিন্তু আইন যদি কার্যকর করা না হয় তাহলে শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না। সড়ক-সহাসড়কের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে নতুন সড়ক আইনের বাস্তবায়ন হলে এখন সড়কে বিশৃঙ্খলা আমাদের দেখতে হতো না। মহাসড়কে থ্রি-হুইলারসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলে ময়মনসিংহে এক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হতো না। তাই যে আইন করা হয়েছে তা কার্যকর করাই সবচেয়ে বড় কাজ।

বিশেষজ্ঞরা জানান, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ না করা, হাইওয়ের সঙ্গে আলাদা পার্শ্বরাস্তা বা সার্ভিস রোড না থাকা, মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ না করা, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না করা এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন না করার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনার হার সব সময় বেশি থাকলেও গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনো নেই। জাতীয় স্বার্থেই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং গণপরিবহন খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। এই সব কিছুর জন্যই দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কিন্তু এই খাতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সব সময়েই গড়িমসি করতে দেখা যায়। হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা দাবি করেন, বিগত কয়েক বছরে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতার কারনে থ্রি-হইলারসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচল প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে। প্রায়ই এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে বা আঞ্চলিক সড়কে এসব যানবাহন চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সেসব সড়কেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও মহাসড়কে থ্রি-হুইলারসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচলের পেছনে হাইওয়ে পুলিশের গাফিলতি রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ মোটা অঙ্কের মাসোহারা ও প্রতিদিন নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের সুযোগ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম মহাসড়ক। এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ধীরগতির যানবাহন অবাধে চলাচল করছে। শিবালয় উপজেলার আরিচা ঘাট থেকে টেপড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এই মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে অবৈধভাবে প্রতিদিন শতাধিক থ্রি-হুইলার যানবাহন চলাচল করছে। এই মহাসড়কের তরাসহ আরো একাধিক পয়েন্টের সড়ক ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় যানবাহন চলাচল এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বরংগাইল হাইওয়ে পুলিশ মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায়। তবে যাদের আটক করা হয় তাদের কাছ থেকে আবার ক্ষেত্রবিশেষে ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে পরে ছেড়ে দেয়। এভাবেই ঢাকা-সিলেট, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে অবাধেই চলছে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা ও অটোটেম্পো। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ থেকে পাবনা, নাটোর, বগুড়া মহাসড়কেও অবাধে ধীরগতির স্থানীয় যানবাহন চলাচল করছে। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থার উন্নতি হলেও কুমিল্লা, ফেনীসহ কয়েকটি এলাকায় কেউ আইনের তোয়াক্কা করছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App