×

মুক্তচিন্তা

বিজেপি শেষ হাসি হাসতে পারবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২১, ০১:৩৮ পিএম

পশ্চিমবাংলায় বিজেপির শক্তি বেড়েছে। ২০১৪ সালে ভারতজুড়ে মোদি ঝড় উঠলেও পশ্চিমবাংলায় বিজেপির ভোট ছিল ১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৪০ শতাংশ অতিক্রম করে। লোকসভায় ২টি আসন থেকে এক লাফে ১৮ আসনে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি অবস্থা আরো সংহত করেছে বলে মনে হয়। সব দলের জনপ্রিয়তা কমেছে, বেড়েছে শুধু বিজেপির। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান এখন আর তুঙ্গে নেই।

রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবাংলার রাজনীতি জমে উঠেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলই আবার গদিতে ফিরবে না-কি বিজেপির হাতে যাবে ক্ষমতা, তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা-বিতর্ক। মমতা ক্ষমতা ধরে রাখতে চান আর বিজেপি চায় ক্ষমতায় যেতে। বিজেপির নির্বাচনী রাজনীতির ঘোড়েল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। পশ্চিমবাংলায় দল বদলের হিড়িক পড়েছে। বিজেপির বাজার মূল্য এখন অনেক চড়া।

ভারতে নির্বাচন কৌশল বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত প্রশান্ত কিশোরকে ভোটকৌশল নির্ধারণ করার জন্য হায়ার করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রশান্ত কুমারকে নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে খোদ মমতার দল ক্ষমতাসীন তৃণমূলেই। পশ্চিমবাংলার নিজস্ব রাজনৈতিক মানসিকতা না বুঝেই জয়ের কৌশল বাতলে প্রশান্ত কার্যত ভুল পথে হাঁটছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের বিষয়ে আমি কথা বলেছি সেখানকার একজন সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, ভোটের ফল সম্পর্কে এখনই কোনো নিশ্চিত পূর্বাভাস দেয়া যাবে না। এবার একক কোনো উপাদান ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন মাটি কামড়ে থাকতে চাইছেন, তেমনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিও চাইছে নবান্নের দখল। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজ্য রাজনীতিতে উত্তেজনার পারদও ততই ওপরে উঠছে। সিপিএমসহ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসসহ আরো কয়েকটি দল ভোটযুদ্ধে থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে, লড়াই সীমাবদ্ধ থাকবে মূলত রাজ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন তৃণমূল ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। ইতোমধ্যে দুদলই বিভিন্ন কায়দায় ভোটারদের কাছে তাদের ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদিনই এই দুই দল মিছিল-পাল্টা মিছিল, রোডশো, পাল্টা রোডশো, সভা-সমাবেশ চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব কর্মসূচি পালনকালে দুই দলের মধ্যেই কটুভাষায় বাগযুদ্ধ চলছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই এই দুই দল আরো বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারবারিরা মাঠে নেমে পড়েছেন।

রাজনৈতিক চাণক্য বলে খ্যাতি অর্জনকারী বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইতোমধ্যে দুদফা পশ্চিমবাংলা সফর করে বাকুড়া, মেদিনীপুর ও বোলপুরে কয়েকটি জনসভা ও রোডশোতে অংশ নিয়েছেন। তিনি তার বক্তৃতায় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি দুশরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে তৃণমূলের ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর শর্মা বলেছেন, বিজেপি এবারের নির্বাচনে দুই ডিজিটও পেরোতে পারবে না, অর্থাৎ প্রশান্ত বলেছেন, ৯৯টির বেশি আসন পাবে না বিজেপি। এবারো তৃণমূল জয়ী হবে।

অমিত শক্তিধর বিজেপিকে হারিয়ে তৃণমূলকে জয়ের হ্যাটট্রিক এনে দেয়াই এবার চ্যালেঞ্জ প্রশান্ত কিশোরের।

২০২১ সালে নির্বাচনে তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব নিয়ে এসে প্রশান্ত কিশোর বিধানসভা ভোটে শাসক দলের গত দুই টার্মের বিভিন্ন অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণ খতিয়ে দেখেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বেশ ভালো ফল করে তৃণমূলের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। পশ্চিমবাংলায় লোকসভার ৪২ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৮টি আসন, তৃণমূল জিতেছে ২০টি এবং ২টি পেয়েছে জাতীয় কংগ্রেস। এ ছাড়া তৃণমূলের জেতা আসনের অনেকগুলোতে আবার বিজেপির প্রার্থীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধান অনেক কম ছিল। বিজেপির এই ভালো ফলের কারণে তৃণমূল বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে কঠিন ভাবনায় পড়েছে। মানুষের মনের ক্ষোভ দূর করার জন্য এ পর্যন্ত একের পর এক নানান পদক্ষেপ আর কর্মসূচি নিয়ে ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশান্ত কিশোর বুঝেছেন, নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে জেতাতে গেলে ‘পজেটিভ’ ভোটকে হাতিয়ার করতে হবে। ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়, উন্নয়নকে সামনে রেখে মানুষকে কাছে টানতে হবে। প্রশান্ত কিশোর এ জন্য একের পর এক নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে চলছেন। নতুন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দিদিকে বলো (মুখামন্ত্রীর কাছে ভুক্তভোগীদের সরাসরি অভাব-অভিযোগ জানানো), খাদ্যসাথী (বিনামূল্যে রেশনের খাদ্য সরবরাহ), স্বাস্থ্যসাথী (বাংলার প্রতিটি পরিবারকে বছরে পাঁচ লাখ টাকার সুবিধা প্রদান), দুয়ারে সরকার (তৃণমূলের কর্মীরা সরকারের নেয়া সব কর্মসূচির জন্য সঠিকভাবে ফরম ফিলাপসহ যাবতীয় সহায়তা করা)। এ রকম আরো অনেক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে তৃণমূল। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আছে পৌনে দশ বছর। এর মধ্যে এসব কর্মসূচি ঢালাওভাবে করা হয়নি, আর করলেও দলীয় লোকজনকে সুবিধা দেয়া হয়েছে বেশি, বিরোধী দলের সমর্থকরা তেমন কিছুই পায়নি। জনগণের পক্ষ থেকে এমনটাই আভিযোগ করা হচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এসব কর্মসূচি নিয়ে তোড়জোড় করায় সরকারের উদ্দেশের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

অন্যদিকে বিজেপির জন্যও গলার কাঁটা নেই তা নয়। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় চলে যাওয়া হিন্দুদের বহুদিনের প্রত্যাশা ও দাবি ছিল তাদের নাগরিকত্ব দেয়া। বিজেপিও ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ইশতেহারে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং প্রচারণা চালিয়েছে। অবশেষে বিজেপি পার্লামেন্টে ও রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে নাগরিকত্ব বিলটি পাস করাতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতিও বিলটির চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কোনো লোককেই ‘নাগরিকপত্র’ প্রদান করা হয়নি। এ ব্যাপরে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি, সিএএ ও এনআরসির ব্যাপারে রাজ্য সরকারের (তৃণমূল) প্রবল বাধার মুখে তারা নাগরিকপত্র প্রদান করতে পারছে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের এই যুক্তি মানতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত বিলের ব্যাপারে রাজ্য সরকার যতই বিরোধিতা করুক না কেন কেন্দ্রীয় সরকার প্রক্রিয়াগতভাবে নাগরিকপত্র দেয়া শুরু করলে রাজ্য সরকার আইনগতভাবে কিছুই করতে পারবে না। নাগরিকত্ব প্রত্যাশিত লোকজনের মধ্যে এমন আশঙ্কাও আছে যে, রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাদের ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ জীবনও শুরু হতে পারে। ফলে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিএএ (ঈরঃরুবহ অসবহফসবহঃ অপঃ) নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। নাগরিকত্ব দেয়া নিয়ে বিজেপির এই টালবাহানায় বিশেষ করে ‘মতুয়া’ সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ বাড়ছে। তারা অনেকেই বুঝতে পারছেন, ভোটের জন্য তাদের সামনে ‘মুলা’ ঝোলানো হয়েছে। মতুয়াদের পক্ষ থেকে বনগাঁর বিজেপি সংসদ সদস্য শান্তনু ঠাকুর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কাছে জানতে চেয়েছিলেন নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি। জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, আগে করোনা ভ্যাকসিন, পরে সিএএ হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথায় মতুয়াদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষোভের আঁচ ক্রমে গনগনে হচ্ছে বুঝে বনগাঁর সংসদ সদস্য শান্তনু ঠাকুরও সুর চড়াচ্ছেন। অমিত শাহের বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শান্তনু ঠাকুর রায়গঞ্জে বলেছেন, ‘কোভিডের জন্য ভ্যাকসিন জরুরি নিশ্চয়ই, তবে তার জন্য সিএএ কিছুতেই আটকাতে পারে না। শান্তনু বলেন, ‘আমি আগে মতুয়া, পরে সংসদ সদস্য’। খোদ বিজেপির সংসদ সদস্য যেখানে ‘বেসুরো’ সেখানে সাধারণ মতুয়াদের সুর সপ্তমে চড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। শান্তনু ঠাকুর বলেছেন, আমি বিজেপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি বেশিরভাগ মতুয়ার ভোটেই নির্বাচিত হয়েছি, ভোটের আগে মতুয়াদের নাগরিকপত্র দেয়ার ব্যাপারে জোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ভিত্তি ছিল বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার। আইন পাস হওয়ার পরও কেন তাদের নাগরিকপত্র দেয়া হবে না? সংসদ সদস্য শান্তনু ঠাকুর মতুয়াদের কাছে এখন বেকায়দায় পড়েছেন। নির্বাচনের আগে নাগরিকপত্র দেয়া না হলে তিনি বিজেপি ছেড়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছেন। তৃণমূলের ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর মতুয়াদের এই ক্ষোভের বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ইতোমধ্যে বেশ প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন।

এবারের মতো ‘হাই ভোল্টেজ’ নির্বাচন এর আগে পশ্চিমবাংলায় আগে কখনো হয়নি বলেও অনেকে মনে করছেন। পশ্চিমবাংলা দখলের জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছেন অমিত শাহ। যেখানে ভোট সেখানেই অমিত শাহ কেরামতি দেখাতে নেমে পড়েন। তার সাফল্যও একেবারে কম নয়। অন্যদিকে নির্বাচনে তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব নিয়েছেন কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর। এই নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ‘পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট’-এর ভাগ্য।

পশ্চিমবাংলায় বিজেপির ব্যাপক উত্থানের মুখে কেমন তৃণমূলের ঝাণ্ডা কীভাবে উড্ডীন থাকবে তার ব্যাখ্যা দিয়ে ভোট-স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর বলেছেন, বিজেপি ৭০ ভাগের বেশি ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পারবে না, কেননা ৩০ ভাগ মুসলিম ভোটার তাদের ভোট দেবে না। কিন্তু তৃণমূল ১০০ ভাগ ভোটারের কাছে অনায়াসে পৌঁছাবে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, বিজেপি ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৪৮টি আসন প্রাপ্তির টার্গেট করছে। নির্বাচনের নানা সমীকরণ মিলিয়ে বিজেপিই পশ্চিমবাংলায় সরকার গঠন করবে বলে বিজেপি মহলের বিশ্বাস।

কিন্তু প্রশান্ত কিশোর মনে করছেন, যেহেতু বিজেপি একটি সম্পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল তাই মুসলিম ভোটাররা বিজেপিকে একেবারেই ভোট দেবে না। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রশান্তর এই যুক্তিকে মানতে নারাজ। রাজ্য বিজেপিতে অনেক মুসলিম সদস্য রয়েছেন, যারা বড় দায়িত্বেও আছেন। এদের প্রভাব উপেক্ষা করার মতো নয়। তা ছাড়া বিজেপির নিত্যনতুন প্রচারকৌশলও ভোটারদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।

‘সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমেন (মিম)’ (অষষ ওহফরধ সধলষরং-ব-ওঃঃবযধফঁষ সঁংষরসববহ (গঊওগ) নামে একটি রাজনৈতিক দলও এবার পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনে অংশ নেবে। অতিসম্প্রতি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে মিম কয়েকটি আসন পেয়েছে। জানা যায়, মিম বিহারে বিজেপির সঙ্গেই যুক্ত ছিল। সংখ্যালঘু ভোট নিশানা করে এটি বিজেপির একটি কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। বিহারের মতো কৌশল পশ্চিমবাংলায়ও অবলম্বন করা হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।

অন্যদিকে হুগলি জেলার অন্তর্গত বহু পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা বলে খ্যাত আব্বাস সিদ্দিকীও একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করার কথা সাংবাদিকদের কাছে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। এর আগে আব্বাস বেশকিছু জনসভাও করেছেন। জনসভাগুলোতে ব্যাপক জমায়েত হয়েছে। আব্বাস সিদ্দিকী বলেছেন, ভোটের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিগত দশ বছরে আমাদের শরীফ এলাকায় উন্নয়নের একটি প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। উপরন্তু আমাদের ওপর গু-া-মাস্তান লেলিয়ে, ভয়-ভীতি দেখানো এবং নির্যাতন করানো হয়েছে তৃণমূলের হাইকমান্ডের নির্দেশে। তাই আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন করব এবং দেখিয়ে দেব রাজ্যে সংখ্যালঘু ২৭ বা ৩০ ভাগ ভোট তৃণমূল কীভাবে পায়? ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, তৃণমূলের পক্ষে প্রশান্ত কিশোরের ‘সংখ্যালঘু ভোট ফ্যাক্টর এডভোকেসি’ এবার কোনো কাজেই আসবে না।

এসব বিবেচনায়, তৃণমূলের নির্বাচনী কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোরের ১০০ ভাগ ভোটারের কাছে তাদের যাওয়ার পরিকল্পনা কতটুকু কার্যকর হবে তা কেবল ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এই ভোট কৌশলীকে তৃণমূলের হাইকমান্ড (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি) বিহার থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল নির্ধারণের জন্য। এ জন্য প্রশান্তকে সাড়ে চারশ কোটি রুপির বেশি দিতে হবে। শুধু বিজেপিই নয়, রাজ্যের সব বিরোধী দলেরই এই অভিযোগ। অন্যদিকে ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে আনার পর থেকে তৃণমূলের অন্দরে ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরের আচরণে ক্ষুব্ধ হন তৃণমূলের অনেক সিনিয়র নেতা ও কর্মী। তাই প্রশান্ত শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের প্রশান্তির কারণ থাকবেন কিনা, সে প্রশ্নও উঠছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে। অভিষেক সরকারের কোনো অংশ না হলেও মমতা তাকে জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়েছেন, কেন এই বেআইনি ব্যবস্থা করলেন মুখ্যমন্ত্রী, সে প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূলের বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যরা। তৃণমূলের বাঘা বাঘা নেতা থাকতেও ভাইপো হওয়ার সুবাদে অভিষেককে মমতা দলে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় সিনিয়র নেতারা বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না। অভিষেক ও প্রশান্ত কিশোরের নানাবিধ কর্মকা-ে অসন্তুষ্ট হয়ে কয়েকজন বিধায়ক, মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মী ইতোমধ্যে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। দলের মধ্যে বিশাল গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী অভিষেক ব্যানার্জির কারণে মন্ত্রিত্ব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে কয়েকদিন আগে বিজেপিতে যোগদান করেছেন। বিজেপির প্রভূত শক্তিধর অমিত শাহেরও প্রবল ইচ্ছে ছিল শুভেন্দু অধিকারীকে তাদের দলে নেয়ার। বিশাল সম্মানের সঙ্গে মেদিনীপুরের জনসভায় শুভেন্দুকে পদ্মফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়েছে বিজেপিতে। ৩৪ বছরের বাম দলকে পরাজিত করে মমতা যে সরকার গঠন করেছিলেন তার অনেক অবদানই ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। তার নিজের এলাকা কাথী মেদিনীপুর ছাড়াও পশ্চিমবাংলার তাবৎ জনগণের কাছে শুভেন্দুর জনপ্রিয়তা রয়েছে ব্যাপক। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বিরাট জনসভা ও পথসভা করে দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলার রাজনীতিতে শুভেন্দুর গুরুত্ব কতটা।

তৃণমূল সরকারের দশ বছরের সীমাহীন ব্যর্থতা ও নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ বিভিন্ন তথ্যচিত্র তুলে ধরছে বিজেপি তাদের প্রচারণায়। তৃণমূলও পাল্টা তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে জোর প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। দুটি দলই ভোটারদের কাছে এগিয়ে থাকার দাবি করলেও এবারের নির্বাচনে কিন্তু বহুমুখী ফ্যাক্টর কাজ করবে। এর মধ্যে প্রধানত চারটি উপাদান বেশি কাজ করবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। এই চারটি উপাদনের মধ্যে একটি হলো, ব্যাপকহারে দলবদল। তৃণমূলসহ বিভিন্ন দল থেকে অনেকেই বিজেপিতে যোগদান করছে। এই ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে শেষ হয়, দেখার বিষয় সেটা। প্রশান্ত কিশোর বা অমিত শাহ কেউই হয়তো এর পরিণতিটা জানেন না। দ্বিতীয়ত রয়েছে বিভিন্ন জনপ্রিয় ইস্যু। শেষ পর্যন্ত এনআরসি বা সিএএর মতো ইস্যুকে সামনে এসে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হতে পারে। তৃতীয়ত দুই দলের প্রার্থিতাও একটি চমক সৃষ্টি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত কাদের মাঠে নামিয়ে কোন দল বাজিমাত করবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। জনগণের কাছে প্রার্থীর ভাবমূর্তি বা গ্রহণযোগ্যতা জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। শেষ বিষয় হবে নির্বাচনী প্রচার কৌশল। কোন দল কীভাবে কাকে ঘায়েল করে, সেটা দেখতে চাইবেন ভোটাররা।

তবে পশ্চিমবাংলায় বিজেপির শক্তি বেড়েছে। ২০১৪ সালে ভারতজুড়ে মোদি ঝড় উঠলেও পশ্চিমবাংলায় বিজেপির ভোট ছিল ১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৪০ শতাংশ অতিক্রম করে। লোকসভায় ২টি আসন থেকে এক লাফে ১৮ আসনে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি অবস্থা আরো সংহত করেছে বলে মনে হয়। সব দলের জনপ্রিয়তা কমেছে, বেড়েছে শুধু বিজেপির। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান এখন আর তুঙ্গে নেই। নানা কারণে তার জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান। বিজেপি রাজনীতির বেশকিছু অনুকূল উপাদান পশ্চিমবাংলায় বিদ্যমান। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জনপ্রিয় একটি মুখ হাজির করতে পারলে এবার বিজেপির বঙ্গজয়ের স্বপ্ন অধরা না-ও থাকতে পারে। ক্রিকেট তারকা এবং পশ্চিমবাংলায় ‘দাদা’ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় সৌরভ গাঙ্গুলির বিজেপিতে যোগ দেয়ার যে জল্পনা-কল্পনা চলছে, সেটা সত্য হলে মমতার তৃণমূলের জন্য তা বড় দুঃসংবাদই হতে পারে।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App