×

মুক্তচিন্তা

বিএনপির গণঅভ্যুত্থান সংগঠনের অঙ্গীকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১৭ পিএম

১ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতের শেষে গণমাধ্যমের সম্মুখে বলেন, ২০২১ সালে বিএনপি সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করে দেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করতে তার দলের সব স্তরের নেতাকর্মীকে প্রস্তুত করছেন। তার এ বক্তব্যের পরপরই বিএনপির অন্য নেতৃবৃন্দও একই ভাষায় নতুন বছরে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করছেন। গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার মতো আন্দোলন বিএনপি এ বছর দেশে সংঘটিত করতে যাচ্ছে এমন বক্তব্যে গণমাধ্যমগুলোতে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা ধরনের মতামত ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিএনপির মহাসচিবের এ বক্তব্য প্রদানের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দেশে গণঅভ্যুত্থান সংঘটনের মতো কোনো বাস্তব অবস্থা বিরাজ করছে না বলে দাবি করে বিবৃতি প্রদান করেছেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এবং টিভি টকশোর কয়েকজন আলোচক মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দের ২০২১ সালে শেখ হাসিনা সরকারকে বিদায় করার জন্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটনের বক্তব্যকে দলীয় কর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের গতি সঞ্চারের একটি চিন্তা-ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করছেন। কেননা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ২০১৫ সালের পর থেকে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। যদিও তাদের নেতৃবৃন্দ বারবারই আন্দোলন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিশ্রুত আন্দোলনের উদ্যোগই তারা কোনোবার নেয়নি, ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে আছেন এমনটি খুব একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, তবে বক্তৃতা-বিবৃতি এবং গণমাধ্যমে মির্জা ফখরুলসহ বেশ কয়েকজন নেতার মুখ থেকে আন্দোলন ও সরকার পতনের ব্যাপারে প্রায়ই বক্তব্য শোনা যায়। এ কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাসহ অনেকেই নতুন বছরের প্রথম দিন মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে আগের মতোই সরকার পতনের হুমকি-ধমকি হিসেবেই দেখছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু মির্জা ফখরুলের বক্তব্য এবং তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয় এবার তিনি সরকার পতনের লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটনে অনেক বেশি আস্থাশীল, নিশ্চিত। তবে ২০২১ সালে দেশে বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগবিরোধী সব রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে একমঞ্চে দাঁড়াবে কিনা সেই প্রশ্নটি সবার আগে উত্থাপন করা জরুরি। অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় একটি জোট বহু আগে থেকেই দেশে রয়েছে। এ জোটের বাকি ১৯টি দলের মধ্যে জামায়াতই একমাত্র সংগঠিত দল, বাকি দলগুলোর তেমন কোনো জনসমর্থন আছে বলে মনে হয় না। সে কারণে ২০ দলীয় জোটের কথা উচ্চারিত হলেই মানুষ এটিকে বিএনপি ও জামায়াতের বিশেষ ঐক্যের জোট হিসেবে মনে করে থাকে। তবে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের সঙ্গে ইসলাম নামধারী কয়েকটি দল রয়েছে, যারা রাজনৈতিকভাবে ডান বলয়েরই দল হিসেবে পরিচিত। ২০ দলীয় জোটের বাইরের নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম এবং নেতাসর্বস্ব কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ওইসব দলের নেতৃবৃন্দকে প্রায়ই বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করতে দেখা যায়। এর বাইরে বাম ঐক্যজোট বলে সিপিবি, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির একটি ঐক্যজোট সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর থাকলেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতার কারণে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে অনেক আগেই অপারগতা প্রকাশ করেছে। বর্তমানে তারা গণঅভ্যুত্থান সংঘটনে বিএনপির সঙ্গে একত্রিত হবে কিনা তা এখনো কেউ বলতে পারছে না। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে আগে থেকেই জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপসহ কয়েকটি ছোট ছোট দল মহাজোট নামক একটি ছাতার নিচে রয়েছে বলে সবাই জানে। সুতরাং শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার বিষয়টি উত্থাপিত হলে দেশে রাজনৈতিক দল, জোট এবং আদর্শের সমীকরণের বাস্তবতা অবশ্যম্ভাবীভাবে বিবেচনায় চলে আসে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শমুখিতা, অসাম্প্রদায়িকতা, উদার গণতান্ত্রিকতা এবং দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থান ও জোটবদ্ধতার ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক আদর্শগত দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনাকেই চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়ার হুমকি হিসেবে রাজনীতি সচেতন মহল দেখছে। সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ তাবৎ রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের কর্মসূচি প্রদান করলেও তাতে বৃহত্তর জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আওয়ামীবিরোধী শক্তির পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার বলে ভাবার বিষয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হলেই এটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়ার বাস্তবতা সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। কেননা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী কোনো শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যার নেতৃত্ব প্রদান করে প্রগতিশীল উদারবাদী রাজনৈতিক শক্তি, যাদের উত্থাপিত রাজনৈতিক কর্মসূচি জনগণকে আগে থেকেই আন্দোলনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিশন-মিশন উত্থাপন করা হয়।
বিএনপির নেতৃবৃন্দ উগ্র বামদের বহুল উচ্চারিত ফ্যাসিবাদ, কর্তৃত্ববাদ, একনায়কত্ব ইত্যাদি শব্দের বেড়াজালে জনগণকে আবদ্ধ ও বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে, আর বিভ্রান্ত জনগণকে নিয়ে বিএনপি সরকার উৎখাতের আন্দোলন তুঙ্গে তুলতে চায়। কিন্তু রাজনীতি সচেতন মহল, গণতান্ত্রিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মহলের দায়িত্ব হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনার বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শক্তির মধ্যে ঐক্য জোরদার করা এবং অপশক্তির চরিত্র উন্মোচন করা।
বাংলাদেশে ১৯৬৯ সালেই একবার সত্যিকারে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত অভ্যুত্থানটি অনেকটাই শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ সমাজের অভ্যুত্থানের চরিত্র লাভ করেছে। এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন যুক্ত থাকার কারণে সরকার পতন ঘটলেও গণঅভ্যুত্থানের পরিপূর্ণ চরিত্র এটি লাভ করেনি, কেননা এ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন ঘটলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ একাই ৫টি আসনসহ তার দল মোট ৩৫টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এর মাধ্যমে নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের সীমাবদ্ধতা পরিস্ফুট হয়। অন্যদিকে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গ্রাম-শহরসহ সর্বত্র জনগণ পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে অংশগ্রহণ করেছে, জনগণের কাছে ৬ দফা এবং শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া অন্য কোনো বিকল্পই বিবেচ্য ছিল না। গণঅভ্যুত্থান শেখ মুজিবের মুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথম পর্ব অতিক্রম করলেও এর চূড়ান্ত অর্জন তখনো হাতে ধরা দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জনগণ নিরঙ্কুশভাবে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে জনগণই এর নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। এ কারণেই গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক চেতনায় পুরনো ব্যবস্থার প্রতি শুধু অনাস্থাই নয়, প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সম্পৃক্ত হওয়ার রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা গভীরভাবে যুক্ত থাকে। সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি কখনো গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে পারে না, সেই রাজনীতি তাদের কাছ থেকে আশা করাও যায় না। এরপরও তাদের মুখ থেকে যদি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার কথা শোনা যায় তাহলে সেটি হবে সমাজ প্রগতির ধারাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র, যা বুঝতে কারো কারো ভুল হতে পারে। পৃথিবীর গণআন্দোলন, বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে উগ্র ডান বা উগ্র বাম হটকারী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের কোনো ইতিবাচক ভূমিকার কথা খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে প্রতিবিপ্লব, গণতন্ত্রবিরোধী অভ্যুত্থান সংঘটিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র-সমাজকে পিছিয়ে নেয়ার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এ কারণেই এদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বিএনপির নেতৃত্বে যেসব রাজনৈতিক দল, জোট এবং গোষ্ঠী রয়েছে তাদের কেউই পাকিস্তানকাল থেকে এ পর্যন্ত গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখেনি। এরশাদ সরকারবিরোধী যে আন্দোলন হয়েছিল তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট, এটিকে অনুসরণ করেছিল বিএনপি-জামায়াতের পরিচালিত ৭ দলীয় জোট। এ জোট কখনই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি ছিল না। এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ত্যাগ এবং নেতৃত্ব ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং এখন বিএনপি যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে নিয়ে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার স্বপ্ন দেখাতে চায় তারা সবাই সাম্প্রদায়িক, উগ্র হটকারী, অতি ডান, অতি বাম, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী শক্তিও। যদিও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল বলে নিজেদের দাবি করে থাকে, কিন্তু এটি আগা-গোড়াই স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রাজনীতি করে আসছে। সুতরাং এ গোষ্ঠীর দ্বারা সূচিত কোনো আন্দোলনে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং বৃহত্তর গণগোষ্ঠীর অংশ নেয়ার সম্ভাবনা থাকার কথা নয়। ২০১৩ সালে সরকার উৎখাতে হেফাজত এবং পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চের সরকার উৎখাতের তথাকথিত আন্দোলনের পরিণতি আমাদের সবার খুব ভালোভাবেই জানা আছে। এসব আন্দোলন চরিত্রগতভাবে ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর পরিচালিত, যার লক্ষ্য ছিল শুধু সরকার উৎখাতই নয়, বরং দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা। সে কারণে এসব কথিত আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা ঘটেনি, ফলে বিএনপি-জামায়াতের তথাকথিত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিএনপির মহাসচিব গণঅভ্যুত্থান সংঘটনের বস্তুগত কারণ ও বাস্তবতা উল্লেখ না করলেও শেখ হাসিনার সরকারকে ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্বমূলক ইত্যাদিতে ভূষিত করছেন, দাবি করছেন এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করছে, তাই এসবের পুনরুদ্ধারে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। এর জন্য গণঅভ্যুত্থান ছাড়া তার ভাষায় কোনো বিকল্প নেই। মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্য খুবই আন্তরিক, তবে রাজনৈতিকভাবে সেই শক্তিরই পদধ্বনি শোনাচ্ছে, যারা ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিল। সুতরাং বিষয়টি রাজনৈতিক আয়নায় দেখলে খুবই পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, এটি মূলত উগ্র প্রতিক্রিয়াশীলদেরই গণতন্ত্রপ্রেমের ছদ্মাবরণ মাত্র। দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনা গত ১২ বছর অভূতপূর্ব বেশ কিছু সাফল্য দেখিয়েছেন, যা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির মহাসড়কে তুলে এনেছে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিনিয়োগ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন যেভাবে ঘটেছে তা ঈর্ষণীয়, তারপরও তার শাসনামলে সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে এগিয়েছে তেমনটি ভাবার কারণ নেই। শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনায়, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলছেন। তার এসব পদক্ষেপ জনগণের কাছে সমাদৃত হচ্ছে, সুতরাং শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদী, একনায়ক ও কর্তৃত্ববাদীসহ নানা নেতিবাচক চরিত্রে চিহ্নিত করার বিষয়টি বাস্তবের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর অপশাসন, যার উত্থানে থাকে দেশি-বিদেশি লগ্নি পুঁজি এবং যার রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমাবেশ শেখ হাসিনার পেছনে নয় বরং বিএনপির পেছনেই ঘটেছে। সুতরাং বিএনপির মহাসচিবের এসব বক্তব্যের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং ঐতিহাসিক চরিত্র উন্মোচন করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ এসব উগ্র বক্তৃতায় বিভ্রান্ত না হয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দ উগ্র বামদের বহুল উচ্চারিত ফ্যাসিবাদ, কর্তৃত্ববাদ, একনায়কত্ব ইত্যাদি শব্দের বেড়াজালে জনগণকে আবদ্ধ ও বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে, আর বিভ্রান্ত জনগণকে নিয়ে বিএনপি সরকার উৎখাতের আন্দোলন তুঙ্গে তুলতে চায়। কিন্তু রাজনীতি সচেতন মহল, গণতান্ত্রিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মহলের দায়িত্ব হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনার বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শক্তির মধ্যে ঐক্য জোরদার করা এবং অপশক্তির চরিত্র উন্মোচন করা। এর মাধ্যমেই গণঅভ্যুত্থানের নামে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App