×

মুক্তচিন্তা

অন্ধকার থেকে আলোকিত দেশে ফেরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪০ পিএম

৮ জানুয়ারি ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তার আত্মিক যোগাযোগ ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়।... যখন বিপদ আমাকে আচ্ছন্ন করত, আমি বুঝতে পারতাম আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। যখন আমার মনের দিগন্তে দেখা দিত চকিত আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে। ... একে বলতে পারেন প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা; আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই। এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। রক্ত সেই অতীব জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে জীবনকে এবং এমনি রক্তদান যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা বাঁচিয়ে রাখবে।’ বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী খবর ছড়ানো হতো। বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ- ‘সেই সময়ে আমার সেলে যারাই এসেছিলেন তাদেরই দেখাত অনেক কম আস্থাবান ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেত না। বরং কোনো অজানা দুশ্চিন্তা যেন তাদের পীড়িত করত।... ... এটা আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল। তাদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে এমন কোনো বিবৃতি আমার কাছ থেকে আদায়ের জন্য উপর্যুপরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন মিলেছিল। আমি অনুভব করেছিলাম, তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত। এর ফলে আমার মধ্যে প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে তাদের দিন ভালো যাচ্ছে না। আমি তাদের কথা মান্য করতে অস্বীকার করি। আমি কোনো কিছু বলতে, লিখতে বা সই করতে অস্বীকার করি।...’ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও বন্দি অবস্থায় করাচি নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে গবেষক এসএ করিম উল্লেখ করেছেন- ‘করাচি পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেয়া হয়। তাকে একটি অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়, যেখান থেকে লোহার শিক দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না, পরবর্তী সময়ে একটি পুরনো বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো, যা মূলত ঘরের গরমকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই। এ ছাড়া আরো নানা রকমের অত্যাচার ছিল সেখানে। বঙ্গবন্ধু এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন বাংলাদেশের জন্য- যে বাংলাদেশটি তখন জন্ম নেয়ার জন্য লড়ছে।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে ঢাকার মাটি স্পর্শ করার পর উপস্থিত জনতার ঢল দেখে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জাতিকে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন, ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি জানান, ‘আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না।’ কিন্তু জানিয়েছেন, ‘আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ তিনি এই ঐতিহাসিক ভাষণে যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে মুক্ত মানুষের দিকে চেয়ে বলেন- ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি, বোধহয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।’ আমি আশা করি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন- আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি-আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়।... ভাষণে মুক্ত স্বদেশে মানুষের অধিকারের কথা তিনি শুনিয়ে দিলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন দালালদের বিচার করার কথা, তিনি সরকারি কর্মচারীদের সাবধান করে দিলেন, ঘুষ গ্রহণের বিরুদ্ধে বললেন, তিনি আমেরিকার জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানালেন এবং বারবার স্মরণ করলেন ১ কোটি উদ্বাস্তু মানুষকে ভারতের আশ্রয় দেয়ার কথা। রক্ত আর যন্ত্রণার সিঁড়ে বেয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে তা যে ষড়যন্ত্র মুক্ত নয়, তাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। অন্যদিকে নিজের আত্মপরিচয়, দেশপ্রেম আর নিজের বাঙালিত্বকে দেশবাসীর কাছে পুনরায় স্পষ্ট করলেন পাকিস্তানের কারাগারের স্মৃতিচারণ করার সময়Ñ ‘আমায় আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে, আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান একবার মরে ২ বার মরে না। আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে জনগণকে উদ্দেশ করে ১০ জানুয়ারি যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন তাতে পরিষ্কারভাবে দেশ পরিচালনার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু তিনি যে ষড়যন্ত্রের কথা সেদিন বলেছিলেন তাও সত্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয় এবং দেশের স্বাধীনতা অপহৃত হয়ে চলে যায় পাকিস্তানবাদী রাজনীতির কাছে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ও নির্ভীক নেতার আসনে থেকেও নির্মমতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি ইতিহাসে অমর এক দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বিজয়ী বীরের মতো ভালোবাসা নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর চলার পথ ছিল জনগণের আশীর্বাদে স্নিগ্ধ। কিন্তু তিনি তাঁর স্বপ্ন সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন ছেড়ে তিনিও ১৯৮১ সালের ১৭ মে ভারত থেকে দেশে ফিরে হাল ধরেন গণতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা অর্জন আর শেখ হাসিনার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বজুড়ে অভিনন্দিত রাষ্ট্র।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App