×

জাতীয়

সাইবার ক্রাইমে টার্গেট ছিল নানা বয়সি নারী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪৯ এএম

করোনায় বেড়েছে অনলাইনে প্রতারণা

প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা পড়ছে শত শত অভিযোগ। ছোটখাটো ঝামেলা সম্পর্কে টানাপড়েন হলেই প্রেমিকা বা বউয়ের আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, যৌন হয়রানি হচ্ছে হরহামেশা। ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে মানহানি, বিভ্রান্তিকর পোস্ট, অনলাইনে কেনাকাটাভিত্তিক প্রতারণা, গুজব ছড়ানোর ঘটনা তো আছেই। বাদ যাচ্ছে না উগ্রবাদও। তবে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার ক্রাইমের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে নানা বয়সি নারী।

সাইবার বিশেজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটার পরই জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে অপরাধীরা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, গেলো বছর ২ হাজার ১৮৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যারেজমেন্ট জাতীয় ৮১২টি, আর্থিক প্রতারণা (বিকাশ, রকেট, নগদ) ৪৫৫টি, অনলাইনে গেমের ফাঁদে প্রতারণা ১৮০টি, ভুয়া পণ্যের বিজ্ঞাপনে অর্থ হাতানো ৪৩৫টি, নাইজেরিয়ান প্রতারক সংক্রান্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়ে। বাকিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হ্যাকিং। অভিযোগকারীদের বেশির ভাগই ১৬-৩০ বছর বয়সি নারী।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিসি) সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরে দেড় হাজারের বেশি অভিযোগ পড়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ব্লাকমেইলিং, হ্যাকিং, পর্নোগ্রাফি, হয়রানি, ক্রেডিট কার্ড স্ক্যামিং জাতীয় অপরাধ। তবে অভিযোগকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী, যাদের বয়স ১৬-২৪ বছরের মধ্যে। পাশাপাশি করোনাকালে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইনে কেনাকাটাভিত্তিক প্রতারণা। লকডাউন ও মহামারির ভয়ে অনেকে বাসা থেকে বের না হয়ে অনলাইননির্ভর হয়ে পড়ায় সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে প্রতারকরা। একই সঙ্গে ছড়িয়েছে নানা ধরনের গুজব।

সূত্রটি আরো জানায়, বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে এ বছর ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে সামাজিক কারণে লিখিত অভিযোগ করতে চাননি। তাদের তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দিয়েছে ডিএমপির এই বিশেষায়িত ইউনিট।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা মহামারির শুরু থেকে মানুষ অনলাইনে কেনাকেটার ওপরে ঝুঁকে পড়ায় এ বিষয়ক প্রতারণা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গুজব, ব্লাকমেইলিংসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় অপরাধীদের সম্পূর্ণ রুট ম্যাপ চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি এ বছর দুইবার ব্যাংকে সাইবার হামলার চেষ্টা করা হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো হামলা বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। শুধু হামলার হুলিয়া জারি করে নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম যেহেতু তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে সেজন্য শুধু ঢাকার ওপর নির্ভরশীল না থেকে ৮ বিভাগে আলাদা আলাদা ‘সাইবার ক্রাইম মনিটর ইউনিট’ ও ফরেন্সিক ল্যাব গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

সিটিটিসির সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে নিয়মিত কিছু ঘটনা নিয়ে কাজ করলে মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর ধরন কিছুটা পাল্টে যায়। অনলাইনে কেনাকাটাভিত্তিক প্রতারণা ও গুজব বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ব্লাকমেইলিং, হ্যাকিং, ফেক আইডি খুলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ও পর্নোগ্রাফির মতো ঘটনা বাড়তে থাকে। বছরজুড়েই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০-১৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিকটিমদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, এ বছরে অনলাইনে কেনাকাটাভিত্তিক প্রতারণা ও বরাবরের মতো গুজব ঠেকানো আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। আমরা দেখেছি প্যানডামিকের সুযোগে সাইবার অপরাধীরা নারীদের টার্গেট করে নানা রকম কার্যক্রম করতে থাকে। পরে আমরা মনিটরিং সেল আরো জোরদার করে সফট পুশ ও হার্ড পুশ ক্যাটাগড়িতে ভাগ করে আসামিদের চিহ্নিত করতে থাকি। যারা সরাসরি অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার এবং যারা প্রলুব্ধ হয়ে কিছু শেয়ার করেছে তাদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফউল্লাহ বলেন, সাম্প্রতিককালে অনলাইনভিত্তিক প্রতারণা অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে হ্যারেজমেন্টের ঘটনা বাড়ছে। আমরা অভিযোগ পেলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করি। কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। এরপরও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে সাইবার ক্রাইম যেহেতু পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে করা সম্ভব সেহেতু ইউরোপসহ সব দেশের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তিসহ দূতাবাসগুলোতে পুলিশের একজন প্রতিনিধি থাকলে আমাদের কাজ আরো সহজ হবে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম (সাইবার ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন্স) বলেন, সাধারণ অপরাধের চেয়ে সাইবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ অপরাধী ছদ্মবেশ ধরে থাকে। আর এই কাজগুলো করে থাকে ভিকটিমের পরিচিত লোকজনই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিকটিম নারী। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতারণা, পর্নোগ্রাফি, ব্লাকমেইলিং, গুজব ছড়ানোর মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটি প্রতিরোধে আমাদের সাইবার মনিটরিং সেল ২৪ ঘণ্টাই কাজ করে থাকে। তবে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে আমাদের সমঝোতা না থাকায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App