×

মুক্তচিন্তা

স্বদেশের মাটিতে ফিরলেন বাঙালির মহানায়ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১০:০২ পিএম

প্রায় সাড়ে ৯ মাস বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন দুই দিন পর ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নিলেও স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বাঙালির চ‚ড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত হয়। তাই সেদিন জনতার আবেগের ঢলে ভাসছিল রাজধানী ঢাকা, সমগ্র বাংলাদেশ। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুও তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তিনিও কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আবেগের তীব্রতায়। লাখো জনতা আর বঙ্গবন্ধুর সম্মিলিত অশ্রুধারায় সেদিন আরো যেন উত্তাল হয়ে উঠেছিল বঙ্গোপসাগর। উত্তাল হয়ে উঠেছিল রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্র, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থলে তারই এক সফল পরিণতি যেন! শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও আবেগোজ্জ্বল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত ভাষণে জাতিকে দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। জাতির জনক তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু, মুসলমান সবার আত্মার মঙ্গল কামনার মাধ্যমে। অশ্রæ সজলকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম এই ভাষণেও তাঁর স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সাধনা ও লক্ষ্য অন্বেষণ করলে আমরা যেসব বিষয় স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি তার মধ্যে অসহায় ও নিরন্ন মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা-ভাষণের মতো ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেয়া ভাষণেও মানুষের সেই মৌলিক ও মানবিক বিষয়গুলোই উচ্চারিত হয়েছিল। তবে পার্থক্য ছিল আগেকার ভাষণসমূহে পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্য আর ১০ জানুয়ারির ভাষণে ছিল স্বাধীন মাতৃভ‚মির জন্য করণীয় নির্ধারণের নির্দেশনা। সেদিন তিনি গভীর প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বসবাস করবে। বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি, এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন।’ স্বপ্নের স্বাধীন এবং অবারিত আবেগের জন্মভ‚মিতে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু আপ্লুত হয়েছিলেন। তাই বরাবরের মতো স্মরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একাধিক কবিতার চরণ। তার ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি করেছিলেনÑ ‘নমো নমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।’ কবিতার এই অংশমাত্র আবৃত্তি করে তিনি ‘দুই বিঘা জমি’র উপেন চরিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত বাঙালির শতবর্ষের শোষণ-বঞ্চনাকে মূর্ত করে তুলেছিলেন! মূর্ত করে তুলেছিলেন তাঁর ওপর পাকিস্তানের কারাগারে নির্যাতনের চিত্রও। অতঃপর বলেছিলেন, ‘আজ আমি এখানে নামছি, আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির কাছে ছিল বিরাট এক স্বস্তির বিষয়। বঙ্গবন্ধুও মাতৃভূমিতে তাঁর প্রিয় বাঙালির কাছে ফিরে এসে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর এ যেন আরেক বিজয় ছিল বাঙালির, অনন্ত আবেগের বিজয়। বন্দি জীবনের অবসান ঘটার পর স্বাধীন স্বদেশে ফিরে প্রথম ভাষণে তিনি একাধিকবার ফিরে গেছেন রবীন্দ্রচৈতন্যের আবহে, রবীন্দ্রভাবনার আশ্রয়ে। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।’ স্বাধীনতা লাভের পর জাতিকে পুনর্গঠন ছিল বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য। তাই ১০ জানুয়ারির ভাষণের আরেক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়।’ অর্থাৎ সবদিক দিয়ে স্বাধীনতাকে সফল করে তোলার ভাবনা থেকে, বাঙালির সার্বিক মুক্তির ভাবনা থেকে বঙ্গবন্ধু বিচ্যুত হননি কখনো। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির দোসররা এবং পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসীরা বঙ্গবন্ধুকে পরিকল্পিত পন্থায় এগিয়ে যেতে দেয়নি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বিপথগামীরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ক্রমাগত রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা সেনা ও ছদ্মসেনা শাসকদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি পাকিস্তানপন্থিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে আত্তীকরণেরও প্রচেষ্টা। ফলে নানা রকমের ষড়যন্ত্র ও কৌশলের কাছে অনেকেরই মনোজগৎ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিকে হতে থাকে। ক্রমে বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে বিরাজিত বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস যেমন মøান করে দেয়া হয় তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কার-সংস্কৃতি থেকেও বিমুখ করে দেয়ার সূ² কৌশল গ্রহণ করা হয়। এই সূক্ষ কৌশলের অন্যতম ছিল ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে বাঙালির সার্বিক মননের জগতে ভাঙন সৃষ্টি করা। স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয় যেমন রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি এবং বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিমকে ‘আনুষ্ঠানিক’ ঘোষণা করা ইত্যাদি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত এ রকম নানা বিষয়ে ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রয়াস চলতে থাকে। লক্ষ করলে পরিষ্কার হবে যে, এখনো বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশে রবিবারই সাপ্তাহিক ছুটি চালু আছে। আর সেসব দেশেও বিসমিল্লাহ বলার আনুষ্ঠানিকতা নেই। আমরা জন্মের পর থেকেই যে কোনো কাজ শুরুর পূর্বে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বলে থাকি। এটি শৈশব থেকেই আমাদের দেশের সব মুসলিমের পারিবারিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার অন্তর্গত। কিন্তু তা নিয়েও ষড়যন্ত্রকারীরা ‘পলিটিক্স’ করেছে! যা হোক, এসব আচারগত বিষয় সাড়ম্বরে প্রচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে ‘রুশ-ভারতের দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাঙালির হৃদয়-জয় করা অবিসংবাদিত নেতাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে প্রতিপন্নের অপপ্রয়াসও কম হয়নি। সরলমনা বাঙালিকে বরাবরই বোঝানোর প্রয়াস দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সব মসজিদই মন্দির হয়ে যাবে এবং সেখানে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে! কিছুদিন আগে পর্যন্তও বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে! বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা বাংলাদেশকে ভারতের কোনো অংশ হতে দেখিনি! উপরন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যায় ভারতের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়েও বাংলাদেশ সক্ষমতা দেখিয়েছে। আর বিগত এক যুগের শাসনামলে শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশে ৮ হাজারের বেশি মসজিদ স্থাপিত হয়েছে! কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয় উসকে দিয়ে রাজনীতির অপকৌশল আজো শেষ হয়নি। সাম্প্রতিককালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়েও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। একদা রাজনৈতিক এরূপ ষড়যন্ত্রে আমরা ভুলেই যেতে বসেছিলাম আমাদেরই জাতি পিতাকে। নানা কৌশলে ভুলিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় মেতে উঠেছিল সমকালীন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকরা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন বঙ্গবন্ধুকে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিনতে না পারে তাই বর্তমানে ভাস্কর্যবিরোধিতার ষড়যন্ত্রও প্রবল হয়ে উঠেছে! সব ষড়যন্ত্র ছাপিয়ে প্রমাণ হয়েছে কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের অসহায় ও নিরন্ন মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের বারতা নিয়েই জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের অসহায় ও নিরন্ন মানুষের মুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব মানবতারও ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্ব বাঙালিকে পরাধীনতার গøানি থেকে মুক্ত করেছে। অসহায় ও নিরন্ন মানুষের ভাত ও কাপড়ের মৌলিক দাবি পূরণের লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো কেউ নিজেকে উৎসর্গ করেননি। চারদিক থেকে জাতির জনককে ভুলিয়ে দেয়ার শত অপচেষ্টা থাকলেও দিন দিন বঙ্গবন্ধু আরো ভাস্বর হয়ে উঠছেন। বিশ্বমানবের মহান নেতার আসনে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন।স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বিশ্বব্যাপ্ত অসহায় মানুষের পরিত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের আদর্শ নায়ক। বাঙালির চিত্তপটে আবহমানকাল পাথরের ভাস্কর্যের চেয়েও গভীরভাবে খোদাই করা থাকবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নায়ক বঙ্গবন্ধুর নাম। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App