×

জাতীয়

গণপরিবহনে অনিরাপদ নারী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:২৩ এএম

হয়রানির শিকার ৯৪ শতাংশ। প্রতিবাদ হয় না ৮১ শতাংশের। বিচার পান শূন্য দশমিক চার শতাংশ। প্রয়োজন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনায় গণপরিবহনে নারীর অনিরাপদ চলার বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে। নিজেকে বাঁচাতে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। ক্ষোভ-আন্দোলনে সরব সুনামগঞ্জের রাজপথ। ইতোমধ্যে ওই বাসের চালক শহীদ মিয়াকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। নিপীড়ক-নির্যাতক-ধর্ষকদের দ্রুত বিচার আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছেন নারীনেত্রী, মানবাধিকার কর্মী ও গবেষকরা। সেইসঙ্গে পরিবার থেকেই ছেলে শিশুদের মগজে-মননে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার পরামর্শ তাদের।

গণপরিবহন ব্যবহারকারী নারীদের ওপর পরিচালিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ গবেষণা অনুযায়ী, গণপরিবহনে হয়রানির শিকার ৯৪ শতাংশ নারী। এরমধ্যে বিচার পাবেন না জেনে কোনো প্রতিবাদ করেন না ৮১ শতাংশ। আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান ৭৯ শতাংশ। অ্যাকশন এইডের জরিপ অনুযায়ী, বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী, গত বছর গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫৯ নারী। ধর্ষণ, যৌন হয়রানির কারণে অনিরাপদ দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা। কখন, কার ওপর পৈশাচিক হামলা হবে- এমন আতঙ্ক নিয়েই গণপরিবহন ব্যবহার করছেন নারী যাত্রীরা।

জানতে চাইলে নারী ও আদিবাসীবিষয়ক গবেষক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নারী হলেই সবকিছু নারীবান্ধব হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো বিশ্বেই। যাত্রাপথে নারীদের যে পরিমাণ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়টি কখনোই অনুধাবন করতে পারবেন না। পরিবহন মালিকরাও নারীর সুবিধার প্রতি সেন্সেটিভ নয়। দুর্ভাগ্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এবং নারী সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। ফলে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন সবাই কথা বলেন; কিন্তু কিছুদিন পরই আলোচনা সমালোচনা থেমে যায় এবং অপরাধীরা অপরাধে তৎপর হয়ে ওঠে। আইন হয় কিন্তু আইনের প্রয়োগ খুবই কম। অন্যদিকে আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং অপরাধ করতে সাহস পায়।

গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা বিশ^বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ড। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির ২৩ বছর বয়সি এক প্যারা মেডিকেল ছাত্রীকে নির্মমভাবে গণধর্ষণ করে রাজপথে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ৬ ধর্ষক। এরপরই বিশ্বজুড়ে ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দাবি ওঠে। বাংলাদেশেও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে দলবেঁধে ধর্ষণ শেষে হত্যার পর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে ফেলে যায় জাকিয়া সুলতানা রূপার মরদেহ। চাঞ্চল্যকার মামলায় বাসের চালক এবং সহকারীসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।

এছাড়া গতবছর সারাদেশে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের ফাঁকফোকরে খালাস পেয়ে অপরাধীরা আরো সাহসী হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে নারীনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর ভোরের কাগজকে বলেন, ধর্ষণের মামলায় বিচার হয় মাত্র ৩ শতাংশ, এরমধ্যে নির্যাতনের শিকারের পক্ষে রায় হয় শূণ্য দশমিক চার ভাগ। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষ্য দিতে চান না অনেকেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন ভোরের কাগজকে বলেন, ঘরে-বাইরে অনিরাপদ নারী। গণপরিবহনগুলো নারীবান্ধব নয়। গণপরিবহনে ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের হয়রানি করার অপেক্ষায় থাকে যৌন নিপীড়করা। নানা ধরনের বাজে নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। বাসে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত হেনস্তার শেষ নেই। বাসে ওঠার সময় গায়ে হাত দেয়, ভাড়াও চাইবে গায়ে হাত দিয়ে। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের গণপরিবহন ছাড়া উপায় নেই। তিনি বলেন, অনেকে মনে করে, বাসে বরাদ্দকৃত নয়টি সিটের বাইরে নারীরা বসতে পারবেন না। আর ওই নয়টি সিট খালি না থাকলে বলে, ‘মহিলা সিট নাই’। কিন্তু একজন কর্মজীবী নারীকে তার কর্মক্ষেত্র পৌঁছাতে হবে, ঘরে পৌঁছাতে হবে। ‘মহিলা সিট নাই’ এই শব্দটি বলা যাবে না- এ নিয়ে রুল হওয়া উচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের উন্নত দেশেগুলোর সড়ক মহাসড়কগুলো সিসিটিভির আওতায়। এ পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, কোনো দুর্ঘটনা বা গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া যায়। বাংলাদেশেও গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো সিসিটিভির আওতায় আনার নির্দেশ উচ্চ আদালতের। সেইসঙ্গে নারীবান্ধব ট্রান্সপোর্ট পলিসি, কমিউনিটি বাস সার্ভিসের পরামর্শ তাদের।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেউদ্দিন হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু গণপরিবহনেই নয়, রাস্তাঘাটে হাঁটাচলাও নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। তবে গণপরিবহনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন নয়। নারীর জন্য আলাদা বাস সার্ভিস খুব বেশি কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া দু-একটি বাস দিয়ে ব্যাপক সংখ্যক নারীর যাতায়াত অসম্ভব। এছাড়া ওই বাসের সময় অনুযায়ী সবার চলাচলও অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে বাসে উঠানামার সময় নারীরা প্রায়ই হেনস্তার শিকার হন। বাসের ভেতরেও নিরাপত্তাহীনতা কঠিন সত্য। আমরা ট্রান্সপোর্ট পলিসির পরিবর্তন না করে, নারীবান্ধব ট্রান্সপোর্ট পলিসির কথা না ভেবে যান্ত্রিকভাবে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। আমাদের মানসিকতায়ও সমস্যা রয়েছে। নারীর নিরাপত্তায় কমিউনিটি বাস সার্ভিস যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হলে ঘরে-বাইরে নিরাপদ থাকবে নারী- এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধবিষয়ক গবেষক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, নারীকে আমরা অবস্থার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করি। উচ্চবিত্ত নারীকে যেভাবে দেখি নিম্নবিত্ত নারীকে সেভাবে সম্মান করি না। এটি বৈশি^ক সমস্যা। গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া খুব মুশকিল হয়। ফলে আইনের দ্বারস্থ হওয়া কঠিন হয়ে পরে। অন্যদিকে সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্তে¡ও সামাজিক অপরাধের বিচার খুব কম হয়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আপস করে নেয়ায় পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য বাড়তেই থাকে। ফলে যৌন আগ্রাসন বাড়ছে। গণপরিবহনের সিসিটিভি, নারীর জন্য পৃথক বাস খুব একটা কার্যকর ভ‚মিকা পালন করবে বলে আমার মনে হয় না। প্রয়োজন মনোজগতের পরিবর্তন। প্রয়োজন দ্রুত বিচার আদালতে শাস্তি নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাপরিচালক মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সাক্ষ্যের অভাবে মামলা হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। দিন দিন এই অপরাধ বাড়ছে। এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি ও অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App