×

মুক্তচিন্তা

১০ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১০:০৮ পিএম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সেই মহান নেতা। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা বা স্বাধীনতার চেতনা বলতে যা বুঝায় তার কোনোকিছুই ছিল না। বাঙালি জাতিসত্তা কখনো স্পষ্ট রূপ নেয়নি। একমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই জনপদে ও বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ রাষ্ট্রের স্থপতি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) ভাষায় ‘মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারও বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করেই গঠন (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১) করা হয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকার মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে শঙ্কা দূরীভ‚ত হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা The Guardian-এ ১০ জানুয়ারি Recognize Bangladesh Now শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘Once Sheikh Mujibur Rahman steps out of Dacca Airport, the new republic becomes a solid fact’। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি Newsweek ম্যাগাজিনের ভাষায় ‘Poet of Politics’ মুজিবের অমর কাব্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার ওবায়েদ-উল হকের (১৯১১-২০০৭)  ভাষায়Ñ ‘যদি বাংলাদেশ একটি মানুষের দৈহিক আকৃতি পায়, তা হবে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো।’ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু তা ছিল অসম্পূর্ণ। ৮ জানুয়ারি খবর এলো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে খুব ভোরে লন্ডন পৌঁছেছেন। বিশেষ উড়োজাহাজটি হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ না করা পর্যন্ত ঢাকা অথবা নয়াদিল্লির কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর গন্তব্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কারণ বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত এর গন্তব্যের কোনো খবর ছিল না। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তান সরকারের চার্টার্ড করা বিশেষ বিমানে শেখ মুজিব পাকিস্তান সময় ভোর ৩টায় রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। রেডিওর ঘোষণায় আরো বলা হয়, শেখ মুজিবের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর গন্তব্য গোপন রাখা হচ্ছে। রেডিও পাকিস্তানের অতিরিক্ত তথ্য ছিল যে নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছেন। পরবর্তীতে স্যার ডেভিড ফ্রস্টকে (১৯৩৯-২০১৩) দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেন, যা ভুট্টো নিজে তাঁকে জানিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর নিকট আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা না করে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি।’ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে আরো জানান, ইয়াহিয়া তাকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে ব্যাকডেটে একটি আদেশ দেখিয়ে মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার অনুমতি দেয়া হোক।’ ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভুট্টো তার জবাবে কি বলেছিল, সে কথা কি আপনি জানেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভুট্টো বলেছিল, ‘আমি এটা করতে দিতে পারি না। কেননা তখন এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে ... তাহলে আর কোনোদিন বেঙ্গল থেকে একজনও পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে না।’ উল্লেখ্য, এ সময় ১ লাখ ২০ হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর হাতে আটক ছিল। তা ছাড়া কয়েক লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে বসবাস করত। ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে এক ঘণ্টাকাল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় তাঁর জীবন রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হিথকে ধন্যবাদ জানান। ৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করলেন, ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ভারতীয় ভিআইপি বিমানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হিথের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে তিনি জানালেন হিথ ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের জেটে করে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তাই ভারতীয় বিমান প্রেরণের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও তাদের বিমানযোগে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠানোর বন্দোবস্ত করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটাই ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি। ইন্দিরা-হিথ আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আসলে তারা উভয়েই চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সুস্থ শরীরে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়ে তুলুক। সাইপ্রাস-ওমান হয়ে দিল্লিতে বিমান অবতরণ করে। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত দিল্লির Express পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ীÑ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে কয়েক মিনিট অবস্থান করেন। এবার এলো সেই কাক্সিক্ষত মুহূর্ত। প্রায় কালো ধূসর ওভারকোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু বিমানের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। ... প্রেসিডেন্ট শ্রী ভরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি যখন বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছিল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকায় ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুই মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভারতে ফিরে যায়। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় বাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিদায়ী কুচকাওয়াজ হয়। এই কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর শেষ দলটির বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। এখন চলছে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেছিলেন তা ছিল মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। যে সংগ্রামে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালে আমরা ধনী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হব এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বর্তমান সরকার। এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ হবে; সাফল্য আসবে আমাদের মুক্তির সংগ্রামের। ১৯৭১-এ পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তি এখনো আমাদের মহান স্বাধীনতা নিয়ে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই আমাদের মুক্তির সংগ্রাম নিরন্তন চালিয়ে যেতে হবে। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App