×

মুক্তচিন্তা

‘নিউ-নরমাল’ নয় ‘নরমাল’ জীবনের আশায় ২০২১

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২৫ পিএম

শুভ নববর্ষ ২০২১। এবারের নববর্ষটি সত্যিকার অর্থেই শুভ হোক। বছরের শুরুতে ২০২০-কেও ‘শুভ নববর্ষ’ বলে স্বাগত জানিয়েছিল বিশ্ববাসী। কিন্তু বর্ষবরণের লগ্ন শেষ না হতেই বিশ্ববাসী চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সেই বিপর্যয়ের ইতি ঘটেনি এখন। করোনা মহামারি আমাদের জীবনধারাকে নাজুক করে দিয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে তার খ্যাতি জুটেছে ‘নিউ-নরমাল’ নামে! কিন্তু সভ্যতার ইতিহাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ কোনো বছরই এমন ভয়, ভীতি, আতঙ্ক ও উদ্বেগ নিয়ে জীবনযাপন করেনি। ফেলে আসা বছরটির আতঙ্ক-উদ্বিগ্নতার অবসান ঘটিয়ে ২০২১ শুরু হোক কোভিড-১৯ মুক্তির নতুন প্রত্যাশায়। করোনা-দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের কাছে ২০২১ পুরনো অন্যান্য বছরের মতো স্বাভাবিকতা নিয়েই আসুক। ‘সামাজিক দূরত্বে’র নামে পরিচিতি পাওয়া ‘অসামাজিকতা’ নতুন বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক! নিকট বন্ধুকে অসংকোচ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে করোনাকালীন সামাজিক দূরত্বের অসামাজিকতা পশ্চাতে ঠেলে নতুন বছর থেকে মানবিক ও সামাজিক মানুষ হিসেবে বসবাস শুরু হোক সবার। সহজ আনন্দ নিয়ে পুরনো বছরগুলোর মতোই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলেমিশে সহজাত সামাজিক সম্পর্কে সবাই সম্পৃক্ত হোক। মানুষ সম্পৃক্ত হোক স্বাভাবিক কর্মযজ্ঞে। নতুন বছরে সবার মনের গভীর থেকে এই প্রত্যাশা দীর্ঘশ্বাস ও হতাশাবোধের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্বময়। ২০২০ আমাদের নিকট থেকে যা নিয়ে গেছে ২০২১ তা ফিরিয়ে দিতে পারবে না, তবু নতুন বছরের কাছে স্বাভাবিক ও সুস্থ থাকার অন্তহীন প্রত্যাশা আমাদের। ২০২১ সবার জন্য শুভ হোক। শুভর বারতা নিয়ে নতুন বছর সবাইকে আপ্লুত করুক এমনই প্রত্যাশা আমাদের। কোভিড-১৯ যে আতঙ্কগ্রস্ততায় ২০২০-কে মুহ্যমান রেখেছিল নতুন বছরের শুরুতে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির আশ্বাসে সেই মুহ্যমানতা বিলীন হতে চলেছে। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত প্রতিটি ভ্যাকসিন যেন কার্যকরী সুফল বয়ে এনে মানবসভ্যতাকে করোনার ছোবল থেকে রক্ষা করে। আর বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের কাছে যেন ভ্যাকসিন পৌঁছায় সেই প্রত্যাশাও আমাদের। ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যবসায় সংক্রান্ত যেসব কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়েছে তা শেষ পর্যন্ত মানবিক মূল্যবোধের কাছে পরাজিত হবে, তাও আশা করি। করোনাকে পরাস্ত করায় বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানুষের মনুষ্যত্ববোধেরও সক্রিয় ভ‚মিকা থাকতে হবে। ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের কোথাও কোনোভাবেই যেন মানবিকতা বিপন্ন না হয় তারও দেখভাল করতে হবে। নতুন বছরের শুরুতে ভ্যাকসিন নিয়ে যে আশার সঞ্চার ঘটেছে তার পরিণতি যেন সফল হয়। অর্থাৎ সবদিক দিয়ে মানুষেরই যেন জয় নিশ্চিত হয়। কেবল ভাইরাসকেই নয়, সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মানুষেরই যেন জয় হয়। ২০২০ সাল আমাদের নানাভাবে নিঃস্ব করেছে, রিক্ত করেছে। কত জ্ঞানী-গুণী ও মহৎপ্রাণকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়েছি তার হিসাব রাখাও কঠিন। বিগত বছরটিতে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, কৃষি, ক্রীড়া, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নানা ক্ষেত্রের বহুসংখ্যক ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি আমরা। করোনা যাদের ছিনিয়ে নিয়েছে তারা সবাই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে যেমন যশস্বী ছিলেন তেমনি জাতিকেও উপহার দিয়েছেন স্ব-স্ব মেধার সর্বোচ্চ ফসল। তাদের চিন্তা-চেতনা-সাহস ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অবদানে জাতি সমৃদ্ধ হয়েছে, আলোকিত হয়েছে। তাদের ঋণ কোনোদিনই শোধ করা সম্ভব নয়। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব না হলে এসব জ্ঞানী-গুণী-মহৎ মানুষের অবদানে আমরা উন্নতির পানে আরো এগিয়ে যেতাম। মৃত্যুর ওপর মানুষের হাত নেই। তবু আমাদের আফসোস অন্তহীন! স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এসব মহৎপ্রাণের মৃত্যু আমাদের আফসোসকে আরো বাড়িয়ে তোলে! বিশ্বের সমগ্র অঞ্চলের মতো বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব কেবল যে শিক্ষাগতভাবে আমাদের সন্তানদের পিছিয়ে ফেলছে তা নয় স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করতে না পারায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষার নামে যদিও কোনো রকমে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার একটি প্রয়াস আছে তবু তাতে সাফল্য লাভের হার আশাব্যঞ্জক নয়। শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস পরীক্ষা চালু আছে বটে, কিন্তু সেখানে উপস্থিতির হার হতাশাজনক। আমরা যেহেতু করোনাকালকে মহামারিরূপে মেনে নিয়েছি তাই অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রের অপচয়কেও স্বীকার করে নিয়েছি নিতে হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত করোনার প্রভাব আমাদেরকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বিকল্প হিসেবে ‘অটোপ্রমোশন’কেও এবার মেনে নিতে হয়েছে। অটোপ্রমোশন নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এর উত্তম কোনো বিকল্প ছিল না তাও অনেকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার একদল মানুষ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ‘ভেঙেপড়া’ অবস্থা নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করলেও বিশ্বের কোথায় শিক্ষাব্যবস্থা স্বাভাবিক আছে তার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন না। মহামারির সময় এমন নেতিবাচক সমালোচনাও কাম্য নয়। করোনার প্রভাব পড়েছে আমাদের শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। বিশ্বের সর্বত্রই করোনার আগ্রাসী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের চাহিদা হারিয়েছে। শ্রমবাজার থেকেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা বঞ্চিত হয়েছে। কর্মহীন হয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসতে হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিককে। কর্মহীন হয়ে ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। শোনা যাচ্ছে, সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশফেরতদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করছেন। এটি আশাব্যঞ্জক বার্তা হলেও তা বাস্তব রূপ পেতে কতদিন লাগে তাই দেখার বিষয়। উন্নয়ন সূচকের সব শাখায় করোনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, প্রভাব ফেলেছে অর্থনীতিতেও। দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সার্বিক নেতিবাচকতার মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে প্রবাসী আয় অর্থাৎ রেমিট্যান্স। ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ রেকর্ড ৪৩ হাজার কোটি টাকার রিজার্ভ কেবল রেমিট্যান্স থেকেই সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রিজার্ভের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। করোনা সংকটের মধ্যে এটি আশার খবর। করোনাকালেই আরেকটি আশার সংবাদে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম সেটি ছিল মাথাপিছু জিডিপির হারে আমরা ভারতকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। আইএমএফের তথ্যমতে, আগামী পাঁচ বছর মাথাপিছু জিডিপিতে আমাদের অবস্থান কেউ টলাতে পারবে না। এটিও আশার কথা। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অবস্থান দৃঢ় হলেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু অপচয়ও রয়েছে। এই অপচয়ের অন্যতম কারণও করোনার করাল গ্রাস। লকডাউনসহ ও স্বাস্থ্যগত অন্যান্য কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সৃষ্টি হয়েছে ধীরগতি। ‘মেগা প্রকল্প’গুলোর বাস্তবায়নও বিলম্বিত হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ব্যয় বৃদ্ধি আমাদের সামগ্রিক অর্থ-ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আশার কথা, করোনার মহাতঙ্কের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। সেতুটির সব স্প্যান বিজয় দিবসের আগেই বসানো হয়ে গেছে। আশা করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিজয় দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল সম্ভব হবে। করোনার মধ্যেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্ম সেতুর মতো সুবৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সমগ্র বিশ্বে আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ নিশ্চিত হয়েছে। বিগত নয়টি মাস করোনার গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও। করোনার সংক্রমণে স্থবির হয়ে পড়েছে সংস্কৃতিচর্চার বিভিন্ন মাধ্যম। খোলামঞ্চে বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও সঙ্গীতানুষ্ঠান, মঞ্চনাটক প্রভৃতির আয়োজন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সিনেমা হলগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চালু হলেও দর্শকের স্বাভাবিক চলাচল এখনো শুরু হয়নি। নতুন ছায়াছবি নির্মাণও করোনার নেতিবাচক প্রভাবে থমকে আছে। ফলে একটি বছর ধরে নীরব, নিথর ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে দেশের সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ। শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের প্রতিভাধরদের মৃত্যুও এই স্থবিরতাকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন প্রকার ক্রীড়ানুষ্ঠানের ওপরও করোনার আঘাত এসে লেগেছে তীব্রভাবে। করোনার কারণে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি টাইগারদের। এ ছাড়াও মৌসুমের নানা ক্রীড়ানুষ্ঠানও আমরা দেখেছি স্বাস্থ্যগত কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে ক্রীড়াক্ষেত্রও করোনার ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। আমাদের বিবেচনায় করোনার সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিটি হয়েছে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে। করোনাভীতি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সবাইকেই মানসিকভাবে এক প্রকার জরাগ্রস্ত করে দিয়েছে। করোনাকালে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষায় এক প্রকার ছেদও পড়েছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও মেলামেশার অভাবসহ কর্মক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়ির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে আইসোলেশনে থাকার ফলে সব বয়সীরই মনের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ পড়েছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মনোজগতেও। শুধু মনোজগৎই নয় শারীরিকভাবে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে অনেকেই নানা ধরনের শরীরী সমস্যায়ও আক্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। বাইরে যাতায়াতের ফলে শারীরিকভাবে যে পরিশ্রমটুকু সম্পন্ন হতো তা নিয়মিত না হওয়ায় এবং অভ্যস্ত জীবনচর্চা থেকে দীর্ঘমেয়াদে বিচ্ছিন্ন থাকায় সব বয়সীর শরীরেই নানা ধরনের রোগ বাসা বাঁধার অবকাশ তৈরি করে ফেলেছে। বাধ্য হয়েই আমরা এক ‘নিউ-নরমাল’ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছি। নতুন বছরের শুরু থেকেই আমরা পুরনো বছরগুলোর মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে সমগ্র দেশবাসীর মতো আমরাও মুখর হয়ে উঠতে চাই। ‘নিউ-নরমাল’ জীবন অবসানের মধ্য দিয়ে বিশ্বনিখিলের মহাপ্রভুর নিকট আমরা আগেকার ‘নরমাল’ জীবনেই ফিরে যেতে চাই। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App