×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে আরো ৯টি দেশ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৫৫ পিএম

২০২০ সালের শেষ দিনে ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কর্ম অধিবেশনে (ওয়ার্কিং সেশনে) একটা সিদ্ধান্ত ২০২১ সালের শুরুতেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য একটা সুখবর (যদিও কতটা কাজের সে প্রশ্ন আছে!) হিসেবে হাজির হয়েছে। এ সুখবরটা এখনো (২ জানুয়ারি পর্যন্ত) জাতিসংঘের অফিসিয়াল ডকুমেন্টস হিসেবে আপলোড হয়নি (যদিও তৃতীয় কমিটির পুরো প্রস্তাব ডকুমেন্টস হিসাব আপলোড করা আছে), কিন্তু আমাদের এ সুখবর দিয়েছে খোদ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়ালি ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক ক্যানেথ রথের টুইট, কফি আনান কমিশনের অন্যতম সদস্য ডাচ ক‚টনীতিক লেটেশিয়া ভ্যানডেনের টুইট এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসনের টুইট। যদিও ইতোমধ্যে এ ইস্যুটি হাজার হাজার রিটুইট হয়েছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিউইয়র্কের ক‚টনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এ সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে নেয়া এ প্রস্তাব তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা ২০১৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নানা চেষ্টা-তদবির করেও কোনো ক‚লকিনারা করতে পারছে না। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে যত বেশি রাষ্ট্রের সংখ্যা যোগ হবে, মিয়ানমারের পাশ থেকে ঠিক ততটি রাষ্ট্র বিয়োগ হবে। আর নিঃসন্দেহে এ যোগ-বিয়োগে পাটিগণিতে আখেরে লাভ বাংলাদেশের। গত ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কর্ম অধিবেশনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সময় মিয়ানমারের অনুরোধে সেটা ভোটাভুটিতে দেয়া হয়। কিন্তু ভোটাভুটিতে আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৯টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। অথচ এ ৯টি দেশ ২০১৯ সালে প্রায় একই ধরনের প্রস্তাবের ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিরত’ ছিল। অর্থাৎ সেটা প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষে ছিল। কিন্তু এবার সরাসরি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ায় তাদের অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে এবং মিয়ানমারের বিপক্ষে পরিষ্কার হয়। এটাই বাংলাদেশের নগদ লাভ। এ ৯টি দেশ হচ্ছেÑ ক্যামেরুন, নামিবিয়ার, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, লেসেথো, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, তানজানিয়ো, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ এবং পালাও। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, বৈশ্বিক রাজনীতিতে আধিপত্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং ভ‚-রাজনীতির স্ট্র্যাটেজির বিবেচনায় এসব রাষ্ট্র হয়তো তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হুল্ড করে না। কিন্তু জাতিসংঘের মতো ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংখ্যা বিবেচনায় ৯টি দেশের মিয়ানমারের পক্ষ ত্যাগ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে নিঃসন্দেহে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মিয়ানমারের পক্ষ ত্যাগ যেহেতু বাই-ডিফল্ট বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন, সেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থা যে আরো দৃঢ় হলো, এ বিষয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। যারা বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের ভ‚মিকা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এবং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভ‚মিকার দিকে নজর রাখেন, তারা নিশ্চয় অবগত আছেন যে, গত বছরের ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করে ‘ঞযব ঝরঃঁধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং ড়ভ ঃযব জড়যরহমুধ গঁংষরসং ধহফ ঙঃযবৎ গরহড়ৎরঃরবং রহ গুধহসধৎ’ শিরোনামে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি রেজ্যুলেশন গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে লেখা বাহুল্য যে, এটা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো জাতিসংঘে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে এ প্রস্তাব আনে, যা ১৩২ ভোটের সমর্থনে, ৯টি রাষ্ট্রের বিরোধিতা এবং ৩১ রাষ্ট্রের ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরত থাকা’র মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়। এখানে উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটি (সামাজিক, মানবিক এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুতে) মূলত প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হয় এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির নানা ক্ষেত্রের অবনতির জন্য বিভিন্ন দেশকে সমালোচনা করা হয়। পাশাপাশি এসব মানবাধিকার পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি করা যায় তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা পেশ করা হয়। এভাবে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৃতীয় কমিটি মানবাধিকার সংক্রান্ত এসব প্রস্তাব গ্রহণ করে সাধারণ পরিষদে পাঠায়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১৮ নভেম্বর গৃহীত সেই পাঠানো প্রস্তাবই গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কর্ম পরিষদে গৃহীত হয়।

কেবল রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং নিপীড়ন নয়, সার্বিক বিবেচনায় মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি যে বেশ উদ্বেগজনক সেটা মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছি, ‘গত বছরের নভেম্বরের ৮ তারিখ অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে মিয়ানমারে বসবাসরত প্রায় ২২ লাখ এথনিক মাইনোরিটিকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, কাউন্টার-ইমারজেন্সির নামের মিলিটারি দিয়ে এথনিক মাইনোরিটিকে দমন করে একটা ভয়ের সংস্কৃতি জারি রাখা, প্রায় ৫৭টি টাউনশিপের ভোট স্থগিত করা, রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের স্বেচ্ছাচারিতার ভেতর দিয়ে প্রার্থিতা বাতিল করা প্রভৃতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একেবারেই নগদ উদাহরণ। ফলে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করা, মানবাধিকার সুরক্ষায় মিয়ানমারের ব্যর্থতার নিন্দা করা এবং কীভাবে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবের অবশ্যই গুরুত্ব আছে।’ সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ৯টি দেশের অবস্থানের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভোটাভুটিতে পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অবস্থান জাতিসংঘে আরো শক্তিশালী হলো। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হওয়া মানে, মিয়ানমারের অবস্থান দুর্বল হওয়া। তবে যে বিষয়টি আমার কাছে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যখনই কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তখনই ৯টি দেশ বিরোধিতা করে সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান করে। সে ৯টি দেশ হচ্ছে- মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, কম্বোডিয়া, বেলারুশ, জিম্বাবুয়ে ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ কোনোভাবেই এসব দেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। দুঃখজনক হচ্ছে, যে ৯টি দেশ প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে তার মধ্যে ৭টি দেশই (মিয়ানমার, চীন, ফিলিপাইন, লাওস, কম্বোডিয়া, জিম্বাবুয়ে ও ভিয়েতনাম) এশিয়ায় অবস্থিত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভুটান রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন না করে সবসময় ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিরত থাকে’। দক্ষিণ এশিয়ার এ চারটি দেশের অবস্থানের পরিবর্তনেও বাংলাদেশকে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি যদি এশিয়ার এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটানো যেত, সেটা হতো অনেক বেশি আনন্দের এবং অর্জনের। পরিশেষে বলব, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ৯টি দেশের অবস্থানের পরিবর্তন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু বিরোধিতাকারী ৯টি দেশের অবস্থানে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের অবস্থানের মধ্যে যদি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ক‚টনৈতিক সাফল্য। কেননা আমরা সবাই চাই, রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সন্তোষজনক, সম্মানজনক, টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হোক এবং সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যত বেশি মোবিলাইজ করা সম্ভব হবে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ ততই ত্বরান্বিত হবে। নতুন বছরে এ রকম একটি সুদিনের প্রত্যাশায়।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App