×

সারাদেশ

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে শেরপুরের টুপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২৫ এএম

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে শেরপুরের টুপি

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে তৈরী হয় জালি টুপি -ভোরের কাগজ

বাড়ির কাজের অবসরে টুপি তৈরি করে স্বাবলম্বী বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা। হাতে তৈরি এসব টুপি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। প্রতি বছর টুপি রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হলেও করোনায় থমকে গেছে ব্যবসা। চলতি বছর টুপির উৎপাদন বাড়লেও কমে গেছে রপ্তানি। ফলে জমে থাকা প্রায় ৫ কোটি টাকার টুপি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

মুসলিম পুরুষদের ইসলামী পোশাকের প্রয়োজনীয় উপকরণ টুপি। প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের চকধলী ও চককল্যাণী গ্রামে এই বিশেষ ধরনের জালি টুপি তৈরি শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়তে থাকে আশপাশের গ্রামের নারীদের মাঝে। বর্তমানে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে তৈরি হয় জালি টুপি। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় প্রায় ৫০ হাজার নারী। প্রতিদিন তৈরি হয় ২০-৩০ হাজার পিস টুপি। একেকটি টুপির গড় মূল্য ৩০ টাকা ধরলে মাসে উৎপাদন হয় ৯০ লাখ টাকার টুপি। এ উপজেলায় গড়ে বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার টুপি তৈরি করেন গ্রামের নারীরা। এসব টুপি হাতবদল হয়ে রপ্তানি হয় প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, দুবাই ও কাতারসহ অনেক দেশে।

শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা ঘর-গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে তৈরি করে অর্থ উপার্জন করছেন। বাড়ির আঙ্গিনায় বসে প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্যেই তৈরি হয় নান্দনিক টুপি। এই কাজে গৃহবধূর সঙ্গে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। টুপি তৈরি একজন নারী মাসে ৩-৪ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন।

শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের বৃন্দাবনপাড়ার বাসিন্দা মোছা. সেলিনা খাতুন জানান, আমি নিজে ও আমার দুই মেয়ে টুপি তৈরি করি। যা আয় হয়, তা সংসারের পিছনে খরচ করি। টুপি বিক্রির টাকা দিয়ে মেয়েদের গহনা বানিয়ে দিয়েছি। শেরপুর উপজেলার বেলগাছী গ্রামের আয়েশা ও শিল্পী আকতার জানান, আমরা ১৫ বছর ধরে টুপি তৈরি করি। এই টুপি বিক্রি করেই নিজের ইচ্ছেমতো সংসারের জন্য খরচ করি। স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় না। শেরপুরে গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপি সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে তা বিদেশে রপ্তানি করা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী চক্র।

উপজেলায় প্রায় ২ শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা গ্রামের নারীদের নিকট সুতা এবং ক্রুশকাটা (টুপি তৈরির বিশেষ ২টি কাটা) সরবরাহ করেন। এরপর তাদের নিকট থেকে সপ্তাহন্তে কিংবা ১৫ দিন পর টুপি কিনে নিয়ে আসেন। রকমভেদে এসব টুপি ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। যার সিংহভাগই যায় বিদেশে। সেখানে এগুলো ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

এ ব্যাপারে শেরপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সুবির কুমার পাল ভোরের কাগজকে জানান, উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে নারীরা টুপি সেলাই করে সংসারে বাড়তি উপার্জন করছেন। তারা সরকারি কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা করতে পারি। টুপি প্রক্রিয়াজাতকারক মো. খোকন আকন্দ জানান, বাহারী রকমের টুপি তৈরি করেন নারীরা। এর মধ্যে রয়েছে এসপি বুটা, এসপি স্টার, ফ্যান ফুল, নব্বই ফুল, কদম ফুল, বরইফুল, গুজরাটি, চব্বিশ ফুল, পাঁচপাতা, তেষট্টি ফুল, চিকন ফেন্সিক্যাপ ইত্যাদি। মোটা সুতার টুপির পাশাপাশি মসলিন কাপড়ের মতো সূক্ষ সুতার তৈরি টুপিও আছে, যা কিনা একটি দিয়াশলাইয়ের খাপের মধ্যেও রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশ জালি টুপি এসোসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফিরোজ উদ্দিন সোহাগ জানান, শেরপুরে নারীদের হাতেগড়া টুপিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সুতা ও টুপি প্রক্রিয়াজাতকরণের বেশ কয়েকটি কারখানা। গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি টুপি সংগ্রহ করে তা ধোলাই করে প্যাকেটজাত করা হয়। তারপর সেগুলো ঢাকায় চকবাজার এবং গুলিস্তানে পাইকারি আড়তে পাঠানো হয়। সেখান থেকে যায় বিদেশে।

বগুড়া জেলা জালি টুপি এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জুয়েল আকন্দ জানান, বিভিন্ন দেশে কারখানায় মেশিনে টুপি তৈরি হলেও বগুড়ার শেরপুরে নারীদের হাতে তৈরি টুপির কদরই আলাদা। জালিটুপি হওয়ায় (জালের মতো ছিদ্র থাকায়) এই টুপি মাথা ঠাণ্ডা রাখে ও স্বাস্থ্যসম্মত। তাই বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে এই টুপির চাহিদা রয়েছে।

তিনি আরো জানান, প্রতি বছর বগুড়ার শেরপুর ও ধুনট উপজেলা থেকে ১০-২০ কোটি টাকার টুপি বিদেশে রপ্তানি হতো। তবে এ বছর করোনার কারণে হজ ও অন্যান্য মুসলিম জমায়েত বন্ধ থাকায় টুপি বিদেশে পাঠানো যায়নি। তাই টুপি শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এছাড়া করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা বা প্রণোদনাও পাইনি। এ শিল্পে জড়িতদের রক্ষায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App