×

মুক্তচিন্তা

আশা নিরাশার দোলাচল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২১, ১০:২২ পিএম

সিডনিতে আমরা দুটি দেশ বাদ দিয়ে বাংলাদেশসহ সব দেশের আগে বিষময় ২০২০ সালকে বিদায় জানিয়েছি। বরণ করেছি দুই হাজার একুশকে। বরণ শব্দটি ব্যবহার করা এখন বিপজ্জনক। কারণ আমাদের ঘাড়ের ওপর বসে আছে সেই নীরব ঘাতক। আমি যখন লিখছি তখন প্রায় নির্মূল বলে আনন্দিত সিডনিতে আবার বেড়েছে করোনার প্রকোপ। আমাদের জীবন আবার সীমাবদ্ধ ও সীমিত হয়ে উঠছে। নববর্ষে সিডনির আলোকসজ্জা সারা পৃথিবীর আকর্ষণ। দেশ ও দেশের বাইরে সিডনির এক বিপুল আয়ের উৎস। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও ডিজিটাল ব্যবসায়ে জমজমাট এবারের আয়োজন ছিল নিষ্প্রাণ। দেখে মনে হচ্ছিল কোথাও যেন শোকের হু হু হাওয়া বইছে। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মহামারি এসেছে তার মধ্যে করোনা ভাইরাসই সবচেয়ে দ্রæত ছড়িয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বে এ রোগে আট কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ১৮ লাখের বেশি মানুষের। ভাইরাস থেকে যেসব রোগ মহামারি আকারে ছড়ায় সেগুলো বিভিন্ন কারণে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে করোনা ভাইরাস দুর্বল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশসহ দুনিয়ার সব দেশে এর প্রকোপ চলছে। কিন্তু আমি বলব অপ্রস্তুত মানবসভ্যতা এ অদৃশ্য মহামারিকে সামাল দিয়েছে, দিতে পেরেছে। যেসব দেশে নেতৃত্ব সবল এবং প্রাজ্ঞ তারা মৃত্যুর হার কমিয়ে রাখতে পেরেছে। উল্টো দিকে শক্তিধর মোড়ল নামে পরিচিত আমেরিকার অবস্থা কাহিল। সে দেশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পরও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা মানতে নারাজ ছিলেন। মূলত তার গোঁয়ার্তুমি আর জেদের জন্য আমেরিকা পারেনি সামাল দিতে। তাদের রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা ফেডারেল। তাই বহু রাজ্যের সরকারপ্রধানরা নিজ দায়িত্বে সামাল দিয়েছেন, দিতে পেরেছেন। আমাদের বেলায় এমন হলে কী হতে পারত ভাবলেও লোম খাড়া হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা আর নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ সামাল দিয়েছে ভালোভাবে। কিন্তু গত বছর যা আমাদের বিস্মিত ও হতবাক করেছে তা হলো মানুষের অসততা। কিছু মানুষের অসততা আর লুটপাটের খায়েশ প্রমাণ করেছে আমরা এখনো মানুষ হতে পারিনি। শাহেদ নামের যে নব্য আওয়ামী লীগারকে পরে বন্দি করা হলো সে কি একা? না এখনো দলে সেসব লোকজন নেই? করোনা মহামারি যতটা আতঙ্ক আর ভয় জাগিয়েছে তার চেয়ে কম কোনো ভয় জাগায়নি লুটেরার দল। সঙ্গে আছে লুটপাট। দেশ থেকে এত হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। একটা বিষয় মনে রাখার মতো, সরকারের বিগত দু’বার ও এবারে যত আয়-উন্নতি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি। বেড়েছে পাওয়ারের অপব্যবহার। সামাজিকভাবে এত পতন-অধঃপতন সত্যি ভয়াবহ। বছরজুড়ে ছিল ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের ঘটনা। একজন নারী ইউএনওকে হাতুড়িপেটা করার মতো সাংঘাতিক ঘটনা দেখেছে জাতি। দেখেছে মৌলবাদের বিস্তার। আপনি কি মনে করেন এসব ঘাতক বা ব্যধি করোনার চেয়ে কম কিছু? একদিন মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে, আসতে বাধ্য। দুই হাজার একুশে সবচেয়ে ভালো খবর হলো করোনার ভ্যাকসিন মোটামুটি নাগালের ভেতর চলে এসেছে। আমরা আশা করি এ বছর থেকেই পিছু হটবে করোনা, আগে বাড়বে মানুষ। আবার ফিরে আসবে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। এ সত্য মেনে নিয়েই ভাবুন, কী হবে মৌলবাদের? তারা কি দমে যাবে না দমে থাকবে? তাদের বর্তমান চেহারাটা কেমন? এটা বলার দরকার পড়ে না কতটা সাহস আর স্পর্ধা পেলে তারা বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরঙ্কুশ শাসনামলে তার পিতা আমাদের জাতির জনকের ভাস্কর্যে হাত দেয়। যে যাই বলুক আর মাইক্রোফোনের সামনে নেতারা যাই বলুন না কেন, আমরা দেখেছি ধৃত ব্যক্তিদের পরিচয়েও আছে সরকারি দলের ছাপ। অস্বীকার আর ঘটনার পর বহিষ্কার বা শাস্তিতে সান্ত¡না থাকলেও মানুষের মনের ভেতর যে কালো দাগ তা দূর করা যায় না। গেল বছর এমন সব ঘটনা আওয়ামী লীগকে যে কালিমা দিয়ে গেছে তার উদ্ধারের একমাত্র পথ আত্মশুদ্ধি। যা হবে বলে মনে করার কোনো কারণ দেখি না। রাজনীতিহীন বছরে সমাজ ও সামাজিক দুষ্কর্মগুলোই ছিল শিরোনাম। একটা বিষয় মনে রাখতেই হবে, বাংলাদেশে এক সময় মানুষ করোনা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বাধ্য হলেও সামাজিক দস্যু ও ধনশালীরাই তা করতে দেয়নি। কী করে ভুলব পোশাক শ্রমিকদের খালি পায়ে ঢাকায় টেনে আনা? সে সময় কোভিড ছিল তুঙ্গে। অপার আশীর্বাদের বিষয় যে সংক্রমণ বা করোনা সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। এই জাতিকে মোটামুটি কবরমুখী করার কাজ করেছিল কতিপয় লোভী ব্যবসায়ী। আবার এরাই পোশাক শ্রমিকসহ নানা খাতে বছর বছর ধরে লাভ করিয়ে দেয়া হাজার হাজার কোটি টাকা কামাই করিয়ে দেয়া শ্রমিক-কর্মচারীদের এক মাস কাজ ছাড়া বেতন দেয়নি। তাদের দিকে খেয়াল রাখা দূরের কথা, তাদের চাকরি কেড়ে নিতেও দ্বিধা করেনি। এরা কীভাবে দেশ ও দশের বন্ধু সেটাই এখন জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের মানুষের শ্রম ও উপার্জনের ওপর ভিত্তি করে ধনী হয়ে যারা দেশ-বিদেশে বাড়িঘর করে আয়েশে জীবন কাটায় তাদের বেলায় আইন কোথায়? এমন অনেক বিষয়ে প্রশ্নের পাহাড় রেখেই বিদায় নিয়েছে বিষময় দুই হাজার বিশ। তার দাগ বয়ে বেড়ানো মানুষ চোখের সামনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু হতে দেখছে বটে, কিন্তু তার আগ্রহ আসলে কি আছে তাতে? না থাকার মূল কারণ যেসব, সে দিকে নজর নেই কারো। বহু বছর ধরে গদিতে থাকার সুফল যেমন কুফলও আছে বৈকি। সেগুলো শেখ হাসিনা ছাড়া আরো কারো চোখে পড়ে না বা সমাধানও দিতে পারে না। এই এককেন্দ্রিকতা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমাদের নেত্রী আমাদের শেষ ভরসা। সবসময় তার যথেচ্ছ ব্যবহার কাম্য হতে পারে না। তার কারণেই বাংলাদেশ মহামারিতেও খাদ্যে ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে পড়েনি। বহু দেশে নানা ধরনের ঘাটতি আর সংকট দেখা দিলেও ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ এখনো চলছে তার গতিতে। এই জায়গাটা সম্ভাবনার। দুর্ভাবনার আরেকটি জায়গা শিক্ষা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখাপড়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মূল পড়াশোনা বা পাঠদান আসলে বন্ধ। এতে মেধাশূন্যতাসহ যে সামাজিক কুপ্রভাব একা কেউ তার সমাধান দিতে পারবেন না। এর জন্য আধুনিক দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করা জরুরি হলেও তা এখনো করা হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে সংস্কৃতি। ধর্ম-অধর্ম আর করোনার চাপে তার বেহাল দশা। সংস্কৃতি আমাদের দেশকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরশাদ আমল এমনকি এই সে দিনেও পথ দেখিয়েছে। এখন তা স্তাবকতা আর একপেশে হয়ে ক্লেশ। সংস্কৃতির যে প্রতিবাদ বা রুখে দাঁড়ানোর শক্তি তা মূলত নিঃশেষ। এর পুনর্জাগরণ এ বছর যদি না হয় বাংলাদেশ তার আসল অবয়ব খুঁজে পাবে না। তবু এটা বলব, ভালোমন্দ মিলিয়ে আমাদের দেশ ও বাঙালি বিশ্বব্যাপী ভালো আছে। তাদের জ্ঞান, মেধা, চোখ ও দৃষ্টি যতদিন অন্ধ না হবে ততদিন তারা সব মহামারি বা কঠিন পরিস্থিতি ডিঙ্গিয়েই সমানে যাবে, যেতে পারবে। বাঙালির জীবন পুণ্যময় হোক। ধরিত্রী হোক বিপদমুক্ত। শুভ হোক দুই হাজার একুশ। অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App