×

জাতীয়

নতুন কৌশলে বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৪ এএম

নতুন কৌশলে বিএনপি
নতুন কৌশলে বিএনপি
বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু করেছে বিএনপি। তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে নতুন এই কৌশল। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একটি জাতীয় ‘ঐক্যের প্লাটফর্ম’ তৈরি করবে দলটি। জোটসঙ্গী জামায়াতকে বাদ রেখে জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আস্থায় আনার জোর তৎপরতা থাকবে। এবং বর্তমান প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী দিনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার রুপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে নানা ধারনের চাপ মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে। এ কারণে সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এই মুহূর্তে বৈশ্বিক রাজনৈতিক কৌশলও রপ্ত করা জরুরি। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নেতৃত্ব সংকট কাটিয়ে উঠতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তির উপায় নিয়েও ভাবা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রকে ভিত্তি ধরেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনামাফিক কর্মসূচির রোডম্যাপ তৈরি করছে বিএনপি। জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার সংগ্রামে সবাইকে নতুনভাবে ব্রতী হতে হবে। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পেতে ভিন্ন দল ও মতের সবাইকে নিয়ে ঐক্যের প্ল্যাটফরম গঠন এই মূহর্তে জরুরি হয়ে গেছে। তৈরি হচ্ছে ঐক্যের প্লাটফর্ম : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পরে এই জোটে আরোও কয়েকটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল বিএনপির। কিন্তু ফ্রন্ট নিয়ে ২০ দলীয় জোটের তোপের মুখে এই পরিকল্পনা আর সফল হয়নি। এবার সেই কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ভিন্ন কৌশলে একটি জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম তৈরিতে কাজ করছে বিএনপি। বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিরোধীদের অভিন্ন দাবিগুলো সমন্বয় করে এই প্লাটফর্মের ভিত্তি মজবুদ করা হচ্ছে। ‘জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য’ এ শিরোনামে প্লাটফর্মের কাজ এগিয়ে চলছে। দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে সিনিয়র নেতারা সমন্বয় করে খসড়া প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিরোধী মতের দলগুলোও তাদের আলাদা প্রস্তাব দেবেন। বিরোধী দলগুলো থেকে আসা প্রস্তাবগুলো থেকে বাছাই করে মূল প্রস্তাব তৈরি করে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। ঐক্যের প্রস্তাবনায় যা থাকছে : কমপক্ষে ১০টি বিষয়কে সামনে রেখে ঐক্যের প্রস্তাবনা তৈরি করছে বিএনপি। প্রস্তাবনার খসড়ায় রয়েছে- সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শাস্তি প্রত্যাহার এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা প্রত্যাহার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তার বিধান, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল করা। এ ছাড়াও জনসম্পৃক্ত প্রতিটি সেক্টর ধরে পয়েন্ট আকারে আলাদা প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। ২১ বছরের গাঁটছড়া, কে-কাকে ছাড়বে : ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠন হওয়ার মধ্য দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্যতা তৈরি হয়। সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামীকে যুক্ত করা হয়েছিল দুইজন ব্যক্তির তৎপরতায়। তারা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ এবং সাংবাদিক-রাজনীতিক আনোয়ার জাহিদ। এই দুজনের অসামান্য তৎপরতায় খালেদা জিয়ার কাছে জামায়াতকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়। সূত্রের দাবি, ১৯৯৯ সালে জোট গঠনের আগে প্রায়ই খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার যাতায়াত ছিল। কাজী জাফর ওই নেতাদেরকে তার আত্মীয় বলে খালেদা জিয়ার বাসায় নিয়ে যেতেন। একই সময়ে আনোয়ার জাহিদের প্রচেষ্টাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৯ সালে খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে এসে প্রথমেই বলেন, ‘আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে কথা দিতে হবে, আপনারা এই সিদ্ধান্ত মানবেন। ওই কমিটিতে জামায়াতকে জোটে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেদিন ওই বৈঠকে সদস্য হিসেবে উপস্থিত থেকে সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাজেদুল ইসলাম, শওকত আলীসহ কয়েকজন এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। কিন্তু ওই সময় তিনজন প্রভাবশালী ডানপন্থী নেতা আবদুস সালাম তালুকদার, আব্দুল মতিন চৌধুরী ও মোস্তাফিজুর রহমানের কারণে জামায়াতের সমর্থন না নেয়ার বিষয়টি বোঝাতে খালেদা জিয়াকে বোঝাতে ব্যর্থ হন তারা। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের দল। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করার মধ্য দিয়ে এই জায়গাটি নষ্ট করা হয়েছে। অনেকটা না বুঝেই অতিমাত্রায় ইসলামি ভাবাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে দলটি প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। জামায়াতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। নতুন করে যাতে ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেজন্য সম্প্রতি দেশে ভাস্কর্যবিরোধিতায় হেফাজত সরব হলেও বিএনপি ছিল চুপ। সম্প্রপ্রতি মারা যাওয়া হেফাজতের মহাসচিব নূর হোসাইন কাশেমীর বায়তুল মোকাররমে জানাজা হলেও বিএনপির নেতাদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। তবে দৃশ্যত এখনো বিএনপি ও জামায়াত দুপক্ষ সখ্যতার সম্পর্কের ইতি টানতে না চাইলেও ভেতরে- ভেতরে ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। বিএনপিতে জামায়াতকে রাখা না রাখার ব্যাপারে যতবারই আলোচনা উঠেছে সব সময়ই জামায়াতকে ধরে রাখার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা নিজেরা কেন ছাড়ব। তারা ছাড়ুক। তাছাড়া জামায়াতকে ছাড়লে সরকার তাদের লুফে নেবে। তাছাড়া ভোটের হিসাবে জামায়াতকে সঙ্গে রাখার তাৎপর্য আছে। জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জোট তো গোপনে ভেঙে দেয়ার কিছু নেই। জোট ছাড়লে আমরা প্রকাশ্যেই জানাব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নতুন বার্তা : শুধু ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধতাই নয়, বেশকিছু কারনে কয়েক বছর ধরেই বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিএনপির টানাপোড়েন চলছে। এমন অবস্থায় দলটির বিদেশনীতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে ‘ভারসাম্য’র নীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। শিগগিরই উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীনে পাঠানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। জানা গেছে, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যসহ শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে চীন বিএনপিকে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। বিএনপির ক‚টনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতাকে নিয়ে আপত্তি রয়েছে দেশটির। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কূটনৈতিক উয়িং ভেঙে নতুন করে সাজানো হবে বলে দলটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে দেশটিকে। জানতে চাইলে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের অন্যতম সদস্য ও দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, এ মুহূর্তে আমরা দুটি বিষয় সামনে রেখে এগোচ্ছি। দল গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জোর দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র দেশগুলোর চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে পররাষ্ট্রনীতি সাজানো হচ্ছে।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App