×

মুক্তচিন্তা

বিশ্বের মানুষ নিশ্চয়ই মরতে রাজি হবে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:৩৬ পিএম

ট্রাম্প বলতেন আমেরিকা ফার্স্ট, বাইডেন বলছেন আমেরিকা ইজ ব্যাক। দুজনেই আমেরিকার পক্ষে, আর তাদের আমেরিকা পুঁজিবাদীই, অন্যকিছু নয়। লাউ এবং কদু একই বস্তু, নামেরই যা ব্যবধান। পুঁজিবাদও পুঁজিবাদই, অন্যকিছু নয়। করোনা ভাইরাসের দূত পাঠিয়ে পুঁজিবাদ জানিয়ে দিয়েছে যে সারা বিশ্বের মানুষের ওপরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি হয়ে গেছে; বিশ্ববাসী পারলে এখন বাঁচবে, নয় তো মরবে। বিশ্বের মানুষ নিশ্চয়ই মরতে রাজি হবে না।

দেশে সংস্কারের চেষ্টা তো কম হয়নি। কিন্তু সব চেষ্টাই ছিল বিদ্যমান পুঁজিবাদী সম্পর্ককে রক্ষা করে সামনের দিকে এগুবার। সেই এগুনোর পরিণতিতেই তো বিশ্ব এখন এসে পৌঁছেছে বর্তমান নারকীয় দশাতে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, এসেছে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা, ছাড় দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের, যত্ন নেয়ার আয়োজন চলেছে বয়স্ক ও শিশুদের, একের পর এক আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়েছে; তারপরে শোনা গেল অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ইত্যাদি গণতন্ত্রের কথা। উন্নতিকে মানবিকীকরণের ধ্বনি, উন্নতিকে টেকসই করার পরামর্শ- এসবও পাওয়া গেল। কাঠামোগত সংগতিসাধন, বাণিজ্য উদারীকরণ, উন্নতির পিরামিডটাকে উল্টে দেয়া- এসব প্রতিশ্রুতি এলো, আসতে থাকল। সমবায়ের মাধ্যমেও কল্যাণ সাধনের চেষ্টা হয়েছে। নারী অধিকারের আন্দোলন দেখা দিল। কিন্তু কিছুতেই মানুষের মুক্তি এলো না। কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি অব্যাহত রইল, বিচ্ছিন্নতা দূর হলো না, মুনাফাই হয়ে রইল উৎপাদনের চালিকাশক্তি। চলল শোষণ। শ্রম আটকে রইল পুঁজির শাসনে। মানুষের মধ্যে যে অপার সৃষ্টিশীলতা রয়েছে মুখ থুবড়ে তা পড়ে থাকল উৎপাদন ও বণ্টনের পুরনো সম্পর্কের জাঁতাকলের ভেতরে। এবং শেষ পর্যন্ত করোনা এসে উপরের আচ্ছাদনটা দিল সরিয়ে এবং জানিয়ে দিয়ে গেল যে সংস্কারের সব চেষ্টাই মূল যে সম্পর্ক তাতে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে; বলে দিল যে উন্নতি মানুষের অর্জন ও সভ্যতাকে টেনে নিয়ে চলছে ধ্বংসের অভিমুখেই।

পুঁজিবাদ তো কেবল অর্থনীতির ব্যাপার নয়; ওপরের আচ্ছাদন তো সে নয়ই; পুঁজিবাদ একটা আদর্শেরও নাম। আদর্শটা হলো মুনাফার। বাকিটা আড়ম্বর ও আচ্ছাদন। পুঁজিবাদী উন্নতির ভেতরে কোন ধরনের সম্পর্ক যে বিদ্যমান ও সক্রিয় সেটা এখন দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে।

সংস্কারব্রতী উদ্যোগ চলেছে এবং চলবে। সেগুলো প্রশংসাও পেয়েছে। যেমন বয়স্কাউট আন্দোলন। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বব্যাপী তার প্রসার ঘটেছে। লাখ লাখ কিশোর ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল যে, যে দেশটিতে বয়স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা ও সর্বাধিক তৎপরতা সেই আমেরিকাতেই কমপক্ষে এক লাখ কিশোর অভিযোগ করেছে যে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। করেছে তাদের প্রশিক্ষকরাই। প্রশিক্ষকরা আবার নেতাও। ঘটনাস্থল স্কাউট ক্যাম্প, যেখানে কিশোরদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সমাজসেবা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষিত করতে। তাদের সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে যৌথ জীবনযাপনের। আর তার মধ্যেই এসব ঘটনা। বয়স্কাউটের কিশোর বাহিনী মানুষের কল্যাণ করবে কি, নিজেরাই অকল্যাণের শিকার হয়ে বসে আছে। সবাই জানে ক্যাথলিক চার্চে ছেলেরা যায় ধর্মযাজক হবে বলে, যাজক হয়ে মানুষের উপকার করবে এমনই বাসনা; সেই চার্চের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে কিশোরদের ওপর যৌন নির্যাতনের। বাইরের লোকরা নয়, অভিযোগ ভেতরের লোকরাই ওই দুষ্কর্ম করে থাকে।

পাকিস্তানের অতিশয় ঘৃণিত স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশ দখল করেই একটি-দুটি নয়, ২৭টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। সে আমলে বিবাহ ও পারিবারিক উত্তরাধিকার বিষয়ে যে সংস্কার করা হয়েছে তা ইসলামব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামী ও কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন বাদ দিলে সব মহল থেকেই এবং বিশেষ করে নারীদের পক্ষ থেকে অভিনন্দিত হয়েছে। কিন্তু কই আইয়ুব খানের সংস্কারগুলোতে সমাজকাঠামোতে তো কোনো পরিবর্তন এলো না। অথবা ধরা যাক আমাদের দেশের ঋণসালিশি বোর্ড ও প্রজাস্বত্ব আইন জারির কথা। এতে কৃষকরা যে কিছুটা সুবিধা পেয়েছে তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। এজন্য আমরা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বিস্তর প্রশংসাও করেছি। সে প্রশংসা তার প্রাপ্যও। কিন্তু ওই সংস্কারে কৃষকদের যে মূল দাবিটা ছিল, জমিদারি ব্যবস্থা ও মহাজনী প্রথার উচ্ছেদ, সেটা তো অর্জিত হলো না। তখনকার কৃষক-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির জিতেন ঘোষ, তিনি লিখেছেন, ‘এরকম আইন পাস হওয়ার ফলে শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক-জনতার সংঘবদ্ধ বোয়াগ্নি জ্বলার মুখেই নিভে গেল; যদিও কৃষকরা এ আইনে কিছুটা সুবিধা পেল।’ (জেল থেকে জেলে, স্টুডেন্টস পাবিলেকশন্স, ঢাকা, ১৯৬৯, পৃ-২৩১) অল্পস্বল্প ছাড় দিলে, স্টিম ছাড়ার ব্যবস্থা করা গেলে, বিপ্লব ঠেকানোর ব্যাপারে সুবিধা হয়। এবং সেভাবে ঠেকানো হয়েছে বৈকি। সংস্কার অগ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু সংস্কার তো মৌলিক পরিবর্তনের বিকল্প নয়; বরং শেষ বিচারে অন্তরায়ই।

মোট কথা, সংস্কারে কুলাবে না। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল উপাদানগুলো ছিল সেগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মৌলিক পরিবর্তনের আবশ্যকতার ব্যাপারটা আড়াল করে সংস্কারের চেষ্টায় কোনো ফল হবে না। ভাঙা গাড়িটিকে মেরামত করে সচল রাখার চেষ্টা অপচয় বৈ নয়। ক্রান্তিকাল বলে একটা সময়ের কথা শোনা যায়; ইতিহাসের ধারাপ্রবাহে নানা ক্ষেত্রে ক্রান্তিকাল আসে। আসে শিল্পে, সাহিত্যে, দার্শনিক চিন্তায়, উৎপাদনে ও বিতরণ পদ্ধতির বেলাতে। এসে যায়। পুরনো বিদায় নেয়, নতুনের অভ্যুদয় ঘটে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজ তেমনি একটি ক্রান্তিকাল উপস্থিত। আজ প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে নতুন একটি সভ্যতা কি জন্ম নেবে, নাকি পুরনো সভ্যতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতেই থাকবে। কোন পথে এগুবে মানবসভ্যতা; সৃষ্টির নাকি ধ্বংসের? সৃষ্টির পথে এগুতে হলে পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে; ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে সামাজিক মালিকানার। হয় এটা, না হয় অপরটা, মাঝখানে কিছু নেই। সমঝোতা কালক্ষেপণের চেষ্টা হবে মাত্র। সৃষ্টির পথে না এগুলো ধ্বংসের তৎপরতা আরো নিষ্ঠুর ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে।

উদারনীতিকে এক সময়ে প্রগতিশীল মনে করা হতো। সে কাল এখন আর নেই। রাজনীতিতে মেরুকরণ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতর থেকেই কাজ করবেন ভেবেছিলেন; চেষ্টাও করলেন; কিছুটা সফলতাও পেলেন, কিন্তু তা সামান্যই। আগামীতে তাকে এবং তার মতো ঘোষিত সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে নিজেদের পার্টি গঠন ছাড়া এগোবার উপায় থাকবে না। গ্রেট ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন টনি ব্লেয়াররা ওই পার্টিকে রক্ষণশীলতার যে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে। পারেননি। উল্টো তিনি নিজেই অপসারিত হয়ে গেছেন। থাইল্যান্ডে যে তরুণরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে সংগ্রাম করছে তারাও নিশ্চয়ই বুঝবে যে বুর্জোয়া কিসিমের নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়তো ঘটবে, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় সবার জন্য যে সমান অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, তা কখনই অর্জন করা সম্ভব হবে না। সেটা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে নতুন এক সভ্যতার জন্মকে সম্ভবপর করে তুলবে। আর নির্বাচন? হ্যাঁ, হবে, কিন্তু ক্ষমতা সেখানেই রয়ে যাবে যেখানে ছিলÑ শ্রেণিগতভাবেই শুধু নয়, একেবারে দলীয়ভাবেই, এমন ঘটনা তো হরদমই ঘটছে। নির্বাচিত জো বাইডেন পরাজিত ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত সরাতে পারবেন, হোয়াইট হাউস তার দখলে আসবে, কিন্তু তিনিও তো সেই জাতীয়তাবাদীই। ট্রাম্প বলতেন আমেরিকা ফার্স্ট, বাইডেন বলছেন আমেরিকা ইজ ব্যাক। দুজনেই আমেরিকার পক্ষে, আর তাদের আমেরিকা পুঁজিবাদীই, অন্যকিছু নয়। লাউ এবং কদু একই বস্তু, নামেরই যা ব্যবধান। পুঁজিবাদও পুঁজিবাদই, অন্যকিছু নয়। করোনা ভাইরাসের দূত পাঠিয়ে পুঁজিবাদ জানিয়ে দিয়েছে যে সারা বিশ্বের মানুষের ওপরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি হয়ে গেছে; বিশ্ববাসী পারলে এখন বাঁচবে, নয় তো মরবে। বিশ্বের মানুষ নিশ্চয়ই মরতে রাজি হবে না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App