×

জাতীয়

প্রতারক চক্রের রমরমা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৪৮ এএম

করোনা পরীক্ষা নিয়ে সাবরিনা দম্পতির প্রতারণা। বিয়ে করে বিদেশ নেয়ার নামে কোটি টাকার প্রতারণা। বিকাশ প্রতারণা। ফেসবুকে বন্ধু সেজে উপহার দেয়ার নামে আফ্রিকান নাগরিকদের প্রতারণা। ভোটার আইডি কার্ড জালিয়াতি, এমএলএম ও অনলাইনে ব্যবসার নামে প্রতারণা। বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল এমন নানা প্রতারণাকাণ্ড। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে টক অফ দ্য কান্ট্রি ছিলেন রিজেন্টের ‘মহাপ্রতারক’ সাহেদ। পুলিশ বলছে, মূলত লোভের ফাঁদে পড়েই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। এছাড়া অজ্ঞতাও একটি কারণ। তবে প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেমি ও রাজনৈতিক মদদ একটি বিষয়। জেকেজি ও রিজেন্ট প্রতারণার ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। আরেকটি বিষয়ও রয়েছে কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার আশা। প্রতারকরা এমন লোভ দেখিয়ে শিক্ষিত মানুষদেরও বোকা বানাচ্ছে।

এমএলএম ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা রকম জালিয়াতি-প্রতারণার ডজন-ডজন মামলার খবর ঢেকে রেখে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভিভিআইপিদের মাঝখানে হাজির হতে শাহেদকে বেগ পেতে হয়নি। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও সরকারি আমলাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা অসংখ্য সেলফি তার ফেসবুক পেইজের শোভা বাড়িয়েছিল। করোনা মহামারিতে তারই নিয়ন্ত্রণাধীন রিজেন্ট হাসপাতালকে এ রোগের চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। তবে কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও পরীক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব তদন্ত শুরু করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। চলতি বছরের ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসাসেবার পাশপাশি কোভিড-১৯ এর ভুয়া প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগে র‌্যাবের অভিযান শুরু হয়। হাসপাতাল থেকে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি হতো রিজেন্ট হাসপাতালের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। এরপরই র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর বাসায় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রধান কার্যালয়ে অভিযানে যান। সেখান থেকেও ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের নির্দেশে এসব ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি হয়। এই পরীক্ষার জন্য রিজেন্ট হাসপাতাল একেক জনের কাছ থেকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিয়েছিল। হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানোর পর র‌্যাব জানতে পারে, কোভিড-১৯ ফরমে বিনামূল্যে লেখা থাকলেও প্রায় ৬ হাজার জনের পরীক্ষা করিয়েছে টাকার বিনিময়ে। এসব পরীক্ষার অধিকাংশই ভুয়া। এরপরই গা ঢাকা দেন সাহেদ। এরপরই এমএলএম ব্যবসা খুলে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ, চাকরির নামে অর্থ নেয়া, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কো-অপারেটিভ থেকে অর্থ আত্মসাৎ, ব্ল্যাকমেইলসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৩০টিরও বেশি মামলার তথ্য ওঠে আসে।

করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণায় উঠে আসে জেকেজির সাবরিনা-আরিফ দম্পতির নাম। ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকের পাশাপাশি জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর তার স্বামী আরিফ চৌধুরী ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধেও করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া প্রতিবেদন সরবরাহ করে।

পুলিশ জানায়, জেকেজি হেলথ কেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০টি প্রতিবেদন প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ চৌধুরী পুলিশকে জানান, জেকেজির ৭-৮ কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন। জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। প্রতি রিপোর্টে ৫-১০ হাজার টাকা নেয়া হতো। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নেয়া হতো ১০০ ডলার। সেই হিসাবে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেকেজি।

গত সেপ্টেম্বরে সিআইডির জালে ধরা পড়ে সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮) নামে এক নারী। কখনো অবিবাহিত যুবক, কখনো বিপত্নীক, কখনো তালাকপ্রাপ্তা, কখনো নামাজি, আবার কখনো বয়স্কপাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন এ নারী। যে পাত্রের জন্য যেমন পাত্রী দরকার তেমন রূপেই নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করতেন তিনি। বিশেষ করে ধনাঢ্য পাত্রদের টার্গেট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দিয়েই বেশি প্রতারণা করে টাকা নিতেন। এভাবে গত প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক পাত্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় জান্নাত। এভাবে প্রতারণা করে ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হন এ নারী। এছাড়া ফেসবুকে বন্ধু বানিয়ে উপহার দেয়ার নামেও প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকা থেকে আসা বিদেশি নাগরিকরা। দেশীয় কিছু ব্যক্তির সহায়তায় প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। ভোটার আইডি কার্ড জালিয়াতি করেও ঋণ নিয়ে গেল বছর প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এ কাণ্ডে নাম আসে জাতীয় নির্বাচন কমিশনে কর্মরত কিছু সদস্যের নামও। এছাড়া গত নভেম্বর মাসে ই-কমার্স ব্যবসার নামে মাত্র ১০ মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস’ নামে একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। প্রতারণায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির মতো ‘পিরামিড’ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২২ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন তারা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যানুসন্ধানের পর এই চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রতারণার মামলা নিয়ে কাজ করা ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার নাজমুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, মূলত লোভের ফাঁদে পড়েই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। এছাড়া অজ্ঞতাও একটি কারণ। অনেকেই প্রতারিত হলেও আইনের সহায়তা নিতে চান না। তবে প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক এ প্রতিবেদককে বলেন, কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার আশাই প্রতারণায় পড়ার একটি বড় কারণ। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখছি, প্রতারকরা তাদের টার্গেটকে লোভের ফাঁদে ফেলে। অনেক শিক্ষিত মানুষকেও আমরা বোকা হতে দেখছি।

আরেকটি বিষয়, প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেমি। কারণ প্রতারণার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে মামলা নেয়ার বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ নিতে চায় না পুলিশ। এছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়া। জেকেজি ও রিজেন্ট প্রতারণার ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। প্রতারণা বন্ধে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App